পুরো তিন সপ্তাহ! বেশ লম্বা একটা সময়ের অপেক্ষা! আর এই অপেক্ষা আমার সবচে' ক্ষুদে সঙ্গীিটর জন্য ছিল বেশ কষ্টকর। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই একবার, স্কুল থেকে ফিরে এসে কয়েকবার আর ঘুমোতে যাবার আগে অবশ্যই আর একটি বার বারান্দায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে ভুল হয়না ওর। প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যে নিজে হাতে পানি দেয় আর বীজ লুকনো মাটি ভরা টবের দিকে তাকিয়ে বলে আসে: " vaer saa snill kom, kom ut naa tulipan. kansje dere kommer ut i mogen for meg, saant ja?"(প্লীইইইজ! এসো, এখন বেরিয়ে এসো টিউলিপেরা, হয়তো কালকেই তোমরা বেরিয়ে আসবে আমার জন্য, তাইনা?"----
একদিন সকালে সত্যিই বেরিয়ে এলো একটি আহ্লাদি টিউলিপ অংকুর। মহা খুশী। বাবা আর মেয়ের যৌথ আবিষ্কারে আমিও খুশীতে আটখানা। সকালের নরম রোদ এসে ছুঁয়ে দিলো আমাদের সোনামনির মিষ্টি গাল দু'টো। গৌরবে জ্বলজ্বল করছে ওর দু'টো বাদামী চোখের তারা, টবের মাটিতে টিউলিপের বীজগুলো নিজ হাতে লুকিয়ে রাখার সাফল্যে।
এভাবে একে একে ক'দিন পরপর চারটি অংকুরই বেরিয়ে এলো। জেনেছি, নিজের দেশের বাইরে গেলে বড্ড অভিমানী হয়ে যায় ওরা। চেনা মাটি-জল আর চেনা আলো-হাওয়ার বাইরে ওরা ততটা স্বতস্ফুর্ত নয়। এশিয়া ওদের ততটা আপন নয়। সঠিক তাপমাত্রা আর পরিচর্র্যা পেলে পত্র-পুষ্পের দেখা মিললেও মিলতে পারে, যদি তুমি ভাগ্যবান হও। ঠিক পেঁয়াজের মত দেখতে বীজগুলো কেনার সময় দোকানী বেশ জোর দিয়েই এই তথ্যগুলো জানিয়ে দিলেন। কি আশ্চর্য! এতো কিছুর সাথে আবার 'ভাগ্য' নামক বায়বীয় বিষয়টিও জড়িত? ঐ জিনিষটিতে আমার কোন আস্থা নেই। বাকীটুকুতো চেষ্টা করে দেখা যায়।
বিশাল বাজার। যেখানে কেবল টিউলিপেরই জায়গা। নানান প্রজাতির ও নানান রঙের টিউলিপের বীজ আর উদাহরণসহ কিছু অসাধরণ রঙের ফুলে দোকানগুলো সেজে রয়েছে। আর পুরো দোকান জুড়ে যেভাবে বীজ রাখা হয়েছে, দেখে পেঁয়াজের বাজার ভেবে ভুল হতে পারে। চোখে ঘোর লেগে গেল টবে ফুটে থাকা গাঢ় নীল রঙের টিউলিপ দেখে। মনে মনে দেখতে পাই স্বদেশে নিজের শখের ছোট্ট বাগানটায় লাল হলুদের সাথে অন্তত কয়েকটি নীল টিউলিপ ফুটে রয়েছে।
টিউলিপের দেশ নেদারল্যান্ড। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত মাঠের পর মাঠ, মাইলের পর মাইল টিউলিপের রঙে রঙে সেজে অপরূপ হয়ে ওঠে নেদারল্যান্ডের এ,কোন, ও,কোন। অসাধরণ সেই রূপ।
আরেকদফা অপেক্ষার পালা শুরু হলো। কবে অংকুরেরা পত্র-পল্লবে সবুজ হবে, এ,দেশের বসন্তে কতখানি খুশী হয়ে কবে প্রথম কলি ধরবে, কেমন করে ওরা লাল, হলুদ আর নীল হবে জানিনা। আমি আর আমার ছোট্ট সোনামণি ওদের অপেক্ষায় আছি, ভিষন আনন্দে আছি।