ভবিষ্যৎবক্তা হিসেবে অর্থনীতিবিদরা একেবারেই যাচ্ছেতাই। পিটার লরেন্স নামের একজন কানাডিয়ান লেখক বলেছিলেন, ‘অর্থনীতিবিদ হচ্ছেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ যিনি আগামিকাল জানবেন তিনি গতকাল যে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন আজ কেন তা ঘটেনি।
বলা হয়ে থাকে বিগত পাঁচটি মন্দার মধ্যে ৯ বারই অর্থনীতিবিদরা নিশ্চিত ভবিষ্যৎবাণী করে রেখেছিলেন। তাহলে কেন অর্থনীতিবিদ সৃষ্টি? উত্তর হচ্ছে-যাতে আবহাওয়াবিদদের প্রতি মানুষের মোটামুটি বিশ্বাস থাকে। জন কেনেথ গলব্রেথ বলেছিলেন, দুইধরণের ভবিষ্যৎবাণী করার মানুষ থাকে। একদল হচ্ছে যারা কিছু জানে না। আরেকদল তারা জানে না যে তারা কিছুই জানে না। বার্নার্ড শ বলেছিলেন, পৃথিবীর সব অর্থনীতিবিদদের এক জায়গায় শুইয়ে দিলেও তারা একমত হতে পারবেন না। চার্চিল আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, দুজন অর্থনীতিবিদ থাকলে সর্বদা দুটি মত পাওয়া যাবে। আর যদি সেখানে জন মেনার্ড কেইনস থাকেন তাহলে মতামত পাওয়া যাবে তিনটি।
অর্থনীতিই কিন্তু একমাত্র বিষয় যেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত দুটি মতবাদের জন্য একই বছর দুজন অর্থনীতিবিদ নোবেল পেয়েছিলেন। যেমন, ১৯৭৪ সালে নোবেল ভাগাভাগি করেছিলেন গুনার মিরডাল এবং ফ্রেডারিক আগাস্ট ভন হায়েক।
অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে নানা ধরণের গল্প-কৌতুক চালু আছে। আবার গবেষকরাও দেখিয়েছেন যে, গত ২শ বছরে অর্থনীতিবিদরা কী পরিমাণ ভুল ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। সেই গবেষণার কথা জানেন তো? অর্থনীতির সব গবেষণায় দেখা যায় যে কেনাকাটার জন্য সবচেয়ে ভাল সময় ছিল আসলে গতবছর। আর অর্থনীতির পরিসংখ্যান হলো বিকিনির মতো। যা প্রকাশ করা হয় তা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যা প্রকাশ করা হয় না সেটাই আসল বস্তু।
কিন্তু সব ধরণের কৌতুককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মোটামুটি নির্ভুল ভবিষ্যৎবাণী করে বিখ্যাত হয়ে আছেন নুরিয়েল রুবিনি। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নুরিয়েল রুবিনি ২০০৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক অনুষ্ঠানে খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে, অর্থনীতিতে সামনে ভয়াবহ মন্দা আসছে। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত গৃহায়ন খাতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধস দেখতে যাচ্ছে। দেশটিতে ভোক্তাদের আস্থাও নেমে যাবে সর্বনিম্নে । সবমিলিয়ে গভীর মন্দায় পড়তে যাচ্ছে দেশটি। অথচ সে সময় মার্কিন অর্থনীতি ছিল যথেষ্ট চাঙ্গা, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি সর্বনিম্ন। আশঙ্কা করার মতো খুব বেশি কিছু ছিল না। ফলে হাসাহাসি হয়েছিল সে দিন রুবিনিকে নিয়ে। প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন অনেক নামি দামী অর্থনীতিবিদ। কেউ কেউ পাগলও আখ্যা দিয়েছিলেন। এমনকি সভার সভাপতিও সভার সাময়িক বিরতি দিয়ে মাথা ঠান্ডা করতে হালকা পানীয়র ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন।
নুরিয়েল রুবিনি
সেই নুরিয়েল রুবিনিকে এখন বলা হচ্ছে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। তাঁর দিনরাত কাটছে বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীদের সাথে। গত বছরের শেষের দিকে টাইমস অনলাইনে প্রকাশিত এক সংবাদে পাওয়া গেল যে, এক সপ্তাহে তাঁকে যেতে হয়েছে বুদাপেস্ট, লন্ডন ও মাদ্রিদ হয়ে নিউইয়ক। পরামর্শদাতা হিসেবে অধ্যাপক রুবিনি এখন সবার শীর্ষে। তাঁর প্রতিটি ভবিষ্যৎ বাণী প্রায় নির্ভুল।
আরেকটু পিছনে যাই। গর্ডন ব্রাউন তখন অর্থমন্ত্রী। ২০০৩ সালে ট্রেজারি প্রশ্নোত্তর পর্বে লিবালের ডেমোক্রেটস-এর ডেপুটি লিডার ভিন্স ক্যাবল প্রশ্ন করেছিলেন যে, ব্রিটিশ অর্থনীতি ভাল করলেও এটি টিকে আছে ভোক্তাদের ব্যয়ের উপর। আর ভোক্তাদের রয়েছে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত দেনা। আর এর বিপরীতে আছে বাড়ির উচ্চমূল্য। কিন্তু এখন যদি ভোক্তাদের দেনা বড় ধরণের সংকটে পড়ে তাহলে চ্যান্সেলর কি করবেন? গর্ডন ব্রাউন কি উত্তর দিয়েছিলেন? তিনি সমস্যা হলে সমাধানের পথ না বাতলে উল্টো বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ অর্থনীতি সঠিক পথেই আছে। বরং মাননীয় ডেপুটি লিডার যা বললেন তা সঠিক নয়’। ওয়েব সাইটগুলোতে এই প্রশ্ন ও উত্তর এখন বার বার ঘুরে ফিরে আসছে।
এবার আরো পিছনে যাই। নিকোলাই কন্দ্রাতিয়েভ ১৯২০ সালে বলেছিলেন, পশ্চিমা পুঁজিবাদে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য চক্র (বিজনেস সাইকেল) দেখা দেবে। আর দীর্ঘমেয়াদটা হলো ৫০ থেকে ৬০ বছরের। অর্থাৎ অর্থনীতি খুব ভাল থাকলেও ৫০ থেকে ৬০ বছর পর বড় ধরণের মন্দা দেখা দেবে। তার কথা ঠিক হয়েছিল ১৯২৯ সালের মহামন্দার সময়। সেটি হয়েছিল ৬০ বছর পরেই।
নিকোলাই কন্দ্রাতিয়েভ
তারপর আবার হলো এবার। তবে ১০ বছর বেশি পড়ে অবশ্য। তাতে অবশ্য বিশ্লেষকরা নিকোলাই কন্দ্রাতিয়েভের কৃতিত্ব কেড়ে নিচ্ছেন না। এই দীর্ঘমেয়াদের বাণিজ্যচক্রকে এখন বলা হচ্ছে ‘কন্দ্রাতিয়েভ ওয়েভ’।
মন্দা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের ব্যর্থতার কাহিনীও অবশ্য কম নেই। তবে স্বর্গ থেকে পতন যদি কারো হয়ে থাকে তাহলে তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান এলান গ্রীনস্পান। ১৯৮৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট রিগান তাঁকে নিয়োগ দিলেও ছেলে বুশ পর্যন্ত সবাই তাকে রেখেদিয়েছিলেন। একজন সফল অর্থনীতিবিদ ও ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান হিসেবে কদিন আগেও ছিল সন্দেহাতীত ভাবে খ্যাতির শীর্ষে। তাঁকে বলা হতো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর্থিক কর্মকর্তা। এমনকি তাকে ‘ইতিহাসের সেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকার’ও বলা হয়েছিল। মন্দা দেখা দেওয়ার পর এখন তাঁকে মোটামুটি শীর্ষ আসন থেকে নামিয়ে আনার পালা শুরু হয়েছে।
এলান গ্রীনস্পান এখন কার্টুনের বিষয়
সর্বশেষ তাকে বড় সর একটি ধাক্কা দিয়েছেন এবার অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান। তাঁর নতুন বইয়ের একটি অধ্যায়ের নাম ‘গ্রীনস্প্যান বাবলস’। এটা ঠিক যে গ্রীনস্প্যানের সময় অর্থনীতি ছিল যথেষ্ট চাঙ্গা। বড় ধরণের সংকট খুব বেশি দেখা যায় নি। তবে এজন্য ক্রুগম্যান কোনো কৃতিত্বই দিতে রাজী নন গ্রীনস্প্যানকে। তিনি লিখেছেন যে, মূল কৃতিত্ব আসলে তাঁর পূবসুরী পল ভলকারের। পল ভলকার একটা কঠোর মুদ্রানীতি নিয়েছিলেন। তার এই নীতি জনপ্রিয় হয়নি। প্রাথমিকভাবে কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পল ভলকারের নীতির সুফল পাওয়া গিয়েছিল কিছু পরেই। ততদিনে অবশ্য নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন গ্রীনস্প্যান। বরং তিনি এসে যেসব উদার নীতি নেন তার ফল এখন ভোগ করছে সারা বিশ্ব। সাফল্য একটা অবশ্য আছে গ্রীনস্প্যানের। আর সেটা হল শেয়ার বাবলসকে তিনি হাউজিং বাবলস-এ রূপান্তর করতে পেরেছেন। এটি হচ্ছে ক্রুগম্যানের সর্বশেষ মন্তব্য।
সবশেষ কৌতুকটা বলে যাই। এবারের অর্থনৈতিক মন্দা কেবল সরকারি আমলা ও রাজনীতিবিদরাই ডেকে আনেননি, এজন্য এবার অর্থনীতিবিদদেরও প্রয়োজন হয়েছে।
আরেকটু সংযোজন করি- একজন ডাক্তার যখন ভুল করে তখন কেবল তার রোগীই মারা যায়। আর যখন অর্থনীতিবিদ ভুল করে? তখন আসলে মারা যায় সবাই।
আলোচিত ব্লগ
রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!
রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।
আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!
এই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঁচতে হয় নিজের কাছে!
চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু। লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিউ ইয়র্কের পথে.... ২
Almost at half distance, on flight CX830.
পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন