somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাইনি বৃত্তান্ত (২)

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মকর সংক্রান্তির দিনই ঘটে গেল ভয়ঙ্কর ঘটনা। নদীর পারের অস্থায়ী মেলার দোকান থেকে জিলিপি গজা খেয়ে নদীর গর্তের জমা স্রোতহীন জলে তৃষ্ণা মিটিয়েছিল যে পাঁচটি ছেলে-মেয়ে তাদের ডায়রিয়া হয়ে গেল। হাসপাতালে নিতে নিতেই তারা মারাও গেল। মকর পরবের আনন্দের ওপর আচমকাই নেমে এল শ্মশানের স্তব্ধতা। পুত্র-কন্য হারা মায়েদের আর্তনাদে গোটা বাঁউড়িকুলিতে মধ্যাহ্নেই আঁধার নেমে এল।
অনেকদিন পরে মেঘুর আঙ্গিনা উপচে ভিড় জমে গেল। গাঁয়ে খারাপ হাওয়া লেগেছে। ওঝাকে ডাকা হল। গাঁয়ের বয়স্ক লোকজনদের নিয়ে মেঘু 'গল্প' (পরামর্শ) করতে বসলো। ওঝা সনাতন বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানান আঁকিবুকি কেটে তেলপাতা পড়ে সর্বসমক্ষে জানাল--
--কুসুমের উপর ডাহিন ভর করেছে। তাই চার বছরেও উয়ার পেটে ছগনা জন্মায়নি। মরদ ঘর ছাড়্যে চল্যে গেইলছে। ওই ডাহিন-ই বাচ্চাগুলানরে খাঁয়েছ্যে।
--কিন্তু অপদেবতা ট কে বঠেন?
জানতে চাইল মোঘু।
--কেনে চৈতনার মা বঠে! উয়া গতি হয় নাই এখুনও।
উপস্থিত সকলের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বিদ্যুতের মতো বয়ে গেল। বছর পাঁচ আগে চৈতনার মা জলে ডুবে অপঘাতে মারা গিয়েছিল। সকলেরই সে বৃত্তান্ত মনে পড়লো।
নিষ্ফলা হওয়া এবং যুয়ান বউ ছেড়ে যুয়ান মরদের ঘর ছেড়ে পালানোর মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে পাঁচ-পাঁচটি ছেলে-মেয়ের অপমৃত্যু কুসুমকে মেঘু আর ওঝার থাবার মধ্যে দ্রুত তুলে দিল। মোড়লের অন্নদাস যৌনব্যাভিচারী ওঝা তেলপাতা পড়ে তার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে গোটা গ্রামকে কুসুমের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিল নির্ভুল অঙ্কে।
ভগ্নদূতের মতো এবারেও এই ভয়ঙ্কর সংবাদটি কুসুমকে পৌঁছে দিল ঝাণ্ডিসনা। এবারে সত্যি সত্যি কুসুমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। মেয়্যালোকের সবেই বদনাম--যুয়ানে কসবী , নইলে ডাহিন! সকালে মেঘুকে ফিরিয়ে দেওয়ার পরিণাম রাতের মধ্যেই এত নির্মম এবং ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে এতটা কুসুম দু:স্বপ্নেও ভাবেনি।
সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারলো না কুসুম। সামনে পড়ে থাকা দীর্ঘ ভবিষ্যত নিয়ে অজস্র ভাবনা ভাবলো। যেভাবেই হোক তাকে বাঁচতে হবে। ডাহিন অপবাদ মুছে বাঁচতে গেলে মেঘু আর তার অন্নদাস ওঝাকে তার পক্ষে চাই। ঝাণ্ডিসনার সঙ্গেও নানাভাবে শলা করলো কুসুম। শেষ পর্যন্ত সকাল হতে না হতেই সনাকে দিয়ে গোপনে মেঘুর কাছে খবর পাঠালো--রাতে যেন মেঘু একবার চুপিচুপি কুসুমের ঘরে আসে।
অনেকদিন পরে আজ মাথায় ফুলেল তেল মাখলো কুসুম। কপালে আঁকলো মেটে সিঁদুরের বড় টিপ। দু'হাত ভরে পরলো রঙিন কাচের চুড়ি। গায়ে জড়ালো লাল সিল্কের শাড়ি। কাজল টানলো বড় বড় দু'চোখের কোলে। কুসুমের রূপ এবং দুদ্দার যৈবন দেখে ঝাণ্ডিসনার চোখ ঝলসে গেল। চৈতন তার ওস্তাদ ছিল বলে কুসুমের দিকে আগে সরাসরি তাকায়নি। এমন মেয়্যাকে ছাড়্যে যে মরদ মশুরীর মতো ঢেপসি কদুকে নিয়ে গাঁ ছাড়ে তার জন্যে সনার দুকখুই হয়! এ সনসারে বেজন্মা সনার জন্যে কাঁদবার কেউ নেই বলেই সে অন্যের দুকখে হচরপচর করে মরে।
অনেক রাতে চাদরমুড়ি দিয়ে কুসুমের ঘরে এল মেঘু। কেরোসিনের ডিবি জ্বালয়ে আপেক্ষা করছিল কুসুম। মেঘু ঘরে ঢুকতেই সনা বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিল।
মিনিট দশেকের মধ্যেই কথাবার্তা শেষ হয়ে গেল। যেমন নি:শব্দে এসেছিল তেমনি নি:শব্দেই মেঘু ফিরে গেল। বুকের মধ্যে নিয়ে গেল একরাশ সুখ-সম্ভাবনা।
পরদিন আবার মিটিন বসলো বুঢ়াশিবের চাতালে। মেঘুই জনতাকে জানালো কুসুমের বয়স অল্প। স্বভাব চরিত্তিরও খারাপ নয়। চৈতনার মা ওর ঘাড়ে ভর করেছে বটে, তবে তাকে ছাড়ানোর পথও আছে ওঝার কাছে। মেঘুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সনাতন ওঝা বললো--
--স্বপুন দেখেছি গয়া যাঁয়ে চৈতনার মা'র পিণ্ডি দিলে বুড়ি কুসুমকে ছাড়্যে দিবেক।
ওঝা কুসুমের কাছে জানতে চাইলো যে সে গয়া যেতে রাজি আছে কিনা। নিস্তারের এর চেয়ে সহজ এবং গ্রহণযোগ্য পথ যে আর খোলা নেই এটা বুঝেই কুসুম বলে ওঠে--
--তুমরা বইলছ যখন যাবো। কিন্তু--
--উসব তকে ভাবতে হবেক নাই। মেঘু মোড়ল উয়ার বাপমায়ের পিণ্ডি দিবেক। আমিও এই মওকায় যাঁয়ে পিণ্ডি দিব। চাঁদু লাপিত, গদাই রসিক, লগেন মাহাতোও সনগে যাবেক--
--আমার সনগে সনাও তাইলে যাবেক--
কথাটা কুসুম বলেই ফেলে। মেঘু আর ওঝায় চোখাচোখি হল। শেষ পর্যন্ত ওঝা এবং মেঘু কুসুমের ইচ্ছে মেনেই নেয়।
মিটিনের বৃত্তান্ত শুনে নামোপাড়ার অহল্যা ছুটে এল কুসুমের কাছে। চৈতনার মায়ের অপঘাতের মৃত্যুর দায় চেপেছিল অহল্যার ঘাড়ে। অহল্যা তখন ভরখর যুয়ান। ঘরের মরদ সাপুড়েদের সনগে বন-বাদাড়ে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। যখন তখন মহুল গিলে যেখানে সেখানে বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকে। বাঁজা অহল্যার বেওয়ারিস যৈবনের দখল নিতে চেয়েছিল ফেতো লবাব মেঘু। সে তখনো মোড়ল হয়নি। লোকে বলে প্রথম পক্ষের বউয়ের গলায় পা দিয়ে মেঘু মেরে ফেলেছিল।
একদিন বাড়াবাড়ি রকমের উপদ্রব সহ্য করতে না পেরে হাটের মাঝেই বুকে লাথি মেরে মেঘুকে মাটিতে ফেলে মুখে থুথু ছিটিয়েছিল অহল্যা। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই চৈতনার মা জলে ডুবে মারা গেল। মাস না ঘুরতেই অহল্যার মরদও জঙ্গলের মধ্যে খরিশের ছোবলে প্রাণ হারালো। অতএব অহল্যাকে ডাহিন ঘোষণা করলো ওঝা। সমস্ত তেজ দেমাক ভুলে অহল্যা লুটিয়ে পড়লো মেঘুর পায়ের ওপর। চিরস্থায়ী ভোগদখলের গোপন শর্তে অহল্যাও গয়ায় যাবার বিধান পেয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল বটে--তবে গয়ায় সহায় সম্বলহীন অহল্যাকে একা পেয়ে মেঘু ইচ্ছে মতো ছিঁড়ে কামড়ে খেয়েছে ওকে। চিরস্থায়ী ভোগদখলের বন্দোবস্ত করে নিয়েছে অহল্যার শরীরটা। তাই ফিরে এসেও অহল্যা আজও মেঘু মোড়লের রাখনী। একথা আজ সবাই জানে।
অহল্যার বিত্তান্ত নিয়ে আবার সারারাত ভাবলো কুসুম আর ঝাণ্ডিসনা। কুসুমের মনে হল একদিকে জল তো অন্যদিকে আগুন। এ দু'য়ের মাঝামাঝি এমন কোনো উপায় নেই যাতে নিজের মতো করে বেঁচেবর্তে থাকা যায়। অনেক ভেবেও চালতাতোড় গ্রামে নিজের মতো করে বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পেলো না। হয় মেঘুর রাখনী হয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে, না হয় গ্রামের লোকের পাথর বৃষ্টিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরতে হবে!

শেষ পর্যন্ত শেষরাতে ধানের মরাইয়ের পিছনে টাঙানো ভারি তলোয়ারটা আর একটা পুঁটলি নিয়ে গ্রাম ছাড়লো কুসুম আর ঝাণ্ডিসনা। চৈতন আর মশুরীর মতো এরাও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এবারেও মেঘু মোড়লের মাথা হেঁট।
এর ঠিক মাসখানেক পরে মেঘু মোড়ল আর সনাতন ওঝার কবন্ধ দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল নদীর পারে আর বুঢ়াশিবের চাতালে। গোটা গ্রাম তোলপাড়। ছ'মাসের জন্যে পুলিস ক্যাম্প বসলো চালতাতোড় গ্রামে।

পরের মকর সংক্রান্তির সকালে গাঁয়ের তামাম লোক নদীর পারে নির্বাক হয়ে দেখছিল একটি মেয়ে ফুটফুটে এক ছেইল্যা কোলে হাঁটু জল ভেঙে নদী পেরিয়ে চালতাতোড় গ্রামের দিকেই আসছে। তার পরনে হলুদগাবা আলতাপার শাড়ি। কপালে জ্বলজ্বল করছে মেটে সিঁদুরের বড় টিপ। কাছাকাছি হতে সকলেই হৈ হৈ করে পার ভেঙে নেমে এল নদীতে।
--ই কি গো! তুই ত কুসুম বটিস! তর পেছে পেছে কে বঠে?
--উঠা সনা হে--ঝাণ্ডি সনা!
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×