somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মূলধারা '৭১।। হতাশার আবহাওয়ার মাঝেই ট্রেনিং কার্যক্রম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

২১ শে জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এহেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্হিতিতে অন্তহীন শরণার্থীর স্রোত ভারতের জন্য সৃষ্টি করে এক কঠিন বাধ্য-বাধ্যকতা। শরণার্থীসৃষ্ট এই বাধ্যবাধকতার ফলে বাংলাদেশের বিপর্যস্ত মুক্তিবাহিনীকে নতুন ভিত্তিতে এবং বর্ধিত কলেবরে গড়ে তোলার অসামান্য সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সঙ্কটের উপযুক্ত সমাধান অন্বেষণকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ সংগ্রাম যাতে সম্পূর্ণভাবে না থেমে যায়, এ মর্মে ন্যূনতম ব্যবস্হা হিসাবে ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং দানের প্রয়োজন ভারতের কর্তৃপক্ষমহলে স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ৩০শে এপ্রিল। ৯ই মে তাদের হাতে ন্যস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানেচ্ছু বাংলাদেশের তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিংদানের দায়িত্ব। এপ্রিল মাসে ভারতের ‘সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী’ (বিএসএফ) বিক্ষিপ্তভাবে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে যে অল্প স্বল্প সাহায্য করে চলেছিল তার উন্নতি ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত চার সপ্তাহ মেয়াদী এই ট্রেনিং কার্যক্রমের মান অবশ্য ছিল নেহাতই সাধারণ-মূলত শেখানো হত সাধারণ হাল্কা-অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয় দু’হাজার ছাত্র ও যুবকের প্রথম দলের ট্রেনিং।

অন্য অর্থে মে ছিল নিদারুণ হতাশার মাস। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অভিযানের মুখে মার্চ-এপ্রিলের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ সংগ্রাম ক্রমশ থেমে যাওয়ায় দেশের ভিতরে ও বাইরে সর্বত্রই নিরুৎসাহের ভাব। মধুপুর, গোপালগঞ্জ এবং আরও দু’একটা ছোটখাট অঞ্চল বাদে গোটা বাংলাদেশ পাকিস্তানী সেনাদের করতলগত। দেশের অভ্যন্তরে সর্বত্রই সামরিক সন্ত্রাস। তাদের সহযোগী দক্ষিণপন্হী রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগে গঠিত ‘শান্তি কমিটির’ তৎপরতার ফলে স্বাধীনতা-সমর্থক সবার পক্ষেই নিরাপদে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। যে সব বিদ্রোহী সেনা পাকিস্তানী আক্রমণের মুখে স্বজন-পরিজন ফেলে ভারতে এসেছিল অস্ত্রশস্ত্রের আশায়, তারাও প্রত্যাশিত পাল্টা-অভিযান শুরু করতে পারলো না বাস্তব নানা অসুবিধার ফলে। গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র যা পাওয়া গেল তা প্রয়োজন ও প্রত্যাশার তুলনায় নিত্যন্ত কম। তদুপরি দেশের ভিতর থেকে দখলদার সেনাবাহিনীর ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধির সংবাদে মনোবল বজায় রাখা ছিল সত্যই কঠিন। তবু মে-জুনের এই হতাশার আবহাওয়ার মাঝেই ট্রেনিং কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত প্রস্তুতি।

তরুণদের ট্রেনিং দেওয়যার ব্যাপারে অবশ্য ভারতীয় প্রশাসনের সকল অংশের সমান উৎসাহ ছিল না। যেমন ট্রেনিং প্রদান এবং বিশেষত ‘এই সব বিদ্রোহী ও বামপন্হীদের’ হাতে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের আপত্তি প্রথম দিকে ছিল অতিশয় প্রবল।৩৫ এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, নক্সালবাদী, নাগা, মিজো প্রভৃতি সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তৎপরতা-হেতু পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে এদের উদ্বেগ। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্র এই সব সন্ত্রাসবাদী বা বিদ্রোহীদের হাতে যে পৌঁছবে না, এ নিশ্চয়তাবোধ গড়ে তুলতে বেশ কিছু সময় লাগে। মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং-এর ব্যাপারে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাতে এই নিশ্চয়তাবোধ ক্রমে গড়ে ওঠে।প্রথম দিকে রিক্রুটিং সীমাবদ্ধ ছিল কেবল আওয়ামী লীগ দলীয় যুবকদের মধ্যে। পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এ ব্যবস্হা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীরও মনঃপূত। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আগ্রহীদের বিরাট সংখ্যার অনুপাতে ট্রেনিং-এর সুযোগ ছিল নিতান্ত কম। ট্রেনিং-এর আগে পর্যন্ত তরুণদের একত্রিত রাখা এবং তাদের মনোবল ও দৈহিক সুস্হতা বজায় রাখার জন্য সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ‘যুব শিবির’ ও ‘অভ্যর্থনা শিবির’ স্হাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সব শিবিরে ভর্তি করার জন্য যে স্ক্রীনিং পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, তদনুযায়ী ‘বহির্দেশীয় আনুগত্য’ (Extra Territorial Loyalty) থেকে যারা মুক্ত, কেবল সে সব তরুণরাই আওয়ামী পরিষদ সদস্যদের দ্বারা সনাক্তকৃত হবার পর ভর্তির অনুমতি পেত।৩৬ পাকিস্তানী রাজনৈতিক পুলিশের এই বহুল ব্যবহৃত শব্দ ধার করে এমন ব্যবস্হা খাড়া করা হয় যাতে এই সব শিবিরে বামপন্হী কর্মীদের প্রবেশের কোন সুযোগ না ঘটে।

বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের নিজস্ব ব্যবস্হাপনা ছাড়াও, প্রত্যেক যুব শিবিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদমর্যাদাবিশিষ্ট একজন ‘ক্যাম্প প্রশাসক’ নিযুক্ত থাকার ব্যবস্হা ছিল।৩৭ সম্ভবত এই ‘ক্যাম্প প্রশাসকের’ উপস্হিতির ফলে ট্রেনিং-এর জন্য বাছাই করা তরুণদের রাজনৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে ভারতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের মানসিক দুশ্চিন্তা বহুলাংশে হ্রাস পেত। অবশ্য পরে, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে, সামগ্রিক সমস্যার চাপে ভারত সরকারের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যখন দক্ষিণপন্হীদের প্রভাব হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার মধ্যে তাজউদ্দিনের অবস্হান অপেক্ষাকৃত সবল হয়, তখন বাংলাদেশের বামপন্হী তরুণদের বিরুদ্ধে এই বিধি-নিষেধ বহুলাংশে অপসারণ করা হয়। জন-সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগের তুলনামূলক বিরাটত্বের দরুন মুক্তিবাহিনীতেও আওয়ামী লীগপন্হীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঘটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এবং দলীয় পক্ষপাতিত্বের ভিত্তিতে রিক্রুটিং করা হয়, তা কেবল অনাবশ্যকই ছিল না, অধিকন্তু তা দুই ধরনের অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

প্রথমত, মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং-এর ব্যাপারে পরিষদ সদস্যদের সুপারিশ করার যে বিধান ছিল, অনেক ক্ষেত্রে সেই সুপারিশের অপব্যবহার ঘটতে দেখা গেছে। এঁদের অনেকে স্হানীয় রাজনীতির সুবিধার্থে অধিক সংখ্যায় কেবল নিজ নিজ এলাকার তরুণদের মুক্তিবাহিনীতে ঢোকাবার প্রবণতা দেখাতেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীর দৈহিক যোগ্যতা, সংগ্রামী স্পৃহা এবং চারিত্রিক গুণাগুণ শিথিলভাবে বিচার করা হয়েছে। অংশত এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহত্তর অংশ পরবর্তীকালে লড়াই থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে থাকে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ অপেক্ষা গ্রামীণ বিবাগ ও ব্যক্তিগত রেষারেষির নিষ্পত্তিতে, এমনকি সরাসরি লুটতরাজে অংশগ্রহণ করে।৩৮

দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানেচ্ছু অপর নানা দল ও মতের ছাত্র-যুবকদের জন্য রিক্রুটিং-এর ব্যাপারে আওয়ামী লীগের একাধিপত্য ছিল প্রবল ক্ষোভ ও হতাশার কারণ। দেশের ভিতরে পাকিস্তানী নির্যাতন যতই গ্রাম-গ্রামান্তরে বিশেষভাবে তরুণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে, ততই প্রতিদিন হাজার হাজার ছাত্র-যুবক ট্রেনিং লাভের আশায় ভারতে এসে ভিড় করেছে, মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছে সাধারণ শরণার্থী শিবিরে অথবা সরকার অননুমোদিত ক্যাম্পের অবর্ণনীয় দুর্দশার পরিবেশে। মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞের মুখে বিভিন্ন দল, মত ও শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপক্ষে এক স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযোদ্ধা মনোনয়ন ও ট্রেনিং-এর ক্ষেত্রে প্রদর্শিত বৈষম্য তরুণদের সেই একতাবোধকে বহুলাংশে বিনষ্ট করে। সেপ্টেম্বরে রিক্রুটিং-এর ক্ষেত্রে দলীয় বৈষম্যের নীতি অনেকখানি হ্রাস পেলেও মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যায়ে অবিশ্বাস, রেষারেষি ও দ্বন্দ্বের জের মূলত চলতেই থাকে।

ট্রেনিং-এর ক্ষেত্রে সঙ্কীর্ণ দলীয় একাধিপত্যের নীতি প্রথম থেকেই ছিল তাজউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত রাজনৈতিক পরিকল্পনার পরিপন্হী। ১০ই এপ্রিলের বেতার বক্তৃতায় তাজউদ্দিন ‘আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে যোগ দেবার জন্য বিশেষভাবে সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকে আমন্ত্রণ’ জানান। তাজউদ্দিনের ইচ্ছা ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের সমবায়ে মন্ত্রিসভা গঠনের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সরকারকে সমর্থনদানকারী সব ক’টি রাজনৈতিক দলের সমবায়ে একটি মোর্চা বা ফ্রন্ট গঠন করা এবং দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয়ের দায়িত্ব এই ফ্রন্টের হাতে অর্পণ করা।

পূর্ব বাংলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবী দুই দশকের পুরাতন এবং এই দাবীর জনপ্রিয়তা ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬-দফা দাবীর পক্ষে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনী রায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে সাধারণ জনমতকে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী স্বল্প দিনের। মূলত নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর আকস্মিক হামলা, নির্বিচার হত্যা ও তুলনাহীন বর্বরতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে স্বাধীনতার দাবী রাতারাতি সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতা দাবীর অন্তর্নিহিত এই নেতিবাচক ও তাৎক্ষণিক উপাদান সম্পর্কে তাজউদ্দিন সজাগ ছিলেন। এ কারণেই তিনি এই ঘটনা তাড়িত স্বাধীনতার দাবীকে ইতিবাচক ও স্হিতিশীল চেতনায় পরিণত করার জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্যান্য দল ও মতের মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন। মে মাসে প্রতিরোধ সংগ্রামের বিপর্যয়ের পর যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাংলাদেশে পাকিস্তানী আধিপত্য সহজে বা শীঘ্রই শেষ হবার নয়, তখন তিনি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসাবে আওয়ামী লীগ, মোজাফ্‌ফর আহমদ পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, মণি সিংহ-এর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস দল এবং সম্ভব হলে ভাসানীপন্হী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে একটি রাজনৈতিক ফ্রন্টে একত্রিত করার বিষয়ে চিন্তা করেন। এই ফ্রন্ট গঠনের চিন্তা ছিল আওয়ামী লীগ কর্তৃক গঠিত সরকারের কোন পরিবর্তন বা তাঁদের ক্ষমতা ও অধিকারের পরিসরকে সঙ্কুচিত না করেই।

কিন্তু আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ও কর্মী ছিলেন এরূপ বহুদলীয় ফ্রন্ট গঠনের বিরুদ্ধে। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ দলীয় সাফল্যের পর স্বভাবতই আওয়ামী লীগের সর্বস্তরে দলীয় শক্তিমত্তা সম্পর্কে প্রবল আস্হা সৃষ্টি হয়। তাদের সেই আস্হাবোধ পাকিস্তানী বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণ এবং নিজেদের সম্যক পশ্চাদপসরণের পরেও অক্ষুণ্ন থাকে। ২৬শে মার্চের পর দেশে যে সম্পূর্ণ নতুন পরিস্হিতির উদ্ভব ঘটে, তার পূর্ণ তাৎপর্য অনুধাবন করা এবং সেই পরিস্হিতি মোকাবিলার জন্য নিরেট দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপদ্ধতির পরিবর্তন সাধন করার প্রয়োজন আওয়ামী লীগের খুব অল্প সংখ্যক নেতার কাছেই স্পষ্ট ছিল। যাঁদের ছিল তাঁরা সম্মিলিতভাবেও দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। তাজউদ্দিন যে পারতেন না সে কথা তাঁর নিজেরও জানা ছিল। ইতিপূর্বে দলের নীতি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যদিও তাঁর স্হান ছিল সুউচ্চে, তবু দলের কাছে সেই নীতিকে গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে তাঁর নিজের ভূমিকা ছিল সীমিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হত পরিকল্পিত নীতি সম্পর্কে শেখ মুজিবের সম্মতি আদায় করেই। শেখ মুজিবের দায়িত্ব ছিল প্রস্তাবিত নীতি সম্পর্কে দলের এবং দেশবাসীর সম্মতি আদায় করার। সেই জনপ্রিয় নেতার অনুপস্হিতিতে বহুদলীয় ফ্রন্ট গঠনের মত এক ঘোরতর অপ্রিয় প্রস্তাব সেই পর্যায়েই পার্টির কাছে উত্থাপন করা তাজউদ্দিনের জন্য অন্তত দুরূহ ছিল। কাজেই সেই পর্যায়ে বহুদলীয় ফ্রন্ট গঠনের প্রাথমিক প্রস্তুতি অতিশয় ধৈর্যের সঙ্গে চালিয়ে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হয়।

মে মাসে এমনিতেই প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ মহলে তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা শুরু হয়েছে। মন্ত্রিসভার অবশিষ্ট তিনজন সদস্যই প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ নিয়ে স্ব স্ব দাবীর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় কমবেশী তৎপর। মন্ত্রিসভার বাইরেও তাজউদ্দিন বিরোধী প্রচারণার উৎসমুখ একাধিক। শেখ মুজিবের গ্রেফতার হওয়ার কারণ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানে ভারত সরকারের বিলম্ব পর্যন্ত অনেক কিছুর জন্যই সরাসরি তাজউদ্দিনকে দায়ী করে এক প্রবল প্রচার-আন্দোলন চলতে থাকে আওয়ামী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে। প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ ‘স্বাধীনতা ঘোষণা আদেশ’ অনুযায়ী অস্হায়ী রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা কিভাবে প্রয়োগ করে তাজউদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়, তা অন্বেষণে ব্যস্ত। কোলকাতায় অনেক আওয়ামী লীগ নেতারই গড়ে উঠেছে ছোটখাট দফতর, উপদলীয় গ্রুপ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, গাড়ী, অর্থ এবং প্রচারযন্ত্র। সবাই যে যার মত ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ব্যস্ত। কিন্তু প্রায় সর্বত্রই দেখা যেত দুটি জিনিসের অভাব - দলীয় শৃঙ্খলাবোধ এবং নতুন সরকারের প্রতি প্রয়োজনীয় আনুগত্যের।

এই শৃঙ্খলাহীন পরিবেশে তাজউদ্দিন অনন্য নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারের নির্দলীয় প্রশাসন বিভাগ ও সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠিত করেন। ফলে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আত্মকলহ ও উপদলীয় বিশৃঙ্খলতায় সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হওয়ার আগেই নতুন প্রশাসনের কর্মনিষ্ঠার ফলে সরকারের কাজকর্মে কিছু পরিমাণ সংগঠিত চিন্তা, সুস্হ কর্মপদ্ধতি ও শৃঙ্খলাবোধ প্রবর্তিত হয়। যে সব তরুণ সিএসপি ও অন্যান্য অফিসার প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে ভারতে চলে আসেন, তাঁদের নিয়োগ করার ব্যাপারে মন্ত্রিসভার সকল সদস্যেরই উৎসাহ ছিল বাহ্যত সমান। কিন্তু প্রশাসন বিভাগে ‘অফিসার প্রাধান্য প্রতিরোধ’ করার জন্য আমলাদের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের নিয়োগ করার দাবী মাঝে মাঝে যখন প্রবল হয়ে উঠত, তখন সেই সব দাবী নিবৃত্ত করার দায়দায়িত্ব নিতে হত মূলত তাজউদ্দিনকেই। ফলে দোষারোপের দায়ভার বেশীর ভাগই ছিল তাঁর একার। ২রা জুন নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের সমবায়ে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি আঞ্চলিক প্রশাসন কাউন্সিল গঠন করার পর ক্রমে ক্রমে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের অপেক্ষাকৃত গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করার সুযোগ গড়ে ওঠে।৩৯ জুলাই-এর শেষ দিকে এই আঞ্চলিক কাউন্সিল ব্যবস্হা আরও কিছু সংহত রূপ লাভ করে।৪০

প্রশাসন বিভাগের পাশাপাশি দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ক্ষয়িত ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর লোকজনদের একত্রিত করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (জুলাই থেকে ‘নিয়মিত বাহিনী’ নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অবঃ) ওসমানী ছিলেন সামরিক ব্যাপারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরোধী। যদিও মুক্তিযুদ্ধ মূলতই রাজনৈতিক যুদ্ধ, তবুও ওসমানী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই সেনাবাহিনী সংগঠন ও পরিচালনার পূর্ণ সুযোগ পান। প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দিনের দৃঢ় সমর্থন ব্যতিরেকে বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডার এবং রাজনৈতিক মহল উভয় দিকের বিরোধিতার ফলে ওসমানী সম্ভবত অসমর্থ হয়ে পড়তেন। নিয়মিত বাহিনী ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে অনিয়মিত লড়াই চালাবার জন্য যে মুক্তিবাহিনী গঠনের প্রস্তুতি চলছিল তার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার বিষয়টি অবশ্য তখনও বেশ অনির্দিষ্ট রয়ে যায়।

বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক ও সামরিক কাঠামো সংগঠিত করার পাশাপাশি সর্বাধিক সংখ্যক সশস্ত্র স্বেচ্ছা-সংগ্রামীকে দেশের ভিতরে পাঠানোকেই তাজউদ্দিন সব চাইতে বড় কাজ হিসাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু এই অনিয়মিত লড়াইয়ের জন্য সারা দেশে দু’তিনটি এলাকা বাদে না ছিল কোন নিরাপদ গোপন ঘাঁটি, না ছিল ন্যূনতম রাজনৈতিক সংগঠন। স্বাধীনতা সমর্থক রাজনৈতিক কর্মীরা সকলেই প্রায় দেশের বাইরে। রাজনৈতিক অবকাঠামোর অভাবে গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধ সম্ভব নয়। এই অবস্হায় সুসংগঠিত গেরিলা যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করার পরিবর্তে কমান্ডো ধরনের অনিয়মিত আক্রমণে শত্রুপক্ষের কিছু ক্ষয়ক্ষতি সাধনই কেবল সম্ভব ছিল। অথচ বাংলাদেশের নিজস্ব শক্তিতে স্বাধীনতাযুদ্ধ সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধের।

৩৫ লে. জেনারেল. বি. এম সরকার, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ।
৩৬ যুব শিবির-সংক্রান্ত দলিল। এই মূলনীতি প্রণয়ন করেন যুব শিবির স্কীমের ‘বোর্ড অব কন্ট্রোলের’ মেম্বার-সেক্রেটারী মাহবুব আলম চাষী।
৩৭ মূল দলিল।
৩৮ পরিশিষ্ট গ দ্রষ্টব্য।
৩৯ প্রায় নৈরাজ্য থেকে তুলনামূলক শৃঙ্খলায় উত্তরণের এই কাজটি যে সহজে ও বিনাবিতর্কে সম্পন্ন হয়নি, তা পরিশিষ্ট ঘ(view in text format /view pdf) থেকেও খানিকটা অনুমান করা চলে। Back to
৪০ পরিশিষ্ট ঙ (view in text format / view pdf) দ্রষ্টব্য। Back to main text

আগের পর্ব: Click This Link
১১টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×