somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এপিটাফ

২৯ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০৪ সালে খুব আকস্মিকভাবে আমার বাবা মারা যান। এর কিছুদিন পর আমরা পারিবারিকভাবে তার স্মৃতি নিয়ে একটি বই প্রকাশ করি যেখানে আমার একটা লেখা ছিল। সেই লেখাটাই এখানে তুলে দিলামঃ

এই বইটির কোন ভূমিকা নেই। সব বইয়ের শুরুতেই একটি ভূমিকা থাকে, লেখকের কথা থাকে। এখানে নেই। কারণ এই বইয়ের শুরুতো এখানে নয়। এই বইয়ের ভূমিকা শুরু হয়েছিল দীর্ঘ ৫৯ বছর আগে। ১৯৪৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর, জামালপুর শহরে।

জামালপুর থেকে ঢাকা, নয়াটোলা থেকে ঢাকেশ্বরী, তারপর গ্রীণ রোড, এভাবেই একটু একটু করে দীর্ঘ সময় ধরে লেখা হয়েছে সেই গল্প, আসলে গল্পের ভূমিকা। গল্পটা লেখা শুরু হয়েছিল মাত্র, কাহিনী জমে ওঠার আগেই লেখক যেন হঠাৎ উদাসীন হলেন, অন্যমনস্ক টানে ছিঁড়ে ফেললেন লেখার কাগজটা, বন্ধ করে দিলেন গল্পের খাতা।

কিন্তু যতটুকু লেখা হয়েছিল, সেখানে ছিলাম আমরা সবাই। কেউ কম, কেউ বেশী। সেই অসম্পূর্ণ লেখায় আমরা চিনেছিলাম একজনকে। মোঃ ইকবাল হোসেন, আমার বাবা।

তাঁকে কতটুকু চিনেছিলাম বা বুঝেছিলাম সেটা নিয়ে ভাবতে গিয়েই শুরু হল এই বই। অনেক জন- বন্ধু, আত্নীয়, সহকর্মী লিখলেন তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জানেন, যেভাবে জানেন সেই কথা। আমিও লিখেছিলাম। যেটা লিখেছিলাম সেটা এ লেখা নয়। কারণ লিখতে গিয়ে বুঝেছিলাম, আসলে ভালো করে চেনা হয়নি বাবাকে, ভালো করে দেখাও হয়নি। এই বইয়ের লেখাগুলোর ভেতর দিয়ে অনেকটা চেনা যায় তাকে। অনেকটা- সবটা নয়।

আমিও আমার বাবাকে কিছুটা চিনেছিলাম। তবে যতটুকু চিনেছিলাম, লিখতে গেলে এই বইয়ের অনেক লেখার পুনরাবৃত্তিই হবে। আর আমি সকলের বোঝার মত করে লিখতে পারবোও না। তাই আমার ঐ লেখাটাও আরেকটা অসম্পূর্ণ লেখা হয়ে পড়ে রইল।

তারপরও বলি, বাবাকে যতটুকু দেখেছি। তিনি বইপত্র নিয়ে আমাকে শেখাতে বসেননি কোনদিন, তবুও আমার জীবনের সব শিক্ষাই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। বাঙময় ও নির্বাক ভাষায় তিনি আমাকে শিখিয়ে গেছেন। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন কেমন করে নাটকের মঞ্চে আলোর কাজ করতে হয়, আমি তাঁকে দেখে জেনেছি মনের গহনকে কি করে আলোকিত করতে হয়। পিতৃত্বের গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টাতেও সফল হয়েছিলেন।

নিস্বার্থভাবে মানুষকে ভালোবেসেছেন। সকলের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছেন। সত্য ও সুন্দরের তপস্যায় জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর যেন আত্নশুদ্ধির এক কঠিন ব্রত পালন করছিলেন। গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলেন লেখা আর গবেষণার কাজে। আমার আত্নোপলব্ধি থেকে বলতে পারি, তিনি যে বিশ্বাসকে ধারণ করে জীবন যাপন করতেন, সে বিশ্বাসকে উপলব্ধি করাই অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়, তা পালন করা দূরে থাক।

আসলে সত্যি বলতে কি, তাঁর সাথে আমার দেখাশোনা আজও শেষ হয়নি। আমি যে তাঁরি অংশ, আমার সত্তায় তিনিই তো বহমান। অস্তিত্বের কোন এক অজানা গহীন স্তরে আমরা এক- তিনি ও আমি। এই পৃথিবীর যা কিছু দৃশ্যমান ও বাহ্যিক, তার বাইরে, ধরা-ছোঁয়ার জগতের আড়ালে, চেতনার অবারিত যে প্রান্তরে সত্তার গাঢ় ছায়া পড়ে, সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার চলে নিত্য দেখাশোনা। তাইতো এখনো শেষ হলো না চেনার-বোঝার পালা।

আসলে শেষ হবেও না কোনদিন। যতদিন আমার ভেতরে এবং আমাদের পরেও যারা আসবে তাদের ভেতরে তিনি থাকবেন, ততদিন আমরা তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করতেই থাকবো। মৃত্যুই শেষ নয়। এই বইটিও আসলে সেই নিরন্তর প্রচেষ্টার মাঝখানে কোন এক স্থানের একটি মাইলফলক। এখানে শুরু নয়, এখানে শেষও নয়। শুধু জানা হলো পেরিয়ে গেছে একটি জীবন।

বাবাকে কবর দিয়েছি আজিমপুর কবরস্থানে। নিজে একজন অসাধারণ মানুষ হলেও, সবসময়ই চাইতেন সাধারণ হয়ে থাকতে, তাই তিনি শুয়ে আছেন সকলের মাঝে। তাঁর কবরের ওপর তথাকথিত বরণীয় ব্যক্তিদের মত করে লেখা নেই কোন মর্মস্পর্শী বাণী। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে তাঁর এপিটাফে আমরা লিখেছি একটি কথাই- আছো অন্তরে চিরদিন।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×