somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্লামডগ মিলিয়নিয়ার: পরিবেশন ও গ্রহণের রাজনীতি

০৭ ই মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এবারের অস্কার পাওয়া ছবি স্লামডগ মিলিওনিয়ার এর কাহিনী ভারতের মুম্বাই শহরের ধারাবি বস্তির প্রেক্ষাপটে দুই ভাই সেলিম আর জামালের বেড়ে ওঠার কাহিনী। ভারতের জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো “কৌন বনেগা ক্রোড়পতি”তে অংশ নিয়ে বস্তির ছেলে তরুণ চা-ওয়ালা জামাল কীভাবে বিশ মিলিয়ন রূপি জিতে যায়, তার ওপর ভিত্তি করেই এই ছবি। ক্রোড়পতি অনুষ্ঠানে জামাল যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়, সেসবের জবাব সে তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দিয়ে দেয়। আর এই জবাবগুলো সাজিয়ে তোলে জামাল নামের এক স্লামডগের মিলিয়নিয়ার হয়ে ওঠার কাহিনী।
স্লামডগ মিলিয়নিয়ার য়ুরোপ-আমেরিকায় প্রশংসিত হলেও দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছে ভারতে। বিশেষত বস্তিবাসীর মাঝে। তারা এই ছবি প্রদর্শনের প্রতিবাদে মিছিল করেছে, হাতে “আমরা স্লামডগ নই” প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তাদের মতে, স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবিতে বস্তির যে জীবন দেখানো হয়েছে তা অত্যন্ত একতরফা এবং অসত্য। অবমাননাকরও বটে। আবার বলিউডের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা বলছেন এই ছবি আসলে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করে না। ভারতের ওপর তৈরি হয়েছে মাত্র। এই ছবির কাহিনীক্রম বাস্তবানূগ নয়। এমনকি সালমান রূশদীও বলেন যে এই ছবির গল্পে অনেক ফাঁক রয়েছে এবং “it piles impossibilities on impossibilities” অর্থাৎ এক অসম্ভবের ইটের ওপর আরেক অসম্ভবের ইট সাজিয়ে বানানো হয়েছে স্লামডগের দালান। এই দালান পশ্চিমাদের। তারা যেভাবে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে চায়, এই ছবি তারই মূর্ত চেহারা।

অবাক লাগে, সালমান রূশদীর মত ঔপন্যাসিক কেন বাস্তবের সাথে পাই পাই করে মিলিয়ে এই ছবির রস গ্রহণ করতে ব্রতী হলেন? স্লামডগ তো ডকুমেন্টারি ছবি নয়, একটা ফিকশনমাত্র। আর এই ফিকশনটি যিনি লিখেছেন, সেই বিকাশ স্বরূপ নিজেও একজন ভারতীয়। তাঁর উপন্যাসটি যখন কমনওয়েলথ পুরষ্কারের শর্টলিস্টে ছিল তখন কিন্তু এর কাহিনী নিয়ে কোনো বিতর্ক উঠেনি। বিকাশ স্বরূপ তাঁর উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে শরণ নিয়েছেন সত্তর দশকের ব্লকবাস্টার “দিওয়ার” ছবির কাছে। স্লামডগ মিলিওনিয়ার বানাতে এসে ডেভিড বয়েল যশ চোপড়ার “দিওয়ার” দেখেছেন, রাম গোপাল ভার্মার “সত্য” দেখেছেন, মীরা নায়ারের “সালাম বোম্বে” দেখেছেন। এসব ছবির অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ভারতের বস্তি জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করেছেন।

সত্তর দশকের হিন্দি ছবির ইতিহাস অমিতাভ বচ্চনের স্লামহিরো হয়ে ওঠার ইতিহাস প্রায় সমার্থক। “দিওয়ার” থেকে “কুলি” পর্যন্ত অমিতাভের যে ইমেজ জনমানসে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা আসলে স্লামহিরোর ইমেজ। এসব ছবিতে দেখা যায়, বস্তি মানেই মাদক, নারীব্যবসা এবং অন্যান্য অপরাধের আখড়া। যাবতীয় অন্যায় অবিচার সেখানে গরিব মানুষেরা যুগের পর যুগ নীরবে সহ্য করে, যতক্ষণ না একজন অমিতাভ বচ্চন তাদের মাঝ থেকে রূখে দাঁড়ায়। এটি এমন একটি জনপ্রিয় ফর্মূলা হয়ে গেছিল, যার কারণে আশীষ নন্দী বলতে বাধ্য হন যে, ভারতের চলচ্চিত্র হল ভারতের বস্তির বাইপ্রডাক্ট, একইভাবে ভারতের বস্তি ভারতীয় চলচ্চিত্র থেকে উদ্ভূত। কুটনীতিক লেখক বিকাশ স্বরূপ তাঁর বস্তি ধার করেছেন “দিওয়ার” ছবি থেকে, পরিচালক ড্যানি বয়েল তাঁর বস্তি ধার করেছেন বিকাশ স্বরূপের উপন্যাস থেকে, এভাবে ২০০৯ সালের স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবিটি যে বস্তিকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছে তা কমপক্ষে চল্লিশ বছরের পুরনো। হ্যাঁ, স্লামডগের বস্তি সত্তর দশকেরই বস্তি। বস্তির এই চেহারাটাই রূপালি পর্দার ফিতায় এযাবতকাল বন্দী, সে আপনি “দিওয়ার”ই বলুন, কিংবা “সিটি অব জয়”ই বলুন।

এটাই মূলত স্লামডগ মিলিয়নিয়ার নিয়ে যাবতীয় অসন্তোষের মূল কারণ। ছবির কাহিনী মুম্বাইয়ের ধারাবি বস্তির (যদিও শুটিং হয়েছে জুহু নামক বস্তিতে) যেটি এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি হিসেবে পরিচিত। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ অধ্যুষিত ধারাবি বস্তিতে জীবন এ ধরনের অনিশ্চয়তা আর সহিংসতায় ভরা নয়। কথায় কথায় উচ্ছেদ, আগুন আর দাঙ্গা ধারাবি বস্তিতে রীতিমত অসম্ভব, বস্তিবাসী সেখানে অনেক সংগঠিত। দক্ষিণ এশিয়ার যে কোন বড় বস্তির ক্ষেত্রেই কমবেশি এ কথা খাটে, সেটা মুম্বাইয়ের ধারাবী হোক কিংবা ঢাকার কড়াইলই হোক। নানান রকমের সংগঠন আছে সেখানে, আছে হাজার রকমের এনজিও আর তাদের কার্যক্রম। তাছাড়া ভিতর থেকে হোক বা বাইরে থেকেই হোক, এসব বস্তির ওপরে আছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নিবিড় পরিবীক্ষণ। ফলে, স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবিতে শিশু সেলিম ও জামাল যেভাবে মাতৃহারা ও গৃহহারা হল সেটা অবিশ্বাস্য ঠেকে।

এখন কথা হল, চলচ্চিত্রকে কি বিশ্বাস্য হতেই হবে? অন্যান্য প্রেক্ষাপটে বানানো চলচ্চিত্রের ব্যাপারে আমরা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দাড়িপাল্লা সামনে এতটা রাখি না। কিন্তু নগর গরিবের কাছে বস্তি শুধু একটা থাকার জায়গা নয়, একটা মতাদর্শও বটে। শহরের জীবনে প্রবেশ করার সাথে সাথেই এই মতাদর্শের মালা তার গলায় পরিয়ে দেয়া হয়। উচ্চবর্গের যাবতীয় সন্দেহ, তাচ্ছিল্য আর শোষণের বিপরীতে বস্তিবাসীর মূল সংগ্রামটাই আসলে ব্যক্তিগত মর্যাদাবোধ পুনরুদ্ধারের, ইরানী তাত্ত্বিক আসেফ বায়াত যেমন বলেন। যে কারণে দেখা যায় বস্তিতে মাদক কিংবা নারীব্যবসার হোতারা কেউ বস্তিবাসী নন, খোদ বস্তিবাসীরা এসব থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু আমরা আমাদের স্বভাবজাত তাচ্ছিল্য থেকে এসবই বস্তির ঘটনা বলে ধরে নিই। এই প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্রের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার দাবি জোরালো নিশ্চয়ই, যেহেতু বস্তি স্রেফ কোনো স্থান নয়, একটা মতাদর্শও। স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবিতে বস্তির যে জীবন তা মতাদর্শ হিসেবে বস্তিকে অবমাননা করে।

আগেই বলেছি, স্লামডগ মিলিয়নিয়ার পশ্চিমকে বেশ দ্রুতই তৃপ্ত করেছে। বস্তি, দারিদ্র, নারীব্যবসা, শিশুনির্যাতন মিলিয়ে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার যে ছবিটা পশ্চিমের মনে এতকাল গাঁথা, এই ছবি তাতে ষোল আনা তাল দিয়েছে। একই সঙ্গে এই ছবি বলিউডি ছবির দুর্দান্ত দাপটকে সমীহ করার এবং একটা অংশীদারীর ভিত্তিতে ব্যবসা করার নতুন একটা রোডম্যাপ হাজির করেছে। মনে রাখতে হবে, আশি’র দশকে হলিউডি ছবি ভারতের বাজারে এসে যাচ্ছেতাই মার খেয়েছিল। এবার কিন্তু এরকম হয় নি। প্রতিবাদ হয়েছে, ছবি ফ্লপ হয়নি। তাই এবারের অস্কার সম্মাননা মূলত ভারতীয় ছবির বাজারকে সঠিকভাবে অনুধাবন করবার স্বীকৃতি। এর অর্থ এই নয় যে স্লামডগ মিলিয়নিয়ার একটা কপিক্যাট ছবি। নতুনত্ব আছে এখানে। আর সেটি হল, সম্ভবত এই প্রথম একটা রিয়েলিটি শো-র ফর্ম্যাটে টেলিভিশন মিডিয়াটি চলচ্চিত্রের ওপর খুব অর্থপূর্ণভাবে দাপট দেখিয়ে গেল গোটা ছবি জুড়ে। রিয়েলিটি শো-গুলো টেলিভিশনকে অনেক বেশি মিথষ্ক্রিয়ামূলক করে ফেলেছে সা¤প্রতিককালে। সেটাকেই স্বীকৃতি দিল চলচ্চিত্র, যার ফলে কলসেন্টারের চা-ওয়ালা জামালের কোটিপতি হবার যাত্রায় আমরাও রূদ্ধশ্বাস সামিল হয়ে পড়ি।

*৭ মার্চ ২০০৯ প্রথম আলো-য় প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৮
২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×