somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাইনি বৃত্তান্ত (১)

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাঁউড়ির (পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত) রাত জেগে ছেলে-ছোকরারা যখন আগুন জ্বেলে হৈ হৈ করে ছড়া কেটে গান গেয়ে টুসুরাণীর চৌদল সাজাতে ব্যস্ত কুসুমের চোখে তখন না ঘুম না জাগরণের খুশি। সারারাত অন্ধকার দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে বসেই রাত কাবার করে দিল। আর-বছরে এই বাঁউড়ির রাতে আঙ্গিনায় গানের আসর বসিয়েছিল চৈতন। ঘরের মধ্যে পাড়া প্ড়শীদের বউ-ঝিদের নিয়ে টুসুরাণীর পাশে মাটির প্রদীপ আর কেরোসিনের ডিবি জ্বেলে কুসুম নিজেও কত গান গেয়েছিল। চৈতন তার বন্ধুদের নিয়ে মুখ লাল করা রসের গান গেয়ে গেয়ে আসর মাতিয়ে দিয়েছিল।
বাঁউড়ির হিমেল রাত এবারেও টুসুগানের সুরে মাতাল হয়ে উঠেছে। রঙ-বেরঙের গানের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে এ ঘর লে উ ঘর। শুধু কুসুমের আঙ্গিনাই আজ শুনশান। দেখতে দেখতে রাত শেষ হয়ে এল। পাড়া-ঘর ঝেঁটিয়ে বউ-ঝিরা সরা মাথায় চৌদল মাথায় টুসুরাণীর মূর্তি মাথায় দলে দলে বেরিয়ে পড়বে টুসুরাণীকে বিসর্জন দিতে। কুসুম শুনতে পাচ্ছিল বিসর্জনের গান--'আরে আরে বাজনাদারিয়া ঢাকে খাড়ি দে না রে--/ শেষ রাইতে কোকিল ডাকে রে,/ টুসু বিদায় দে না রে।'
রাত শেষ হয়ে মকর সংক্রান্তির সকাল শুরু হতেই মকর পরবের উত্সবে মেতে উঠবে গোটা গ্রাম। কুসুমই শুধু নদীতে মকর স্নানে যাবে না। গায়ে হলুদ মাখবে না। পায়ে আলতা দেবে না। রূপোর মল জোড়া আগেই খুলে রেখেছে। টিনের বাক্সে তুলে রেখেছে দু'হাতের চারগাছি করে আটগাছি রূপোর কাঁঠালকোষ চুড়িও। কুসুম আজ হলুদ গাবা আলতাপাড় শাড়িও পড়বে না। শাড়ির খুঁটে বাঁধবে না রূপোর খুঁট-চাবি। অনেকদিন চোখে কাজল পরে না। কপালেও পরে না মেটে সিঁদুরের বড় টিপ। এক সঙ্গে বেশ কয়েকটা মোরগ ডেকে উঠতেই নড়েচড়ে বসলো কুসুম।
চৈতন শেষপর্যন্ত মেঘু মোড়লের বউকে নিয়েই পালালো! গোটা গাঁ চৈতনের হিম্মত দেখে হাঁ হয়ে গেছে। মেঘু মোড়ল পঞ্চায়েতের প্রধান নয় বটে তবে চলতাতোড় গ্রামে সে-ই শেষ কথা। সই মেঘু মোড়লও কি করে যেন কানাকানি থেকে জেনে গিয়েছিল তার দ্বিতীয়পক্ষের বউ মশুরী নাকি মেলায় মেলায় চৈতনের সঙ্গে রঙ করে বেড়াচ্ছিল। ছাতাটাঁড়ের ছাতাপরবের মেলায়, বুধপুরের মেলায়, ইঁন্দকুড়ির ইঁন্দ গোস্বামীদের রাস, ডিমডিমার ভৈরববাবার মেলায়--এমন কী নাচনী কি ছো নাচের আসরেও মেঘুর বউ মশুরী আর চৈতনকে ঢলাঢলি করতে দেখা গেছে।
চৈতন মেলায় মেলায় ঝাণ্ডি পাতে। সে নিজে অবশ্য কখনো ডাব্বা বা মগ ধরে না। বড় বড় করে যত্নে আঁকা রঙিন ইস্কাপন-রুপিতন-হরতন শোভিত পাইলের কোণায় বসে শুধু দান গুটোয় আর দান মেটায়। ডাব্বার ভেতর ঘুঁটি খড়খড়িয়ে দান ফেলে সাগরেদ সনা। বাঁকুড়ার গাজদনের মেলা থেকে সনাকে তুলে এনেছে চৈতন। এ ব্যাপারে সনা বেশ ওস্তাদ। ঝাণ্ডির সঙ্গে সনার যেন রক্তের সম্পর্ক। লোকে তাই ওকে ঝাণ্ডিসনা বলেই ডাকে এবং চেনে।
এরমধ্যেই একদিন ধর্মের কল বাতাসে নড়ে গেল। মেঘু মোড়ল হাতে নাতে ধরে ফেললো চৈতন আর মশুরীকে খয়ের বনে। বড়উ আপত্তিকর অবস্থায়। চৈতনকে হিড় হিড় করে টানতে টানতে বুঢ়াশিবের চাতালে আনা হল। তারপর বেদম জুতো পেটা। মেঘুর জুতোর পেরেকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল চৈতন। স্তব্ধ কুসুম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চৈতনের উত্তম মধ্যম প্রত্যক্ষ করলো।
তিনচারদিন ঘরের বাইরে পা রাখেনি চৈতন। একটা কথাও কুসুম বলেনি। চৈতনও ছিল বেজায় চুপচাপ। এইভাবে প্রায় নি:স্তরঙ্গ কেটে গেল মাস দেড়েক। তারপরেই ঘটে গেল সেই অঘটন। গোটা গাঁ তোলপাড়। মেঘু মোড়লের যুয়ান বউ আর কুসুমের যুয়ান মরদ একসঙ্গে সর করে পালিয়েছে। কাছে দূরে তাদের কোনো হদিশই মিললো না! চৈতনের হিম্মতকে গাঁয়ের অনেকেই আড়ালে আবডালে বাহবা দিয়েছে। দুষেছে কুসুমকেই।
কুসুমের বয়সী সমস্ত বিবাহিতা অবিবাহিতা মেয়েদের চেয়ে কুসুমের শরীর স্বাস্থ্য অনেক ভালো। বিয়ের চার বছরের মধ্যে গোটা চারেক পুঁয়ে পাওয়া বাচ্চা না বিয়োনোর জন্যেই হয়তো তার ডাগরে-ডোগর শরীর লোকের চোখে বেঁধে। দু'হাতে দশভুজার মতো কুসুম গাছগাছালি লাগায়। ছাগল মুরগী চরায়। নদী-ঝোরা থেকে জল আনে। রান্না করে। কাঠকুঠো ডাঁই করে উঠোনে। এ সবের জন্যেই তার শরীর জুড়ে দুদ্দার যৌবন। তবু কেন সে চৈতনকে বেঁধে রাখতে পারলো না! আধবুঢ়া মেঘু মোড়লের বিছানায় ষোল বছরের মশুরী যদি বেশিদিন না ওঠে তবে তাকেও খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। অতএব কুসুমের মতো মেঘু মোড়লেরও মাথা হেঁট।
মশুরীর সঙ্গে চৈতনের গ্রাম ছাড়ার খবরটা নিয়ে এসেছিল ঝাণ্ডিসনা--
--হা বুঢ়া বাপ! ইকি সব্বোলাশ হঁয়্যে গেইল আ কুসুম! ইপর কুথায় দাঁড়াবে গো?
কুসুম প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। চিত্কার করে কাঁদতেও পারেনি। হঠাত্ই যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল। পাতা পড়ার শব্দ শুনেও প্রথম প্রথম চমকে উঠতো। এই বুঝি ফুলেল তেল বাস-সাবান কিংবা কাচের চুড়ি নিয়ে বাতাসে গতরের বাস ছড়িয়ে ঘরে ঢুকবে চৈতন। দেখতে দেখতে ছ'মাস কেটে গেল। চৈতন ফেরেনি। চৈতন জানে এর পর গাঁয়ে ফিরলে মেঘু তাকে দু'টুকরো করে কাঁসাই নদীতে পুঁতে ফেলবে।
কুসুমও অবশ্য চৈতনের ফেরার আশা করে না। ফিরলেও উয়ার সনগে ঘর করা যাবেক লাই। ওদিকে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে মেঘু মোড়ল মাঝে মাঝেই কুসুমের সামনে যমদূতের মতো উদয় হয়ে কুসুমকে তার ঘর সংসারের চাবিকাঠি খুঁটে বেঁধে দেবার বাসনা জানায়। মেঘুর জ্বালায় কুসুমের প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। পরিত্রাণের পথই খুঁজে পাচ্ছে না কুসুম।

'সুখে থেকো টুসুমণি গো ভুলনা আমা সবায়--/ বারোমাসের পরে টুসু, ফিরে এস পুনরায় / তবে হই বিদায় / সুখ সাগরের টুসুমণি গো সুখ সলিলে ভেসে যায় / টুসুমণির খেলার সাথী কাঁদছে নতীর কিনারায়--/ তবে হই বিদায়।‌'
দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল গানের সুর আর বিসর্জনের মিছিল। গোটা বাঁউড়িকুলি এখন ফাঁকা। মানুষের স্রোত চলেছে নদীর দিকে। টুসু বিসর্জনের সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীতের এই সকালে হাঁটু জলে স্নান করবে সবাই। মকর সংক্রান্তির স্নানে পুণ্যি হয়।
স্নানের কথা মনে হতেই উঠে পড়লো কুসুম।
অনেকক্ষণ ধরে দীঘিতে স্নান করলো কুসুম। অনেকদিন পরে হাত-পা ছুঁড়ে একটু সাঁতারও কাটলো। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। এক কলসী জল কাঁখে উঠে আসার মুখেই শরীর থেকে ঝরে যাওয়া অবসাদ মুহূর্তেই ফিরে এল। যমের মতো পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে মেঘু মোড়ল।
--আমি আর সময় দিতে লারবো কুসুম। তর শেষ কথাটা তকে আজই বুইলতে হবেক। হামার ঘরকে তুই যাবিস কি লাই?
মেঘুর বাঘের মতো চোখ দুটো কুসুমের আপাদমস্তক চেটে যাচ্ছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করার উদ্দেশ্য নিয়েই মেঘু এই নির্জনতার সুযোগ নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে একটু ভয় পেলেও ঝনকে ওঠে কুসুম--
--কুনজর দিও না মোড়ল। সরে যাও--
--কথাটুকু শোন কুসুম। দু'মুঠো ভাতের জইন্যে একটা ট্যানা কাপড়ের জইন্যে শরীরের সোহাগের জইন্যে লকের মুখ ভালতে (তাকাতে) হবেক নাই। গাঁয়ের কেউ আর তকে কুলকুলি দিবেক নাই। আমি তকে সাঙা করেই ঘরে লিব--
--মশুরী কেনে শরীরের সোহাগের জইন্যে ঘর ছাড়লো মোড়ল? কেমুন তুমি মরদ বঠে?
--উসব কথা ছাড়্যে দে কুসুম। তর ভাতারও তকে ছাড়্যে গেইলছে। তরই বা এত দেমাক কেনে? টুকু শোন কুসুম--যতই কেনে দেমাকের বিটি হ, বিটি ছেইল্যার ভাতার ছাড়া কুনো গতি লাই। লচরপচর ছাড়্যে হামার ঘরকে চল কুসুম--
--হামার সাফ কথা মোড়ল, নাই যাব তুমার ঘরকে। যার ঘর ছাড়্যে যুয়ান বউ পালায় তাকে আমি মরদ মানতে লারবো মোড়ল--
বারবার তার পৌরুষের প্রতি কুসুমের তীব্র কটাক্ষ মেঘুকে ভেতরে ভেতরে ভয়ঙ্করভাবে হিংস্র করে তুলছিল। ইচ্ছে করলে এই নির্জন দীঘির ঘাটেই মেঘু তার পুরুষত্বের প্রমাণ দিতে পারে। কিন্তু সে সব কিছু না করে দাঁতে দাঁত চেপে মেঘু বললো--
--জেবনটাকে লষ্ট করবি কুসুম! একদিন এই চালতাতোড় গাঁরে লক তকে পাথর ছুঁড়ে মাইরবেক। তখন বুঝবি মেঘু মোড়ল কেমন মরদ বঠে! বলে হন হন করে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল মেঘু।
(চলবে)
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×