somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফরাসী নব তরঙ্গ: চলচ্চিত্রে নতুন ভঙ্গি

২৭ শে জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলা ভাষায় যা নব তরঙ্গ, ফরাসী ভাষায় তা লা ন্যুভেল ভ্যাগ। এই তরঙ্গের উৎপত্তিস্থল ফ্রান্সের চলচ্চিত্র জগৎ। ফ্রান্সের সেই রূপালী জগৎ যদি হয় পুকুর, তবে সেই পুকুরে ঢিল ছোঁড়েন কয়েকজন দারুণ প্রতিভাবান তরুণ। এঁরাই পরে স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তরঙ্গটি সরবে বিস্তৃত হয় ১৯৫০ ইঙ্গাব্দের শেষের দিকে এবং সেই অ-পূর্ব তরঙ্গ থিতু হয়ে আসে ষাটের দশকে। যদিও এ তরঙ্গ বা আন্দোলন গোছানো কিছু ছিল না, বা খুব যে পরিকল্পনা করে, ছক বেঁধে, সাংগঠনিক উপায়ে এ আন্দোলনের যাত্রা শুরু, তাও নয়। তারপরও কোথায় যেন একটা ল্য বাঁধা ছিল। নতুন কিছু একটা করার তাগিদ ছিল এ আন্দোলনে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুরু করে সামাজিক দায়বদ্ধতা, ব্যক্তির সম্পর্ককে কেন্দ্র করে মানবের সম্পর্ককে হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন এবং দর্শনের বার্তা, সাধারণের আবরণে ঢেকে নতুন কৌশলে চলচ্চিত্রায়ন করাই হয়ে উঠেছিল এ সময়কার নব তরঙ্গের প্রত্যেকটি ঢেউয়ের গুণগত বৈশিষ্ট্য।

নব তরঙ্গের শুরুটা হয়েছিল একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা থেকে। পত্রিকার নাম ছিল ‘কাঁহিয়ে দু সিনেমা’। কয়েকজন খ্যাপাটে তরুণ, যারা নতুন ধরণের চলচ্চিত্র করার স্বপ্ন পুষতেন মনের গহীনে, তাঁরাই লিখতেন এই পত্রিকায়। লেখায় তীব্র সমালোচনা করা হতো ফরাসী ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের। যেসব চলচ্চিত্রে থাকত উপন্যাসের সোঁদা গন্ধ। তরুণরা বললেন, না, চলচ্চিত্রের থাকবে নিজস্ব রূপ-রস-সৌরভ। চলচ্চিত্রের থাকবে একান্ত ভাষা। যে ভাষা দিয়ে সে প্রকাশ করবে অনেক গুঢ় তত্ত্ব, খুলে দেবে ব্যক্তি-মননের বন্ধ দরজা। কিন্তু এভাবে শুধু পত্রিকায় লিখে কতদিন! বানাতে হবে চলচ্চিত্র। ভাঙতে হবে পুরাতন মূরতী। হাতে কলমে দেখিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না সেই তরুণদের সামনে। তাই, তৈরী হতে থাকল নব তরঙ্গের নতুন চলচ্চিত্র।

সুমন্ত্রণাদাতা হলেন আঁদ্রে বাজাঁ। তাঁর সাথে গাটছড়া বাঁধেন ফ্রাসো ত্রুফো, জাঁ-লুক গদার, এরিক রোহমার, কদ শেব্রল, জ্যাক রিভেট প্রমুখ। তাঁরাই প্রথম ‘কাঁহিয়ে দু সিনেমা’ পত্রিকাতে চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ এবং সমালোচনা লিখতে শুরু করেন। লিখতে লিখতে একসময় তাঁরা চর্চিত তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দিতে নেমে পড়েন ক্যামেরা নিয়ে। তৈরী করেন ক্যামেরা দিয়ে লেখা ক্যামেরার উপন্যাস।

নব তরঙ্গে যেসব চলচ্চিত্র তীরে এসে ভিড় করে, তাদের রয়েছে কিছু সাধারণ চরিত্র। চলচ্চিত্র নির্মাতারা এটা করেছেন সচেতনভাবেই, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। যেমন:
*দীর্ঘ ট্র্যাক এবং প্যান শট ব্যবহার
*শট নেয়ার সময় ১৮০ ডিগ্রীর অক্ষকে উপেক্ষা করা
*জাম্প কাট ব্যবহার
*দৃশ্যের দ্রুত পরিবর্তন
*প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার
*ম্যাক-আপ ছাড়া শুটিং
*ক্যামেরা নিয়ে চরিত্রকে অনুসরণ করা
*চরিত্রকে দিয়ে মুখস্ত সংলাপ না বলানো
*গল্পের পুরো প্লটে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি
*একটি চরিত্র নির্ভর চলচ্চিত্রায়ন

এবং এরকম ছোটো-খাটো অনেক কিছু।

ফ্রাসো ত্র“ফো’র চলচ্চিত্র ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লো’ (১৯৫৯)-তে রয়েছে দীর্ঘ ট্র্যাক শট। সিনেমার শেষে ছেলেটি যখন দৌড়ে সাগরের কাছে চলে আসে, তখন সেই দৌড়ানোর দৃশ্যে ব্যবহার করা হয় দীর্ঘতম এই ট্র্যাক শটটি। সিনেমাতে এসময় দেখা যায়, নানা যন্ত্রণায় অসহ্য হয়ে কিশোর ছেলেটি সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে পালাতে চায়। কিন্তু শেষমেষ এসে সে দেখে আর দৌড়ানোর জায়গা নেই। চারিদিকে থৈথৈ পানি, বিস্তৃত সাগর। আর কোথাও যাবার পথ খোলা নেই। পালিয়ে কে-কোথায়-কবে বাঁচতে পেরেছে? নিঃসন্দেহে সিনেমা এখানে দর্শন আওড়ায়। বিশেষ করে একেবারে শেষে কিশোর ছেলেটির কোজ শটে যখন ফ্রেম স্থির করে দেয়া হয়, দর্শন তখন মূর্তমান হয় দর্শকের দর্শনে। ত্রুফোর ‘জুলে এন্ড জিম’ (১৯৬১)-এর মধ্যেও ট্র্যাক শট দেখা যায়। যখন সিনেমার তিন প্রধান চরিত্র একটি ব্রিজের উপর দিয়ে দৌঁড়াতে থাকেন।
জাঁ-লুক গদার তাঁর ‘লে উইকেন্ড’ (১৯৬০)-এ ব্যবহার করেন ট্রাফিক জামের সাত মিনিটের একটি ট্র্যাক শট। একই ছবিতে গদার ভেঙে ফেলতে চাইলেন “বাস্তবতা” তৈরীর সমস্ত প্রচেষ্টা। কারণ সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা গেল লিউদ রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে বলতে পথ হেঁটে চলেছেন। “দু ত্রোয়া সোসেস কি জসদেল” (১৯৬৬) সিনেমাতে গদার ষাটের দশকে ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ দিলেন। দেখালেন কীভাবে বিরোধীতার নামে দ্য গল সরকার আরো বেশী করে ফ্রান্সে পুঁজিবাদকে প্রচ্ছন্নভাবে উসকে দিচ্ছে। জাঁ-লুক গদার এভাবে, তাঁর অধিকাংশ সিনেমাতেই কাহিনীর আদলে রচনা করেছেন প্রবন্ধ।
এমনি করেই নতুন কৌশল ও কাহিনী বিন্যাসে অভিনব আঙ্গিক নির্মান ক'রে নব তরঙ্গের নির্মাতারা সাড়া জাগাতে থাকেন চলচ্চিত্র জগতে।

নব তরঙ্গ অনুপ্রাণিত হয়েছিল ১৯৪০ ইঙ্গাব্দে ইতালিতে হয়ে যাওয়া নব বাস্তববাদ আন্দোলনের দ্বারা। তারপর ১৯৫৮ এর দিকে তরঙ্গ তুলে তা শান্ত হতে থাকে ১৯৬৪ এর দিকে। তবে তরঙ্গের শেষ ঢেউ দেখা যায় ১৯৭৪ সালেও। এই নব তরঙ্গ এমনই তরঙ্গ তুলেছিল সেসময় যে চার্লস চ্যাপলিন, আলফ্রেড হিচককদের মতন খ্যাতিমানদেরও চলচ্চিত্র নির্মানের ক্ষেত্রে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। এবং বলা বাহুল্য নয়, সেসব কড়া সমালোচনা করেছিলেন নব তরঙ্গবাদীরা।

(ইতালির নয়া বাস্তববাদ আন্দোলনের ইতিহাস আরেকদিন হবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ১২:০৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×