somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডুবে ডুবে ভাসার গল্প

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১১:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের গ্রামগুলোতে আষাঢ় শ্রাবণের দিকে নিচু ক্ষেত আর গ্রীষ্মের শুকনো খাল গুলো পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। সেই পানির নাচন দেখলে গ্রামের ছেলেরা কোনো এক ঘোরে পড়েই যেন ছুট লাগায় পানির দিকে। তেমনি এক সময়ে আমরা নগরের নাগরিকেরা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। বয়স ছিল পাঁচ কি ছয়, পানির দেশের মানুষ হলে কি হবে...সাঁতার জানি না। এরকম সময়ে তাই গ্রামে গিয়ে মা-বাবারও সবসময় মনে ভয়...পানিতে ডুবে না মরে যায়! আমাকে নিয়ে খুব একটা ভয়ের কারন ছিল না:D। ছেলেবেলা থেকেই খুব ভীতু হওয়াতে পানির ধারে-কাছে যেতাম না। এমনকি পুকুরপাড়ে যেতাম যখন, তখনো কাছে ধারে বাবা-মা কাউকে না কাউকে হাজিরা দিতে হতো। মাঝে মাঝে গ্রাম সম্পর্কীয় আত্মীয় অথবা চাচাতো ভাইবোনেরা সে হাজিরা দিত। কতোটা ভীতু ছিলাম তার নমুনা না দিলে হয়তো বুঝা যাবে না, শুধু এতোটুকু বলি, এতোটাই ভীতু ছিলাম যে পুকুর ঘাটের শেষ সিঁড়িগুলো আমি বসে বসে পা টেনে-হিচঁড়ে পার হতাম:|

তবু পানির দেশের মানুষ বলেই হয়তো পানির দিকে একটা টান আমাদের থেকেই যায়, সাগরের কাছে গিয়ে সাগরে পা না ভিজিয়ে আমরা পারি না। অথচ পেছনের বিশাল গুরু-গম্ভীর পাহাড় আমাদের মনোযোগ না পেয়ে হয়তো অভিমানী হয়ে উঠে। শহরের ফার্মের মুরগীদের গ্রাম চেনানোর জন্য তাই বাবা আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে এরকম সময়ে বের হলেন, সঙ্গী হলো দুষ্ট কিছু চাচাতো ভাই। তাদের বয়স ১২-১৩ এর ঘরে, সবাই পানির পোকা। নৌকাতে আমরা উঠলাম, চাচাতো ভাইয়েরাও উঠলো। বাবা এইসময় কিছু একটা ভুলে রেখে এসেছেন বলে আমাদেরকে মাঝির দায়িত্ব রেখে বাড়ির দিকে গেলেন। মোক্ষম সময়ে প্রকৃতিও যেন মাঝিকে ডাকাডাকি শুরু করলো:P। মাঝি একটু আড়াল খুঁজতে গেলেন। পানির পোকা দুষ্ট ভাইগুলো এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, তারা নৌকা নিয়ে দিলেন টান। আমরা তো বেশ থ্রিল অনুভব করতে লাগলাম...জীবনে প্রথম একা, চারদিকে শুধু পানি আর পানি...:)


লেখার শিরোনাম দেখে সবাই আন্দাজ করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে ...দুর্ঘটনা ধেয়ে আসার সময় হয়ে এসেছে। বর্ষার বৃষ্টি গুড়িগুড়ি করে আগেই পড়ছিল। হঠাৎ সে বৃষ্টি ঝড় হয়ে যেন ধেয়ে আসলো...আমরা তখন খালের মাঝখানে...চারদিকে শুধু পানি আর পানি। নৌকা ভীষণভাবে দুলছিল।আমি আর আমার বোন কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম:((। চাচাতো ভাইয়েরা ভয় পেয়ে গেল।তারা কেউ লগি দিয়ে ঠেলতে লাগলো, কেউ আবার নৌকা যেন ঢেউয়ে উলটে না যায় সে জন্য পানিতে নেমে বুকপানিতে দাঁড়িয়ে নৌকা স্থির রাখার চেষ্টা করলো। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে পানি ততোটা গভীর না, নাইলে ভাই দাঁড়ালো কেমনে/:)? আমি কান্নাকাটি বন্ধ করে আমার বেকুব বোনের কান্না দেখতে লাগলাম :P

ইতোমধ্যে বাড়িতে নৌকা নিয়ে পালানোর খবর রাষ্ট্র হয়ে গেছে। নৌকা বাড়ির কাছে আসতেই দেখলাম, ফুফু বুক পানিতে নেমে আমাদের খুঁজতে খুঁজতে হয়রান...আমাদেরকে আস্ত দেখে সেই বৃষ্টির মধ্যেই হু হু করে কেঁদে উঠলেন। বৃষ্টির পানি আর অশ্রুর পার্থক্য করা তখনো শিখি নাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, এক জীবনে কতোজনের ঋণ নিয়ে বেঁচে আছি!

গল্পের আর তেমন বাকি নাই। বাকিটা শুধুই দুষ্ট ভাইদের উত্তম-মধ্যমের গল্প:P...সে গল্প না শুনলেও চলবে;)



এ ঘটনার পর আমার মনে পানি সংক্রান্ত ভীতি কিছুটা কমে এলো। সেই সাথে সাঁতার শেখার প্রয়োজনীয়তাও মাথায় ঢুকলো। আরেকবার যখন গ্রামে গেলাম, বাবাকে বললাম, সাঁতার শিখবোB-)। বাবা তখন মাঝ পুকুরে, বাবা বললেন, "পানিতে না নামলে তো সাঁতার শিখতে পারবি না...আগে পানিতে নাম।" আমি লঞ্চে করে বাড়ি যাবার সময় মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, লঞ্চের উপর থেকে দুষ্ট ছেলের দল কিভাবে পানিতে লাফ দিতো...আমিও ঘাটের সিঁড়ি থেকে তেমনি করে লাফ দিলাম:D। পানিতে পড়লাম...ডুবতে শুরু করলাম। অলিম্পিকের সাতাঁরুর সাঁতারের স্টাইলে হাত-পা নাড়তে লাগলাম...ধীরে ধীরে সবুজ পানিতে তলিয়ে যেতে থাকলাম। আশেপাশে সবুজ, শ্বাস নিতে পারছি না...দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভূত একট অনুভূতি হতে লাগলো! হাত উপরে তুলে রেখেছিলাম, যদিও পুকুর বেশ গভীর। একসময় তলার মাটিতে পা লাগলো। মাথার উপর চার-পাঁচ হাত পানি। তখনো মনে হয়নি যে আমি মারা যাচ্ছি ...সেই বয়সে মৃত্যুর কথা বুঝি চিন্তাও করিনি:|। যেই মুহূর্তে আমার পা মাটিতে লাগলো, তখুনি বাবার হাত আমাকে পেল। টেনে তুললো সে হাত। কাশতে কাশতে আমার উপচে পড়া সাহস আর সাঁতারের ইচ্ছা বমি করে পুকুরের সবুজ জলে ফেলে দিলাম /:)


পুরোপুরি বমি হয়তো হয়নি...তাই পেটে রয়ে যাওয়া সাহস আর ইচ্ছেগুলো আরেকবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো:D। সাঁতার শেখার জন্য শহরের সুইমিং পুলগুলো দাপিয়ে বেড়াতে লাগলাম। আর্মি স্টেডিয়ামের ফ্রি কোর্স থেকে শুরু করে বিডিআর এর পুলে পয়সা দিয়েও শিখতে গেলাম। দাপাদাপি করা হলো, ডুব-ডুব খেলা হলো, কিছুদুর সাঁতরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেয়া শিখা হলো, পানির তলায় পা রেখে হাঁটাহাঁটিও করা হলো...সাঁতার আর শেখা হলো না:|। একসময় হাল ছেড়ে দিলাম/:)। কিছুদিন আগে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সেখানে হোটেলের সুইমিং পুলে সবার সাথে খেলতে আর দাপাদাপি করতেই নামা। হঠাৎ খেয়াল করলাম, বেশ ভালোই সাঁতরাচ্ছি। দম থাকছে না, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তবু সাঁতরাচ্ছি!! আমি মুগ্ধ হলাম এই ভেবে যে এতোদিনের থিওরি অবশেষে প্রাকটিকালে কাজে লাগলো!


সুইমিং পুলের আধাআধি এ বিদ্যা সত্যিকারের বিপদে হয়তো কাজে লাগবে না...তবু ডুবতে ডুবতে তো ভাসা শেখা হলো! সে-ই বা কম কি?:D
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৮
২০টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×