somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি রাজকীয় প্রতিদানের গল্প

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সসাগরা সদ্বীপা রাজ্যের মার্তণ্ডপ্রতাপ রাজা পারিষদবর্গ লইয়া মৃগয়ায় বাহির হইয়াছেন। শিকার করিতে করিতে রাজ্যের গহন অরণ্যে যাইয়া উহারা এক কস্তুরি মৃগের সাক্ষাত পাইলেন। রাজবৈদ্যগণ এমৎ মৃগের নানাবিধ অলৌকিক গুণ সম্পর্কে রাজাকে পূর্বাহ্নেই জ্ঞাত করাইয়াছিলেন। রাজা তাই বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে গর্জিয়া উঠিলেন, "এই মৃগ আমার চাই। যদি উহা পলায়ন করে, তাহা হইলে যাহার সন্নিকটবর্তী হইয়া পালাইবে, তাহার দক্ষিণ শিরে গর্দান লওয়া হইবে।"

রাজ-অনুচরগণ ত্রস্ত সন্ত্রস্ত্র হইয়া ক্ষীপ্রগতিতে মৃগের চতুর্দিকে পরিবেষ্টন করিল, বেষ্টনি ক্রমে ক্রমে ক্ষুদ্রতর হইতে লাগিল। হঠাৎ কস্তুরি মৃগটি শূন্যে লাফাইয়া উঠিল, এবং পরক্ষণে ভূপতিত হইয়া সবেগে রাজার সন্নিকটবর্তী বেষ্টনির ফাঁক দিয়া পালাইয়া গেল। রাজা বায়ুবেগে মৃগের পশ্চাতে অশ্বচালনা করিয়া দিলেন; অনুচরগণ রাজাকে অনুসরণ করিবার প্রয়াস পাইতে লাগিল।

কিয়ৎক্ষণ পরে অনুচরের দল রাজাকে হারাইয়া ফেলিয়া দিগ্বিদিক ছড়াইয়া পড়িল, শুধু রাজা বিদ্যুদ্বেগে মৃগের পশ্চাতে লাগিয়া রহিলেন। মৃগটি বড় সহজ প্রাণী ছিল না; রাজা এইক্ষণে উহাকে দেখিতে পান তো পরক্ষণেই উহা বৃক্ষ গুল্মের আড়ালে চলিয়া যায়। রাজা এবং অশ্ব উভয়েই সত্বর শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত হইয়া উঠিল। স্বেদ ধারায় রাজার শরীর সিক্ত হইয়া গেল, কিন্তু গভীর আক্রোশে ও মনের দৃঢ়তায় তিনি হাল ছাড়িলেন না।

অনেকক্ষণ অতিক্রান্ত হইবার পর রাজা মৃগটিকে হঠাৎ অতীব নিকটে দেখিতে পাইয়া কোষ হইতে অসি নিষ্কাশন করিলেন এবং উহার দিকে অসি সংহার করিলেন। কিন্ত অশ্বটি একখানি বৃক্ষের উপর সবেগে আছড়াইয়া পড়িল আর রাজা অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ছিটকাইয়া পড়িলেন গুল্ম ঝোঁপের উপর। অশ্বের প্রাণবায়ু নির্বাপিত হইল; রাজা গুল্ম ঝোঁপ হইতে ভূলুণ্ঠিত হইলেন। রাজার অবস্থাও শোচনীয়, তৃষ্ণায় তাহার বুকের ছাঁতি ফাটিয়া যাইতে লাগিল, ক্ষুৎ-পিপাসা-বেদনায় উঠিবার শক্তি রহিত হইয়া গেল। সসাগরা সদ্বীপা রাজ্যের মার্তণ্ডপ্রতাপ রাজা চলৎশক্তিহীন হইয়া চক্ষু মুদিয়া নিজ রাজ্যের বিজন বনে বন্ধুহীন করুণ মৃত্যুর অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে রাজার ঠোঁটে হঠাৎ অমৃত বর্ষণ হইতে লাগিল। অমৃতরস ধীরে ধীরে রাজার শিরায় শিরায় বহিয়া গেল, শরীরে জাগিয়া উঠিল প্রাণের স্পন্দন, মুদিত আঁখি উন্মীলিত হইল। রাজা দেখিলেন একখানি মায়া ভরা মুখ তাকাইয়া আছে।

প্রজা রাজাকে চিনিতে পারিল না, কিন্তু গভীর মমতায় রাজাকে নিজ ডেরায় বহিয়া লইয়া গেল ও শুশ্রুষা করিয়া সুস্থ্ করিয়া তুলিল। অতঃপর রাজা বিদায় লইয়া রাজধানী অভিমুখে গমন করিলেন।

কিয়ৎদিবস পরে একদল অশ্বারোহী ও একটি ঐরাবত বাহন ব্যাপক সমারোহে প্রজাকে রাজদরবারে লইয়া আসিল। প্রজা অবাক হইয়া গেল, কিন্তু রাজদরবারে পৌঁছিয়া রাজাকে দেখিতে পাইয়া সামগ্রিক তত্ত্ব বুঝিতে পারিল। রাজাকে আনন্দিত দেখিয়া প্রজাও খুশি হইল।

রাজা সভাসদদিগের সাথে প্রজাকে পরিচয় করাইয়া দিবার পর বলিলেন, "হে বন্ধু, একদা তুমি আমাকে মৃত্যুর হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছ। আজিকে আমি উহার উপযুক্ত মূল্য দিব। বল তোমার কী কামনা? আমার রাজ্য ঐশ্বর্য্য হইতে তুমি তোমার যাহা খুশি বাছিয়া লও।"

পারিষদরা বলিয়া উঠিল, "বাহবা, বা! সসাগরা সদ্বীপা রাজ্যের অধিপতি মার্তণ্ডপ্রতাপ রাজার উপযুক্ত ব্যবহারই বটে ইহা।"

প্রজা লজ্জিত হইয়া বলিল, "আমার কিছুই প্রয়োজন নাই, রাজাধিপতি।" পারিষদবর্গ প্রজার মূঢ়তায় হাসিয়া উঠিল।

রাজা কহিলেন, "না, তোমার কিছু লইতেই হইবে, বন্ধু। যাহা তোমার অভিলাষ, আমার কাছে নিঃসঙ্কোচে ব্যক্ত কর। তোমার ঋণের উপযুক্ত প্রতিদান আমি দিতে চাই, ঋণগ্রস্ত থাকিয়া যাওয়া আমার অভিপ্রায় নহে। "

রাজার পীড়াপীড়িতে প্রজা অবশেষে বলিল, "তাহা হইলে, রাজাধিরাজ, আমি শুধু যে জল আপনাকে পান করাইয়াছিলাম, উহার মূল্য দিলেই চলিবে।"

রাজার অঙ্গুলিনির্দেশে মুহূর্তের মধ্যে রাজ্যের সুপরিষ্কার সুপেয় সর্বোৎকৃষ্ট পুষ্করিণী হইতে ভিস্তি ভরিয়া প্রচুর জল আসিল; পারিষদগণ প্রজার নির্বুদ্ধিতায় আবারো হাস্যধ্বনি করিল।

প্রজা শান্তভাবে বলিল, "রাজাধিরাজ, আমি আপনাকে যে জল পান করাইয়াছিলাম, উহার মূল্য অতি সামান্য। এঁদো পুকুরের জল, পানা সরাইয়া আমি আপনকার জন্য আনিয়াছিলাম। শুধু ঐটুকু জল, যাহা আপনকার মুখে ঢালিয়াছিলাম, ফিরাইয়া দিলেই উহার মূল্য শোধ হইয়া যাবে। এতসব মূল্যবান সুপরিষ্কার জলের প্রয়োজন নাই।"

রাজা ও পারিষদবর্গ প্রজার দিকে অবাক হইয়া তাকাইয়া রহিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সকাল ৮:২১
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×