somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভোটকি তাসলিমা

২২ শে মার্চ, ২০০৯ ভোর ৪:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


টুং টুং করিয়া ইস্কুলের মধ্যাহ্ন বিরতির ঘন্টা বাজিয়া উঠিল। অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র হইতে আলোক যেমনি করিয়া চারিদিকে বিচ্ছুরিত হইতে থাকে তেমনি করিয়া শ্রেনীকক্ষের অতি সংকীর্ণ দরজা দিয়া দুরন্ত বালক-বালিকার দল যেন বিশ্বময় বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। বিরতির উদ্দেশ্য যে পানাহার তাহার প্রতি তাহাদের যেন এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নাই। বিরতি তাহাদের কাছে যে অর্থ লইয়াছে তাহা হইল- আধ ঘন্টার দৌড়-ঝাঁপ তথাপি ঘর্মাক্ত দেহ।

ইস্কুলের আঙ্গিনা যেন দস্যিপনার বিরুদ্ধে ধুলি উড়াইয়া তাহার প্রতিবাদের ভাষা ব্যাক্ত করিতেছে।এত্তসব প্রাণ চাঞ্চল্যের মাঝে দৃষ্টিগোচর হয় তৃতীয় শ্রেনীর দরজার সামনে দাঁড়াইয়া একটি বালিকা। করিডোরের স্তম্ভ ধরিয়া সে যেন বন্ধুত্ব খুঁজিয়া ফিরিতেছে, খুঁজিয়া ফিরিতেছে খেলার সাথী।

বালিকার চেহারা দেখিলে তাহার প্রতি স্নেহাবেগ হাত মেলিয়া ধরেনা। চেহারায় চিমটির ক্ষত চিহ্ন। কেশগুচ্ছ পরিচর্যার অভাবে কেমন যেন ফ্যাকাশে হইয়া উঠিয়াছে। অযত্নে বাড়িয়া উঠা কুমড়ো লতাখানি দৃষ্টিগোচর হইবার পর গৃহমাতা যেমন করিয়া কঞ্চি ধরাইয়া দেন তেমনি করিয়া বালিকাও যেন তাহার অযত্ন বিকশিত কেশগুচ্ছ দুইখান রাবার ব্যান্ড দিয়া বাঁধিয়া সৌন্দর্য্যের কঞ্চি ধরাইয়া দিল।
নেভী ব্লু ফ্রকের রং বহুদিন আগেই ফিকে হইয়া উঠিয়াছে। ইস্কুলের ইউনিফর্ম বজায় না রাখিবার দরুন প্রায়শই তাহাকে শিক্ষক-শিক্ষিকাগনের তিরস্কার এবং দু'-চারি ঘা বেত্রাঘাত জুটাইয়া দিতে ফ্রকখানির জুড়ি নাই। পায়ের কনভেক্স জুতা জোড়ার মস্তকখানির একাংশ এমন করিয়া খুলিয়াছে যেন তাহা কাহারো প্রতি ভেংচি কাটিতেছে। কাহারো এতখানি দৃষ্টি জুতা জোড়ার উপর পতিত হইলে বৃদ্ধাঙ্গুলীগুলিকে বালিকা এমন করিয়া জুতার ভিতর ঢুকাইবার চেষ্টা করে যাহা দেখিলে খোলসে প্রবেশমূখী শামুকের কথাই মনে পড়িয়া যায়।

সহপাঠি তুলির চিৎকার শুনিয়া তাহার প্রতি তাসলিমার দৃষ্টি পতিত হইল। অকস্মাৎ তাহার কেশগুচ্ছে শক্ত টান অনুভূত হইবা মাত্র সে তড়িৎ ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল হারুন দৌড়াইয়া মাঠের দিকে যাইতেছে এবং তাহাকে ভেংচি কাটিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছে " ঐ ভোটকি তাসলিমা, কি করছ্?" ঠিক কখন যে তাহার তাসলিমা নামের আগে ব্যাঙ্গার্থক "ভোটকি" বিশেষনটি যুক্ত হইয়াছে তাহা সে অনেক ভাবিয়াও হিসাব করিতে পারিল না।

টুং টুং শব্দ জানান দিল বিরতি শেষ হইয়াছে। সমাজ-বিজ্ঞান ক্লাস চলিতেছে। সুলতানা আপা বেত্রখানি টেবিলে চাপড়াইয়া সকলকে চুপ হইবার নির্দেশ দিলেন। দিবসের পাঠ্যবিষয় "পরিবার"। বাড়ির পাঠ দেখাইতে বলা হইলে সকলেই তাহা দেখাইতে সমর্থ হইল শুধু তাসলিমা ছাড়া। "এই বালিকা তুমি বাড়িতে কি করিয়া থাক? কেন কখনো বাড়ির পাঠ দেখাইতে পারনা?" এমন নিত্য শ্রুত প্রশ্নমালা তাসলিমার কর্ণ বিদ্ধ করিয়াছে বলিয়া মনে হইল না। অতঃপর শিক্ষিকা তাহাকে দুই ঘা চপোটাঘাত করিয়া চেহারায় এমন ভাব ফুটাইয়া তুলিলেন যা দেখিলে মনে হইবে কেহ তাহাকেও দুই ঘা দিয়াছেন। "তোর গায়ে কি দুর্গন্ধ!" বলিয়া তিরস্কৃত করিবার পর শিক্ষিকা তাসলিমাকে পরবর্তী ৩৫ মিনিট কান ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকিবার নির্দেশ দিলেন।

সহপাঠি ও শিক্ষক-শিক্ষিকাগনের নানা তিরস্কার, দুর্ব্যবহার, বেত্রাঘাত সঙ্গীহীন তাসলিমার নিত্য সঙ্গী হইয়া উঠিয়াছে । কেউ হয়না তাহার খেলার সাথী, কেউ তাহার সাথে করেনা টিফিন ভাগাভাগী কারন তাহাকে কেউ কোনদিন টিফিন আনিতে দেখিয়াছে বলিয়া মনে করিতে পারেনা। উপরস্তু টিফিন চুরির মিথ্যা দায়ে তাহার ভাগ্যে মাঝে মাঝে শাস্তি জুটিয়া যায়।

সমাজ-বিজ্ঞান ক্লাস শেষ হইবার পর শ্রেনীকক্ষে প্রবেশ করিলেন হুজুর স্যার। হুজুর স্যার নাম শুনিয়া অনেকেই হয়ত তাঁহাকে বয়সের হিসাবে বৃদ্ধদের কাতারে দাঁড় করাইবেন। কিন্তু না, তাহার বয়স ৩০-৩৫ হইবে। ধর্ম-শিক্ষা ক্লাসে বালকগণ মাথায় টুপি (যদিও তাহাদের পরনে হাফ প্যান্ট) এবং বালিকাগণ স্কার্ফ পরিধান করিবার নির্দেশ পালন করিয়া বসিল। হুজুর স্যার সর্বদা স্কার্ফ না থাকায় সর্বপ্রথমে তাসলিমাকে আক্রমণ করিতে ব্যাত্যয় করেন না। অতঃপর পাঠ দিতে না পারায় তাসলিমার প্রতি ধার্য হইল কান ধরিয়া এক পায়ে ক্লাস শেষ না হইবা অবধি দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে।

হুজুর স্যার ক্লাসের "মিষ্টি মেয়ে" খ্যাত ফারজানা, তুলি এবং শাহেদাকে কাছে ডাকিয়া তাহাদের সাথে খুনসুটি করিতেছেন এবং তাহাদিগকে গান করিবার প্রস্তাব করিতেছেন। বালকদল শিক্ষকের এরূপ নিত্য আচরণে তাহার প্রতি যার পরনাই ন-খোশ। তাসলিমা ব্যাতীত অন্য বালিকাদিগকে তিনি কখনই বেত্রাঘাত করেন না অথচ বালকদিগকে বেত্রাঘাত করিতে তিনি এতটুকু দয়াদ্র হন না।

ক্লাসের সময় শেষ হইয়া আসিলে তিনি তাসলিমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন " কেন তুই এত নোংড়া, কেন তুই শ্রেনীকক্ষের পাঠ দিতে সর্বদা অকৃতকার্য ?" ইত্যাদি ইত্যাদি। খানিকক্ষন নিশ্চুপ থাকিবার পর তাসলিমা উত্তর দিল "স্যার আমার যে মা নাই, আমার বাসায় যে সৎ মা।" সমগ্র শ্রেনীকক্ষ অকস্মাৎ নিঃস্তবদ্ধ হইয়া পড়িল। যেন পিন পতনের শব্দটুকুও হইল না। টুং টুং করিয়া ছুটির ঘন্টা বাজিয়া উঠিলে সকলে শশব্যাস্ত হইয়া উঠিল।

তার পরদিন বিদ্যালয়ে আসিয়া সকলে যেন মনে মনে কাহাকে খুঁজিতে লাগিল। কিন্তু সে আর কোনদিন ফিরিয়া আসে নাই। সেই দিনের পর আর কেহ কোন দিন তাসলিমাকে বিদ্যালয় দেখিয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না। কালক্রমে ভোটকি তাসলিমা বিস্মৃত হইয়া গেল।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×