somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পতাকার ফেরিওয়ালা.. .. ..

১৯ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(এই গল্পটি কিছুদিন আগে একবার পোস্ট করেছিলাম।এত বড় গল্পটাকে একবারে দেয়াটা বিরাট বোকামী হয়েছিল।তাই পর্ব আকারে দিলাম।আগামী পর্বে বাকিটুকুন)
মাঝে মাঝেই নিজেকে আমার কাক মনে হয়। একটা বৃষ্টিভেজা দাঁড়কাক, প্রবল বর্ষনেও যার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় না কোথাও.. .. ..
আজ এই মুহূর্তে আমারও ঠাঁই নেই আপনজনদের ভীড়ে। শীতের রোদ্দুরে ভিজছি আমি। একা। আর সাথে আছে শুধু ব্যস্ত নগরীটার সদা তরুণ শোরগোল-আমার শ্রবণ সীমা অতিক্রম করে মনকে করে তুলছে বধির।
আর আকাশ ভেঙে নামা তরল সোনালি রোদ্দুর মনের অন্ধ অলি-গলি গুলো ঘুরে ঘুরে কিভাবে যেন পৌছে যাচ্ছে আমার মন-চিলেকোঠার ঘুপচি ঘরে.. ..
যে ঘরে ভীষণ যত্ন করে তাকে রেখেছিলাম আমি। ভীষন ভীষণ যত্নে! আর পরম ভালোবাসায় আগলে রাখা স্বপ্ন মানবীকে আজ পরের বধূ হতেও দেখে এসেছি আমি পরম আগ্রহ নিয়েই। আমার মত মধ্যবিত্ত পুরুষের ঘরনী হতে চায়নি সে। আর তাই হাত ধরেছে এমন সর্বগুনে গুনান্বিত একজনের.. ..
স্মার্ট-হ্যান্ডসাম-মাসে ষাট হাজার উপার্জনক্ষম একজনের।
আবার মাও চেয়েছে আমার কাছে বারবার,বোঝাতে চেষ্টা করেছে সাদামাটা আমাকে.. .. ..
জীবনে এতবড় সুযোগ কটা মেয়ে পায়? সে পেয়েছে,কারণ সে রূপসী। এবং এত মূল্যবান সুযোগটা হাতছাড়া করার মত বোকামীটা সে করতে পারবে না । কিছুতেই না।
.. .. ..আমার প্রাণের নগরীর আকাশতলে দাঁড়িয়ে অবশ্য এ মুহুর্তে কিছুই স্পর্শ করে না আমাকে। ঘরে ফেরার তাগিদ তুচ্ছ হয়ে যায় রিকশার টুংটাং আওয়াজ আর কিশোর-কিশোরীর প্রথম প্রেমের লাজুকতার সামনে। সিগনালে বিক্রি হওয়া হাওয়াই মিঠাই গুলোর রঙিন উচ্ছাসের সাথে ভেসে ভেসে যায় আমার মন, হেঁটে চলে পতাকার ফেরিওয়ালার অকান্ত পায়ের পিছু পিছু.. .. ..
ফেরিওয়ালার কাঁধের আশ্রয় থেকে মুহুর্তের অসাবধানে খসে পড়া লাল-সবুজ বাংলাদেশকে অবহেলায় মাড়িয়ে চলে যায় দামী জুতো পড়া এক জোড়া পা। আমার মনে হয়-পতাকাকে নয়,মাড়িয়ে যায় সে নিজের মযার্দাকেই। পায়ের নিচে পিষে দিয়ে যায় নিজেরই সম্মান,নিজের গৌরবকে। পরিবারের অপমানে ফুঁসে উঠি আমরা সবাই, কিন্তু দেশের অপমানে কতজন প্রতিবাদ করি? কেন নিজের দেশটাকে ততটা আপন ভেবে উঠতে পারিনা আমরা,যতটা আপন ভাবি নিজেকে আর নিজের পরিবারকে??
.. .. ..লাল-সবুজ পতাকাটি নিমেষে আলোকিত করে দিতে শুরু করে আমার পরাজিত মনের আঁধারকে-যখন ফুটপাতের বুক থেকে কুড়িয়ে নেই আমি তাকে,ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করতে থাকি।
আমার ভুলে যাই প্রায়ই-
ভুলে যাই যে পতাকাকে অসম্মান করা যায় না, পতাকাকে অবহেলায় পায়ে মাড়ানো যায় না। তাহলে অস্বীকার করা হয় নিজের পরিচয়কেই।
.. .. ..কোথায় চলে গেছেন পতাকা বাহক মানুষটা? কতদূর? ফিরে আসবেন কি তিনি পিছনে রয়ে যাওয়া পতাকার খোঁজে?
উদ্বিগ্ন হই না আমি। কেননা জানি এই মানুষটার সাথে আবার দেখা হবে আমার। রোজ তাকে এই রাস্তাতেই দেখি আমি-একই সময়ে,সারা বছর। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের প্রত্যেকটি দিনে.. .. ..
‘আব্বাজান!”
ছোট্ট একটা ডাক,অসম্ভভব মিষ্টি একটা ডাক।
পতাকা বাহক মানুষটির রোদে পোড়া,বিবর্ণ মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকি আমি সব ভুলে। জীবনে কখনও কেউ এমন করে আমাকে ডাকেনি!!!
১)
ঘাড় থেকে শূন্য ঝাঁকাটা নামিয়ে রেখে স্ত্রীর মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে দেখেন রমিজউদ্দীন। হাসিনা বানুর মুখটা থমথমে,আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। ফাঁকা হয়ে যাওয়া ঝাঁকাটাও সেই মুখের অনুভবে কোনো পরিবর্তণ আসতে পারেনি।
অবশ্য পারার কথাও নয়।
বাজারে কাঁচা পেঁপের কেজি মাত্র পাঁচ টাকা,জানে হাসিনা বানু। ঠেকায় পড়ে কাঁচা পেঁপে গুলি নিয়ে আজ বিক্রি করতে হয়েছে। ভালো জাতের গাছ, ফল গুলিকে পাকার সুযোগ দিতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যেতে পারতো। কিন্তু করারও ছিলো না কিছু। ঘরে চাল নেই,একটা কিছু ব্যবস্থা তো করতেই হবে।
বছরের অন্য সময়ে এতটা কষ্টে পড়তে হয় না,যতটা এই বর্ষার সময়ে। রমিজউদ্দীণ পেশায় কামলা। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো,আচার ব্যবহার ভালো। কাজের অভাব হয় না তার। কোনোরকম টানাটানি করে দিন ঠিকই কেটে যায়.. .. ..
আসলে সত্যি বলতে কি-আগে যেতো। এখন আর যায় না।
দুবছর আগের টাইফয়েডটার পর থেকে বেশী পরিশ্রম সয় না গতরে। তাও বসে থাকে না রমিজউদ্দীণ,গাধার মতো খাটে দিনরাত। পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে খাটে।
কিন্তু ফায়দা কি?
জিনিসপত্রের দাম রোজ রোজ বাড়ে,মানুষের গতরের খাটনীর দাম তো আর বাড়ে না। তারওপর চলছে বর্ষাকাল,এই সময়ে অন্তত এই এলাকায় কাজ পাওয়া যায় না।
.. .. ..সকাল থেকেই আকাশে ঘন মেঘ,নামি নামি করছে। তাড়াহুড়া করে তাই রান্না সারার চেষ্টা করছে হাসিনা বানু। ভেজা পাতা জ্বালাতে গিয়ে চোখে পানি-টানি এসে একাকার অবস্থা।
অবশ্য রান্নাই বা আর কি!!
একটা পাতিলে গোটা দুই আলু আর কালচে মতন কি এক শাক-পাতা জ্বাল দিচ্ছে লবন দিয়ে। একসাথে চটকে সবাইকে ভাগ করে দিবে। কালকেও এই কাজই করেছিল হাসিনা বানু।
রমিজউদ্দীনের অবশ্য খারাপ লাগেনি খেতে। কিন্তু ছেলেটা বারবার ভাতের জন্যে ঘ্যানঘ্যান করছিল। এই বাড়িতে আজকাল দিনে একবার খেতে পায় সবাই। তারপরেও যদি ছেলেমেয়ে গুলিকে দুটা ভাত না দিতে পারা যায় ,মনটাই ছোট হয়ে যায় তখন।
‘এক কেজি চাউল আনছি,বউ। রাইন্ধে ফ্যালো!’
জবাব দেয় না হাসিনা বানু। চোখ তুলে তাকায়ও না। মেম্বারের বাসায় সকাল-সন্ধ্যা দুবেলা কাজ করে সে,মাসে তিনশো টাকা পায়। সেখান থেকে ফেরার পর মুখটা সবসময়েই এমন থমথম করে।
‘ভাত রান্ধো,বউ। খিদা লাগছে।’আবার বলে রমিজউদ্দীণ। ‘পেট ভইরে ভাত খামু সবাই।’
‘আইজ সব রানলে কাইল খাইবেন কি?’
‘কাইলও কিনতে পারুম এক কেজি,ট্যাকা আছে।’
‘তারপরের দিন কি হইবো?’
‘সেইডা তখন বুঝবোনে। তুমি ভাত চড়াও।.. .. ..সোহাগ কই?সুলতানা ইসকুল থেইকে আসে নাই?’
‘আর ইসকুল!! ফকিরনীর বেটির অত ইসকুলে যাওয়া লাগে না।’
‘এইসব কি কও,বউ? মাইয়ার আমাগো মাথা ভালো.. . ..’
‘মাইয়া কি আপনের জজ-ব্যারিস্টার হইবো নাকি?’তীব্র সুরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে হাসিনা বানু।‘হইবো তো মাইনষের ঘরের বান্দি! ওনসব ইসকুল-ফিসকুলের ঢং ছাড়ান দিয়া কামে নামতে বলেন।গতর খাটায় কইরা খাক। ধিরিঙ্গি মাইয়ারে আমি আর কাম কইরা খাওয়াইতে পারুম না। রোজ রোজ মেম্বার ব্যাটার শয়তানি আর সইয্যো হয় না আমার.. .. ..’
এত কথাতেও ধৈর্য্য হারান না রমিজউদ্দীণ। বরং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।‘কি আর করবা,বউ! দুনিয়াটাই জানি কেমন হইয়া গেছে! গরীব মাইনষের কুনো দাম নাই। যাগো হাতে মেতা,তারাই অখন আল্লাহ। যুদ্ধ করনের সময় একবারও তো ভাবি নাই যে এইসব মাইনষেরা একদিন.. ..’
‘খবরদার!!’ভীষণ অম ক্রোধে কি যেন একটা উঠানে ছুঁড়ে ফেলে হাসিনা বানু। ‘খবরদার কইতেছি আপনেরে,যুদ্ধের প্যাচাল পাড়বেন না!.. ..কিসের যুদ্ধ,হ্যা? কিসের যুদ্ধ?.. ..পাইছেনটা কি যুদ্ধ কইরে?কি দিছে এই দ্যাশ আপনেরে?.. ..চাইরটা মুখের সংসার,তা-ও খাওন দিতে পারেন না। কি পাইছেন এই দ্যাশ থেইকে আপনে? কি পাইছেন?’
‘ছিঃ বউ! এমনে কও ক্যান? যুদ্ধ কি কিছু পাওয়ার লাইগা করছিলাম?’
‘ক্যান,পাইবেন ক্যান?মেম্বার ব্যটা তো যুদ্ধ না কইরাও মুক্তিযোদ্ধা হয়। আপনে তো আসল মুক্তিযোদ্ধা.. .. ..’
‘তো কি হইছে,বউ? যুদ্ধে তো আমি মারা যাই নাই। পঙ্গুও হই নাই। অন্য মাইনষের সাহায্য এই মুক্তিযোদ্ধা রমিজউদ্দীণ আশা করে না।’
‘সংসারে খাওন যোগাইতে পারেন না... আহারে আমার মুক্তিযোদ্ধা!!’
‘বউ গো,দ্যাশ তো আমাগো মা। মায়েরে বাঁচনোর লাইগা যুদ্ধ করছিলাম। মায়ের ইজ্জত বাঁচায় যদি প্রতিদান চাই,তাইলে তো আমার মতন হারামী দুনিয়ায় একডাও নাই.. .. ..’
‘গরীব মাইনষের অত ঢং থাকা লাগে না!!!’
ঝগড়া আর বাড়তে দেন না,উঠে চলে যান রমিজউদ্দীন। এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসিনা বানু।
কারণ সে জানে,সন্ধ্যার আগে আর মানুষটা ঘরে ফিরবে না।কোথায় থাকবে এতটা সময়,কি করে বেড়াবে-সে নিজেই শুধু জানে।
২)
তাড়াতাড়ি পা চালায় সুলতানা।কেন যেন মনটা অস্থির অস্থির লাগে খুব।
আকাশে এত মেঘ,মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা ছয়টা। বান্ধবীরা আজ কেউ স্কুলে আসেনি,বৃষ্টি-বাদলা বেশী দেখেই হয়তো। অগ্যতা বাড়ি ফিরতে হচ্ছে একা একা।
অবশ্য সাথে বান্ধবীরা থাকলেই বা কি হতো?লোকগুলো রোজই তো তাকে আজেবাজে কথাবার্তা বলে। সবার সামনেই বলে। কিছুদিন হলো বোরখা পরা শুরু করাতেও লাভ হয়নি কিছুই। লোকগুলো.. .. ..
স্কুলে না গিয়েও তো উপায় নেই। এবার কাস টেনে উঠেছে সে,সামনের বছর এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। ভালো রোজাল্ট করতে গেলে তো স্কুলে যেতেই হবে। কাস ফাইভ থেকে হেডমাস্টার স্যার তার পড়াশোনার খরচ দিচ্ছেন। কথা দিয়েছেন ভালো রেজাল্ট করলে কলেজেও পড়াবেন.. .. ..
.. .. ..আরও দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করে সুলতানা। রিতীমত দৌড়ে চলে। লোকগুলো চায়ের দোকানটার সামনে থেকে পিছু নিয়েছে আজ। অনেকটা দূরে এখনও,তবে মন বলছে যে এই দূরত্ব কমতে থাকবে ক্রমশ। কমতে থাকবে আর কমতেই থাকবে!
পেছন থেকে ভেসে আসছে শিষ মারার আওয়াজ। বাতাস বহন করে নিয়ে আসছে লোকগুলোর ছুঁড়ে দেয়া কুৎসিত কুৎসিত বাক্য।
‘.. ..ওরে ছেমড়ি,আমরা কি তোরে কিছু করছি নাকি?.. ..’
‘করুম রে.. ..অনেক কিছু করুম। এত তাড়াহুড়া কিসের?’
‘হায় হায় মেরি জান! বুরখাডা খুলো না ক্যান?.. ..খুলো খুলো! আমরা তোমার স্বোয়ামী,আমাগো লগে শরম নাই।’
‘.. ..ওরে মাগী,একটু পরে তো তিনজনের লগেই শুইতে হইবো। আয় না,কাছে আয়.. ..’
‘ভালো মতন আয় রে,তোরে খুশি কইরা দিবো আমরা। সালোয়ারটা খোল.. .. ..’
‘তিনজনই আমরা মরদের বাচ্চা,আরাম পাইবি অনেক। কাছে আয়!’
‘মনে হইতেছে তিনজনে হইবো না তোর.. .. ..আর কয়জন ডাকুম?’
কুৎসিত হাসির আওয়াজগুলো শরীরের সাথে লেপ্টে যেতে থাকে সুলতানার। ঘৃণায় রি রি করে ওঠে মন। কাঁদতে কাঁদতেই দৌড়ে চলে সে।
কিন্তু কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?এই লোকগুলিকে কেউ ঘাটায় না এই এলাকায়। একটু নিরিবিলি পেলেই লোকগুলো তাকে.. .. ..
মনে মনে আল্লাহর নামে কসম কাটে কিশোরী। আজ এই বিপদ থেকে রা পেলে জীবনে আর কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার নামও করবে না সে। খারাপ লাগবে খুব,কষ্ট হবে। তবুও দরকার নেই।বেঁচে থাকা শিখে নেবে সে স্কুল ছাড়া.. ..
.. ..বাড়ির পথ আর কতদূর?.. ..
অনেক। জানে সুলতানা।তবুও সামনে একটা বাড়ি দেখে খানিকটা আশা জাগে মনে.. .. ..ওইটা নাসিমদের বাড়ি না?
হ্যা,নাসিমদেরই। ওর আব্বা স্কুলের দপ্তরী। সে যদি এখন গিয়ে বাসায় দাঁড়ায়,চাচা-চাচী তো আর তাকে বের হয়ে যেতে বলবেন না।
প্রাণপনে দৌড়ায় সুলতানা।
স্কুল শেষে বাড়ি না ফিরলে আব্বা নিশ্চয়ই খুঁজতে বের হবে তাকে। আর খুঁজতে খুঁজতে এখানেও আসবে নিশ্চয়ই। একবার আব্বা চলে আসলে আর কোনো ভয় নেই.. .. ..
‘নাসিম!!! চাচী!!!’
নাসিমদের বাড়ির সীমানায় ঢুকে মনে হয় বুঝি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে,তবু জোর গলায় ডাকে সুলতানা। চাচীকে বের হয়ে আসতে দেখে বসে পড়ে বারান্দায়,যেন প্রাণটা ফিরে পায় দেহে।
‘ওরে মাগী!.. ..’সাথে ভেসে আসে আরও কুৎসিত কিছু গালাগাল।
‘এই দিন,দিন না। আরও দিন আছে.. ..’
‘খানকী কোনহানকার!!’
সুলতানার মনে হয় যদি বধির হয়ে যেতে পারতো! কি দোষটা করেছে সে পৃথিবীর কাছে? এই লোকগুলো কেন এমন করে সবসময়?
কেন?
সে গরীব মানুষের মেয়ে বলে?কই,মেম্বার সাহেবের মেয়ের দিকে তো কেউ তাকায় না। তাকে শুনতে হয় না কুৎসিত কথা,দেখতে হয় না কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। কাজ দেয়ার নাম করে কেউ তার শরীর হাতড়ে দেয় না,ঘৃন্য স্পর্শে বিষিয়ে দেয় না মন।
দেয় না,কারণ সে মেম্বার সাহেবের মেয়ে। এই এলাকার ক্ষমতাবান মানুষের মেয়ে। জানে সুলতানা।
৩)
তিনদিন হলো ঘরে ভাত নেই।কাল কোথা থেকে যেন কয়টা মিষ্টি আলু নিয়ে এসেছিল সুলতানার বাপ। আর আজকে যে কি হবে ভাবতেও ভয় পায় হাসিনা বানু। সকাল থেকে সোহাগ কাঁদছে ভাতের জন্যে.. .. ..
কোথায় পাবে ভাত?
কোথা থেকে আনবে?
সুলতানা ডাগর মেয়ে।তাকে কোথাও কাজে দিতেও ভয় লাগে।সেদিন তো স্কুলের পথে ওই ছোঁড়াগুলো.. ..ভয়ে জ্বর চলে এসেছিল মেয়েটার।পাঁচ দিন ভুগেছে।জ্বরের মাথায় এলোমেলো প্রলাপ বকেছে,ভয়ে চিৎকার করেছে।
অবশ্য কাজে দেয়ার ফায়দাই বা কি?এই এলাকায় কাজের মানুষ রাখার সার্মথ্য খুব বেশী মানুষের নেই। পুরো মাস কাজ করার পর পাওয়া যায় দুইশো.. ..বড়জোর তিনশো টাকা।
তিনশো টাকা তাদের জন্যে অনেক। কিন্তু থাক,লাগবে না টাকা!টাকার জন্যে একমাত্র মেয়েটাকে পুরুষলোকের বদনজরে ফেলতে চায় না হাসিনা বানু। নিজের বয়স তিরিশ হতে চললো,তবুও তো এগাতে পারে না এইসব। মেম্বার ব্যাটা সারাণ কু প্রস্তাব করে। বলে-টাকায় নাকি মুড়িয়ে দেবে,দূর করে দেবে সংসারের সব অভাব।
বেগম সাহেবাকে এইসব জানিয়ে দেখেছে সে। লাভ তো হয়ইনি কিছু, উল্টো কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়েছে মেম্বারের বউ। বলেছে-কাজের বেটিদের নাকি চরিত্রই খারাপ। সুযোগ পেলেই সাহেবদের সাথে ঘষাঘষি করার চেষ্ট করে।
তবুও বেগম সাহেবাকে আজ খুব অনুরোধ করেছিল এক মুঠো চালের জন্য। বেশী নয়,মাত্র এক মুঠো। শুধু সোহাগকে যদি একটু ভাত রেঁধে খাওয়াতে পারতো!!!
কিন্তু না। সেই ধণী গৃহিনীর শরীরে বোধহয় দয়ামায়া কিছুই নেই। চালের বদলে একশো একটা গাল বকে হাসিনা বানুকে ভাগিয়েছে সে।
ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করে এবার অসহায় মা.. ..
এই তিলতিল অপমানের জীবন আর সইতে পারছে না সে। আজ তিনদিন হতে চললো ছেলেমেয়ে দুটিকে কিছু খাওয়াতে পারেনি। সুলতানার বাপেরই বা কি দোষ?মানুষটারও তো গতরে আর সয় না। তবু চেষ্টা করে দিনরাত। কিন্তু কাজ না পেলে কি হাওয়া থেকে কাজ বানাবে সে?
এ বর্ষায় বেচতে বেচতে ঘরের সবই বেচা শেষ। চারটা মুরগী ছিল,একটা চৌকি ছিল।সবজির গাছ কয়টা তো বর্ষার পানিতেই ডুবে গেছে.. ..
আল্লাহর কি এখনও দয়া হয় না?
গরীব মানুষগুলিকে একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে যাবে এই বর্ষা। আর ছাড়বে না তাদেরকেও। কিভাবে বাঁচবে তারা?কি খেয়ে বাঁচবে? গাছের পেঁপেগুলি ছিল একমাত্র সম্বল,তাও বিক্রি করা শেষ। এমনকি বিয়ের সময়ে বাপজানের দেয়া নাকফুলটাও এবার বিক্রি করে দিয়েছে হাসিনা বানু। ভেবেছিল-বিয়ের সময়ে সুলতানাকে আর কিছু দিতে পারুক আর না পারুক,এই নাকফুলটা দেবে।গরীব মায়ের কথা সারা জীবন মনে রাখবে মেয়েটা.. ..মেয়ে তার অনেক বড় হবে.. ..
আর কিছুই বাকি নেই এখন। কিচ্ছু না।
বিক্রি করার মত একটি জিনিসই আছে এ বাড়িতে। আর সেটা হলো বাড়ির বউ-ঝিদের ইজ্জত। আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
‘মা গো,আইজও ভাত রানবা না?’অবুঝের মত প্রশ্ন করে ভীষন বুদ্ধিমতী সুলতানা।‘সোহাগ তো কানতেছে,মা!’
‘কান্দে তো কান্দুক!’জবাবে ঝাঁঝিয়ে ওঠে হাসিনা বানু।‘আমি কই থেইকা খাওন আনুম?’
‘আমার মাথা ঘুরাইতেছে মা। পাও কাঁপতেছে।’
‘তো কি করুম আমি?কি করুম?’অশ্র“ চাপতে আরও জোরে চিৎকার করে ওঠে মা।‘মরতে পারিস না তোরা?আমারে জ্বালাইস ক্যান?তোর মুক্তিযোদ্ধা বাপেরে ক যায়ে খাওন আনতে! আমারে কইবি না।’
রাগ করে সুলতানা।বোধহয় সে শক্তিও পায় না শরীরের মাঝে। শূণ্য চোখে বসে থাকে কেবল। অনেক.. .. ..অনেকটা সময়!
‘কয়টা শাক পাই কিনা দেখি। পাইলে তুমি সোহাগরে সিদ্ধ কইরে দিও, মা.. .. ..’ যেতে যেতে নিকের জন্যে আবার ফিরে তাকায় কিশোরী। ‘হেডমাস্টার স্যারের কাছে যামুনে একবার।যায়ে আমাগো কথা বলমুনে..’
‘যা,ভাগ আভাগীর বেটি! মর যায়ে!.. ..দূর হ সামনে থেইকে।’
ধীর পায়ে চলে যায় সুলতানা। নীরবে,চোখ মুছতে মুছতে।
হাসিনা বানুর তষনও জানা ছিল না যে.. .. ..
একমাত্র কণ্যার সাথে এটাই তার সর্বশেষ দেখা!!
(পরবর্তী পর্বে সমাপ‌্য)
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×