লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ১৯৩৪ সালের ১৩ জানুয়ারি বিকেলবেলা ক্ষুধার তাড়নায় গুলিস্তানের রাস্তায় বসে পথ চলতি মানুষের দিকে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কেদারনাথ, দিনটি তিনি ভোলেননি এজন্য যে আগের রাতে চট্টগ্রাম কারাগারে ব্রিটিশরা সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করেছিল; আর রাত পোহালেই শোকের গাঢ় মেঘের ছায়া পড়েছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিশেষে অধিকাংশ ভারতবাসীর মুখে, হৃদয়ে ঝড় উঠেছিল, চোখে বৃষ্টি নেমেছিল। সেই থেকে গত বারো বছর যাবৎ গুলিস্তানের রাস্তায় ভিক্ষা করছেন কেদারনাথ। কেদারনাথ ছাড়াও ফজলু, জুলেখা, তাইজাল ওরফে তাজু সহ আরও অনেকেই আছে রাস্তার এপাশে-ওপাশে। তবে তাদের চারজনের ভিক্ষাবৃত্তির স্থান কাছাকাছি এবং রাত্রিবাস একই জায়গায় হওয়ায় তাদের মধ্যে একধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তারা সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকে। ভিক্ষুকদের আবার সুখ! কথাটা উপহাসের মত শোনালেও সত্যিই কিন্তু ভিক্ষুকদের জীবনেও কখনও কখনও ক্ষুদ্র সুখের আবির্ভাব ঘটে। আর দুঃখ তো আপন শরীরের কাপড়ের মতো লেপ্টে থাকে।
চারজনের মধ্যে কেদারনাথ সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ্য। তার বয়স ষাটের ওপরে। তাই কেদারনাথ এই দলটির অলিখিত অবিভাবক। কেদারনাথের একটা পা হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটেন। শীর্ণ শরীরে জোরও তেমন নেই। তবু সবাই তাকে খুব মান্য করে তার কথাবার্তা, বুদ্ধিমত্তা এবং ব্যক্তিত্বের কারণে। তাছাড়া কেদারনাথ ভিক্ষাবৃত্তির বাইরের জগতের জ্ঞানও একটু-আধটু রাখেন। তাদের উল্টোদিকে রাস্তার পাশে পরিমলের খবরের কাগজের দোকানে গিয়ে খবর পড়ে আসেন প্রতিদিন সকালে। তারপর তার কাছ থেকে ফজলু, জুলেখা আর তাজু দেশের খবর শোনে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, বৃটিশ সরকারের মনোভাব, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আলাদা পাকিস্তান গড়ার প্রয়াস প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি তাদের কাছে ব্যাখ্যা করেন এবং তার ব্যক্তিগত মতামত রাখেন। কেদারনাথ গত বারো বছর যাবৎ এখানে আছেন। কিন্তু তার অতীত সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। তার বাড়ি কোথায় ছিল? পরিবার ছিল কি না? এসব কথা তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে তিনি চুপ করে থাকেন। বাববার জিজ্ঞাসা করলে চুপচাপ ক্র্যাচে ভর দিয়ে একদিকে হাঁটা দেন। আবার পরে ফিরে আসেন। এজন্য এখন আর কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে না।
চারজনের এই দলে কেদারনাথের পরের অবস্থান ফজলুর। ফজলুর দুই চোখ অন্ধ। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে। স্বাস্থ্য একসময়ে ভাল থাকলেও এখন খাদ্যাভাবে শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। আছে শুধু লম্বা লম্বা হাত-পা।
বয়স অনুসারে এর পরের অবস্থান জুলেখার হবার কথা থাকলেও তিনি নারী বলে হাবভাবে তাজু তাকে বুঝিয়ে দেয়, এই দলে তোমার চেয়ে আমার ক্ষমতা অনেক বেশি। জুলেখার বয়সও পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি এখানে আছেন চার-পাঁচ বছর। তার শুধু একটা চোখ নষ্ট আর কোনো সমস্যা নেই। স্বামী মারা যাবার পর ছেলেদের সংসারে লাথি-ঝাঁটা খেয়েও কিছুদিন ছিলেন। তারপর একদিন ছোট ছেলের বউ ঝগড়ার এক পর্যায়ে তার ভাতের থালায় লাথি মারলো। কেবল দু-মুঠো ভাত মুখে দিয়েছিলেন। সেই শেষ ভাত খাওয়া ছেলের বাড়িতে। তারপর নানা জায়গায় ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত এই ফুটপাতে তার ঠাঁই হয়েছে।
দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য তাজুর পা দুটো শুকিয়ে গেছে। একসময় তাজু কতো দৌড়াদৌড়ি, ছুটোছুটি, খেলাধুলা করেছে। এগারো বছর বয়সে তার পোলিও হয়। শুকিয়ে যায় পা দুটো। তাজুর বাবা ছিল রিক্সাচালক। মা বাসায় কাজ করতো। নৌকাডুবিতে যখন বাবা মারা যায় তখন তাজুর বয়স বারো বছর। কিছুদিন পর তার মা তাকে ফেলে চলে যায় আরেক পুরুষের সঙ্গে। সেই বয়স থেকেই সে নানা জায়গায় ভিক্ষা করতে শুরু করে। কখনও সদরঘাটে, কখনও শ্যামবাজারে-লক্ষ্মীবাজারে। এখানে এসেছে প্রায় আট-নয় বছর হলো। এখন তার বয়স প্রায় চল্লিশ।
কেদারনাথ কৃষ্ণভক্ত। প্রতিদিন ভোরে তিনি মালা জপ করেন। তারপর একটা ছোট্ট পুঁটলিতে মালাটা বেঁধে বড় ঝোলাটার মধ্যে রেখে দেন। তার কোনো সংস্কার নেই, সকলেই তার পুঁটলি ছোঁয়। আবার রোজার দিনে তিনি টুপি মাথায় দিয়ে ভিক্ষা করেন। তাতে ভিক্ষা বেশি পাওয়া যায়।
সকালে খবরের কাগজ পড়ে এসে কেদারনাথ খুঁটিতে হেলান দিয়ে কী যেন ভাবছেন আনমনে। কারো সাথে কোন কথা বলছেন না।
জুলেখা কাছে এসে বললেন, ‘ও ক্যাদারদা, তোমার কী অইচে ভাই?’
কেদারনাথ কোনো কথা বললেন না। ফজলু আর তাজুও কাছে এসে বসলো। তারাও হতবাক। কেদারনাথ তো এইভাবে বসে থাকেন না! সকালের খাবার খেয়ে যে যার জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু আজ হঠাৎ কেদারনাথের কী হলো? তাজু আর ফজলুও জিজ্ঞেস করলো তার মন খারাপের কারণ। অনেকক্ষণ পর কেদারনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দ্যাশ ভাগ আর ঠেকান যাইবো না। এই দ্যাশ ভাগ অইয়া হিন্দুস্থান আর পাকিস্থান নামে দুইডা দেশ অইবো। জিন্নাহসাব দেশ ভাঙার লাইগা উইঠা-পইড়া লাগছে। আর মনে অয় বেশি দেরি নাই। কোলকাতা আর বিহারের দাঙ্গার পর অহন নোয়াখালিতে দাঙ্গা অইতাছে। ঢাকায়ও কোথাও কোথাও দাঙ্গা লাইগা গেছে। এইহানকার হিন্দু বাবুরা সব পালাইয়া যাইতাছে পশ্চিমবঙ্গে, আর পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা আইতাছে এইহানে।’
তাজু বললো, ‘তাতে আমাগো কী? দ্যাশ ভাগ অইলেই কী আর না অইলেই কী? আমরা রাস্তার মানুষ, রাস্তায়-ই থাকুম। আমাগো অত ভাবনা দিয়া কাম কী?’
কেদারনাথের কথা যে সত্যি তা ফজলু, জুলেখা আর তাজু বুঝলো সেদিন বিকেলেই, যখন চাঁদ-তারা মার্কা পতাকা নিয়ে একদল মানুষ দুপুরে মিছিল করতে করতে নয়াবাজারের দিকে গেল। তাদের মুখে স্লোগান-‘নাড়াই তাকবীর/ আল্লাহু আকবর’, ‘পাকিস্তান/জিন্দাবাদ’, ‘হাত মে বিড়ি, মুখ মে পান/ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্থান’।
হঠাৎ করেই জুড়িগাড়ির সংখ্যা আর তাদের রোজগার কমে গেল। শ্যামবাজার, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজারের যে সব বাবুরা জুড়িগাড়িতে চড়ে এইদিক দিয়ে আসা-যাওয়া করতেন তাদের অনেককেই এখন আর দেখা যায় না। মানুষ কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। কিছু একটা যে হয়েছে তা বুঝতে পারে জুলেখা, ফজলু আর তাজু। এই দেশটা যে মুসলমানদের হয়ে যাচ্ছে তা অনুমান করতে পারে তারা। তাই জুলেখা মাঝেমাঝেই কেদারনাথকে সান্ত¡না দেয়, ‘অ কেদারদা, তুমি এতো ভাবতাছ ক্যান? তোমার কিছু অইবো না। তোমার তো আর বাড়ি-ঘর নাই।’
কেদারনাথ চুপ করে থাকেন। তিনি জানেন তার কিছু হবে না। কিন্তু তবুও তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। চোখের সামনে দিয়ে একে একে পরিচিত মানুষগুলো চলে যাচ্ছে। তাদের সাথে আর দেখা হবে না কোনোদিন। অনেক বাবু ছিল যারা বাড়ি ফেরার পথে কেদারনাথকে পয়সা দিয়ে যেতেন। আজ কয়েকদিন যাবৎ তাদেরকে দেখা যাচ্ছে না। এখন আর কেউ তাকে বলছেন না, ‘ও ক্যাদার বালা আচোনি?’
শীত আসি আসি করছে। একদিন খবরের কাগজ পড়ে কেদারনাথ জানতে পারলেন যে নোয়াখালীর দাঙ্গা বন্ধ করতে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে এসেছেন। নোয়াখালীর এম.এল.এ শ্রী হারান চৌধুরীর উদ্যোগের আয়োজিত প্রথম জনসভায় মহাত্মা গান্ধী বক্তৃতা করেছেন।
এরপর মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীর বিভিন্ন গ্রামে ঘুরেছেন, জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছেন, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ত্যাগ করে উন্মত্ত মানুষকে শান্তির পথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তারপর কেদারনাথ একদিন জানতে পারলেন যে নোয়াখালীর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ায় মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী থেকে চলে গেছেন। শীতের পর গ্রীষ্ম গেল, বর্ষা এলো। দেশভাগ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভারতবর্ষকে ভেঙে আলাদা দুটি রাষ্ট্র হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিয়ে বৃটিশরা ফিরে ফিরে যাবে নিজ দেশে।
সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাটে মানুষজন তেমন থাকে না। সবার মাঝেই আতঙ্ক, কখন না জানি দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়! আজ আবার কেদারনাথের পিঠের ব্যথাটা বেড়েছে। মনটাও ভাল না, চুপচাপ বসে আছেন। এমন সময় একটা জুড়িগাড়ি এসে দাঁড়ালো কেদারনাথের সামনে। সেদিকে তাকিয়েই তিনি চিনতে পারলেন, পল্টনের কাশীনাথ শিকদার। স্থুল দেহ নিয়ে শিকদার মশাই জুড়িগাড়ি থেকে নিচে নেমে এলেন। কেদারনাথের কাছে এসে বসে পড়লেন। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কেদারনাথও কেঁদে ফেললো। শিকাদার মশাই বললেন, ‘চইলা যাইতাছি রে ক্যাদার, জন্মের মতোন চইলা যাইতাছি এই মাটি ছাইড়া।
শিকদারমশাই কেদারনাথের হাতে একটি থলে দিয়ে বললেন, ‘এইডা রাখ তোর কাছে।’
ধুতির কোনা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ফজলুকে বললেন, ‘ওরে দেইখা রাখিস তোরা। ও বড় অভাগা।’
জুলেখা, ফজলু, তাজু সবাইকে দুটি করে টাকা দিলেন শিকদার মশাই। তারপর নিজের দোকান দুটির দিকে তাকিয়ে আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। জুড়িগাড়ির ভেতর থেকে শিকদার বাবুর ছেলে ডাকলেন, ‘বাবা তাড়াতাড়ি আসো।’
চোখ মুছতে মুছতে জুড়িগাড়িতে উঠলেন শিকদার মশাই। ঘোড়া দুটি সামনের দিকে পা বাড়ালো। যতোক্ষণ দেখা যায় সেদিকে তাকিয়ে রইলেন কেদারনাথ। চোখের আড়ালে চলে গেলে চোখ ফিরিয়ে শিকদার মশাইয়ের দোকান দুটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই দোকান দুটি ছিল শিকদার মশাইয়ের প্রাণ। বেচাকেনাও ছিল প্রচুর। কেদারনাথ এখানে আসার পর থেকেই দেখে আসছেন শিকদার মশাই প্রতিদিন সকাল-বিকাল দোকানে বসেন। তখন শিকদার মশাইয়ের বাবা বেঁচে ছিলেন। শিকদার মশাইয়ের ছেলের বিয়েতে সে কী ধুমধাম হয়েছিল! অনেক মানুষকে খাইয়েছিলেন। তিনি নিজেও গিয়েছিলেন নিমন্ত্রণ খেতে। পুরনো সব স্মৃতি একে একে কেদারনাথের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর আজ কোথায় চলে যাচ্ছেন মানুষগুলো, সাধের দোকান, বাড়ি-ঘর ফেলে!
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হলো কেদারনাথের। ঘুম থেকে উঠেই তার বুকে আরেকটা ধাক্কা লাগলো। রাস্তার ওপারে পরিমলের পত্রিকার দোকান এখনও খোলা হয়নি। চৌকিটা তাঁবু দিয়ে সেভাবেই ঢাকা পড়ে আছে যেভাবে কাল পরিমল রেখে গেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠাও বাড়তে লাগলো কেদারনাথের। তবে কি পরিমলও চলে গেল? বেলা বাড়লো কিন্তু পরিমলের আর দেখা মিললো না। কেদারনাথের মনে আর কোনো সন্দেহ রইলো না, পরিমলও চলে গেছে। আজ আর খবরের কাগজ পড়া হলো না, নতুন কোনো খবর জানা হলো না তার। বিষন্নভাবে কাটলো তার সারাটা দিন।
পরদিন সকালে চাঁদ-তারা মার্কা পতাকা নিয়ে বড় একটা মিছিল বের হলো। ‘পাকিস্তান/জিন্দাবাদ’ বলে মিছিল দিতে দিতে উল্লাসে মত্ত মানুষগুলো। তাজু মিছিলের একজনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাই কী অইছে?’
লোকটি বললো, ‘পাকিস্তান স্বাধীন অইচে। অহন শুধু মুসলমানরাই থাকবো এইহানে। আর হিন্দুরা চইলা যাইবো হিন্দুস্থানে।’
বলেই দৌড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল লোকটি। কেদারনাথ কাছেই বসে আছেন, লোকটার শেষ কথাটায় তার বুকটা মুচড়ে উঠলো।
দুদিন পরেই আফজাল, ছাদেক, মফিজুল, আনুসহ কয়েকজন ভিক্ষুক এলো কেদারনাথের কাছে। সবার মাথায় নতুন টুপি। গায়ে আতরের গন্ধ। তাদের মধ্যে আফজাল আর ছাদেক সবচেয়ে বড়। আফজাল বললো, ‘ক্যাদার তুমি এইহান থেইক্যা চইলা যাও।’
কেদারনাথ তো হতবাক। ফজলু, জুলেখা, তাজুরও একই অবস্থা। ফজলু বললো, ক্যাদারদা কই যাইবো?’
আফজাল বললো, ‘ক্যান, হিন্দুস্থানে যাইবো।’
কেদারনাথের চোখে জল, বাকরুদ্ধ। তবু অতি কষ্টে তিনি বললেন, ‘আমি ভিক্ষুক মানুষ। ভিক্ষা কইরা খাই। আমার আবার হিন্দুস্থান-পাকিস্থান কী! রাস্তায় থাকি। আমার কাছে হিন্দুস্থান-পাকিস্থান সবই সমান।’
ছাদেক বললো, ‘তা হোক, তাও তুমি হিন্দুস্থানেই চইলা যাও। সেই দ্যাশেও তো রাস্তা আছে। তুমি সেইহানে থাকবা। আমরা তোমারে এহানে থাকতে দিমু না। আমাগো হকে ভাগ বসাইতে দিমু না।’
জুলেখা বললো, ‘ইস, কইলেই অইলো! ক্যাদারদা তুমি যাবা না। এইহানেই থাকপা।’
ছাদেক জুলেখাকে ধমক দিলো, ‘চুপ কর মাগি। তুই কী বুঝস?’
জুলেখাও জ্বলে উঠলো, ‘গালি দিবা না কইতাছি। ভাল অইবো না।’
ছাদেক মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, ‘কী অইবো রে মাগি। কী অইবো? ক্যাদার তোর ভাতার লাগেনি, না রাইতের বেলা তোর সাথে শোয়! যে থাকতে কস?’
জুলেখাও খুুব নিন্মমানের অশ্লীল বাক্য নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল ছাদেকের কাছে। দুজনের মধ্যে হাতহাতি শুরু হবার মুহূর্তে অন্যরা এসে বাধা দিলো।
উত্তেজনা একটু কমে এলে আফজাল বললো, ‘দ্যাহ ক্যাদার, আমরা আমাগো রোজগারে তোমারে ভাগ বসাইতে দিমু না। তোমারে ভালয় ভালয় কইতাছি তুমি চইলা যাও। নইলে....।’
কেদার ধুতির কোনা দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। ফজলু, জুলেখা, তাজু প্রতিবাদ করেও কোন লাভ হলো না। অপরপক্ষের একটু কম বয়সী ভিক্ষুকরা পারলে কেদারনাথের গায়ে হাত তোলে। কেদারনাথ বুঝলেন অনুরোধ করে কোন লাভ হবে না। কিছু শিক্ষিত মানুষই যখন বুঝলো না; দেশটা ভাগ হলো, দাঙ্গা হলো, রক্তের বন্যা বইলো। আর এরা তো অক্ষর জ্ঞানহীন ভিক্ষুক!
ফজলু, জুলেখা, তাজুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন কেদারনাথ। গত তেরো বছর এই রাস্তা আর দোকানের মাঝখানের গলি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, থাকতে দিয়েছে। এখন কোথায় যাবেন তিনি?
তেরো বছর আগে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের কর্তা কেদারনাথ ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে একটা পা হারায়, যৌন ক্ষমতা হারায়। এরপর হারায় স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস। তবু সংসার আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন কেদারনাথ। কিন্তু অচিরেই সে বুঝতে পারেন, সন্তানদের কাছে বাবার সম্মান হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালবাসা। অক্ষম কেদারনাথ বুকভরা অভিমান নিয়ে সংসার ত্যাগ করে বরিশাল থেকে ঢাকার স্টীমারে উঠেছিলেন। আর কখনও ফিরে যাননি। এই রাস্তা আর দোকানের মাঝখানের গলিই হয়ে উঠেছিল তার বাড়ি।
সেই শিশুকাল থেকে কেদারনাথ জেনেছেন এটাই তার দেশ। বইয়ে পড়েছেন, ‘আমরা ভারতবর্ষে বাস করি।’ বরিশালের মাটিতে তার নাড়ি পোঁতা হয়েছে, এই অঞ্চলের আলো-হাওয়ায় তিনি বেড়ে উঠেছেন, এই মাটির ফসল খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন, এই মাটির কলিজার ভেতর থেকে তোলা জল পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। অথচ আজ শুনছেন এই মাটি তার আপন নয়, এটা তার দেশ নয়; তার দেশ হিন্দুস্থান! কেদারনাথের মনে পড়লো বিপ্লবীদের কথা। এই মাটির জন্য প্রাণ দিয়েছেন প্রফুল্ল চাকী, সূর্যসেন, তারকেশ্বর, প্রীতিলতারা; কতো হিন্দু বিপ্লবী বৃটিশের অত্যাচার সয়েছেন, আন্দামানে জেল খেটেছেন, এখনো জেল খাটছেন; অথচ এই মাটি নাকি এখন তাদের নয়! সূর্যসেনরা মরে বেঁচেছেন, নইলে তো তাদেরও এই এই দৃশ্য দেখতে হতো, এই আঘাত সইতে হতো! তাদেরও তো এখন তারই মতো খুঁজতে হতো হিন্দুস্থান! কোথায় হিন্দুস্থান? কতো দূরে হিন্দুস্থান? তিনি শুনেছেন যশোর, নদীয়া, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা ভাগ হয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু হয়েছে হিন্দুস্থান, তা জানেন না কেদারনাথ। শুধু জানেন এই দেশ তার নয়। তাকে যেতে হবে হিন্দুস্থানে। জন্মস্থান নয়, হিন্দুস্থান তার দেশ!
শান্তিবাগ, ঢাকা।
২০০৭