দেয়াল ঘড়িটা আয়েসি ভঙ্গিতে ঢং-ঢং শব্দ করে জানান দিচ্ছে মধ্যরাতের বারতা।এই সময়টাতে গভীর ঘুমে অচেতন থাকে মাসুম।কিন্তু আজ সে ঘুমোতে পারছেনা। ।সকালের উত্তেজনা এখনো কাটেনি মাসুমের।সমস্ত শরীর জুড়ে টগবগ করছে দ্রোহের রক্ত..
"শালা পাকির বাচ্চা ! তোর এট বড় সাহস আমার সামনে বাংলাদেশ কে নিয়ে বাজে কথা বলিস!! কি করে ভুলে গেলি আমরা তোদের পরাজিত করেছিলাম!!! ঐবেটা রোনালদোর জন্য তোর মাথাটা আজ ফাটিয়ে দিতে পারলাম না"---আপন মনে কথা গুলো আওড়াতে থাকে মাসুম।
মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি সে।তবে ইতিহাস পাঠ আর মায়ের কাছ থেকে যা জেনেছে তাতেই সে পাকিস্তানিদের ঘৃণা করে ।তবে এই আরব মুল্লুকে এসে একসাথে কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তানিদের ভাল করেই চেনা হয়ে গেছে তার ।সে এখন বুজতে পারে ৭১ সালে এই বর্বর মানুষগুলো কতটা হায়েনার মত ছিল।এখনও সুযোগ পেলেই এরা বাংলাদেশ আর বাঙ্গালী সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে।মাসুম তার সামনে এটা হতে দেয়না।প্রতিবাদ করে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে।সকালে সহকর্মী আসলাম খান বাংলাদেশ নিয়ে বাজে মন্তব্য করায় ক্ষেপে যায় সে।
-ইউ পিপলস আর কাওয়ার্ড গালি দেয় মাসুম
-শালা বাঙ্গালী তুম ক্যায়া কাহরাহে হো?চিৎকার করে বলে আসলাম খান। মেজাজ চটে যায় মাসুমের।মূহুর্তে নিজের সমস্ত শক্তি এক করে দানবাকায় পাকিস্তানির কলার চেপে ধরে নাকের উপর সপাং করে বসিয়ে দেয় ঘুষি।পরক্ষনেই পান্জাবী হায়েনার শক্ত হাতের প্রতিউত্তর আসে।এবার টেবিলে রাখা কাঠের ফুলদানী হাতে তুলে নেয় মাসুম।"শালা পাকির বাচ্চা জানোয়ার তোকে আজ মেরেই ফেলব"...হুংকার দিয়ে উঠে মাসুম। ততক্ষনে পাশের ডেস্ক থেকে ছুটে আসে ফিলিপিনো নাগরিক রোনালদো। সে মাসুমের হাত ধরে ফেলে ।টেনে বাহিরে নিয়ে আসে।ভিতরে পরাজিত হায়েনা তখনও বাংগালীদের গালিগালাজ করছিল....
মাসুম বিছানায় গড়াগড়ি খায়। মনে মনে রোনালদো কে ভৎসনা করে। কিছুতেই চোখের পাতা দুটো এক করতে পারছেনা।মাঝে মাঝে মরুভূমির আচমকা দমকা হাওয়ায় বাইরের লনে পরিত্যক্ত পেপসির ক্যান,পানির বোতল,জুসের শিশি গড়াগড়ি খাওয়ার ক্যচ ক্যচ শব্দ আর দুএকটা মরুচারী কুকুরের আর্তনাদ কানে ভেসে আসছে।পাশের রুমে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে পাকিস্তানি জানোয়ারটা।মাসুমের ইচ্ছে করছে কিচেন থেকে মাংস কাটার ধারালো চোরাটা এনে হায়েনাটার বুকে বসিয়ে দিতে।বিছানার পাশে রাখা এক জগ পানি পুরোটাই শেষ করে ফেলে।চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্ঠা করে..
"বাচাঁও ! বাচাঁও !! কতগুলো আতঙ্কিত মানুষের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে মাসুম।সাথে মেশিনগান আর রাইফেলের ভীবৎস আওয়াজ।কিছু উর্দি পরা সৈনিক নির্বিচারে মেরে ফেলছে কতগুলো নিরীহ ঘুমন্ত নারী,পূরুষ আর শিশুকে।এরা কারা মাসুম কিছুই বুঝতে পারছেনা।সহসা সে দেখতে পায় কিছু অপরিচিত পূর্বপুরুষের মুখ।তারা মাসুম কে বাহবা দিচ্ছে,প্রতিবাদের প্রেরণা যোগাচ্ছে.....-"
ঢং-ঢং-ঢং আবারো সুর করে বেজে উঠে ঘড়িটা। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে মাসুম।এতক্ষন তন্দ্রার ঘোরে স্বপ্ন দেখছিল সে।তার সমস্ত শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে।এসির শীতল হাওয়ার মাঝেও তার ঘাম বের হচ্ছে।
আলো জ্বালিয়ে টিবিলে গিয়ে বসে মাসুম।শূন্য জগ উচিঁয়ে পানি খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্ঠা করে।টেবিলে রাখা মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন।
হঠাৎ বড় ঘড়িটার ডায়ালে চোখ পড়তেই চমকে উঠে! আজ ২৫ মার্চ;সেই কালো রাত।আটত্রিশ বছর আগে এমনি এক রাতের অন্ধকারে নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি হায়েনারা।এই মূহুর্তে একটু আগে স্বপ্নের ঘোরে দেখা মানুষগুলো কে চিনতে পারে মাসুম।অন্তর্গত যন্ত্রনা আর ক্ষোভে কেঁদে উঠে মন।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে মাসুম ।করিডোরে কয়েকবার অস্থির পায়চারী করে।আচমকা গিয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানী রুমের সামনে।নিজের মনের সমস্ত ক্ষোভ আর ঘৃণা উগড়ে দিয়ে মুখের ভিতর থেকে এক দলা বিশ্রী থু থু এনে ছিটিয়ে দেয় রুমের দরজায় সাঁটানো পাকিস্তানের পতাকায়।
তারপের ধীর পায়ে মরুভূমির উন্মুক্ত প্রান্তরে এসে দাঁড়ায় মাসুম।আজকের আকাশে অসংখ্য তারার মেলা।মায়ের কথা ভীষন মনে পড়ে তার। ছোটবেলায় এমন তারা ভরা রাতে মা তাকে ২৫ মার্চের ইতিহাস শুনাতো; মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনাতো; যুদ্ধে শহীদ হওয়া চাচার গল্প শুনাতো।আর মনের ভিতর জ্বালিয়ে দিত পাকিস্তানি হায়নাদের প্রতি দ্রোহ ও ঘৃণার আগুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:৩৫