somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুশের ‘ঘৃণ্য জমানার’ অবসান

১৮ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বারো বছরের নৈরাজ্যের সমাপ্তি। ব্যর্থ, চরম বিতর্কিত বিদেশনীতি। বিধ্বস্ত অর্থনীতি। আকাট রসিকতা ও নির্বোধ আচরণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আহাম্মক, হিংস্র রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লুউ বুশকে। আফগানিস্তান, ইরাক থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে নিজের একাধিপত্য গড়তে গিয়ে বিশ্বের এখন পয়লা নম্বর শত্রু। ইতিহাস বড় নির্মম! তাই ইরাকেই জবাব পেয়েছেন বিশ্বের ঘৃণিত ব্যক্তি বুশ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেষ ইরাক সফরে সাংবাদিক সম্মেলনেই বুশের দিকে ধেয়ে এসেছে সাংবাদিক মুন্তাজ আল জায়েদির দু’পাটি জুতো। বুশ নিশ্চিতভাবেই আমৃত্যু মনে রাখবেন মুন্তাজের চিৎকার : ‘কুত্তা! ইরাকের জনগণের পক্ষ থেকে এই হলো তোর বিদায় চুম্বন!’


নিশ্চিহ্ন মেসোপটেমিয়া

আমেরিকা ইরাক আগ্রাসন শুরু ২০০৩-এর ২০শে মার্চ। চোদ্দ দিনের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। বলেছিলেন বুশ। তারপর পাঁচ-পাচঁটা ৩রা এপ্রিল চলে গেছে। যুদ্ধ শেষ হয় নি। বাগদাদ জ্বলছে। এখনও। কারবালায় শুধুই মৃত্যুর হাহাকার। নিশ্চিহ্ন মেসোপটেমিয়া থেকে সাদ্দাম হুসেইন। ঠিক যেমনটা চেয়েছিল ওয়াশিংটন। কারণ বুশ যুদ্ধ চেয়েছিলেন। যুদ্ধ চেয়েছিলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। হোয়াইট হাউস চেয়েছে বিশ্বজোড়া আধিপত্য। ইরাকের সার্বভৌমত্বকে বেআব্রু করে খোঁজা হয়েছে গণ মারনাস্ত্র। প্রতি ইঞ্চি জমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মেলে নি তার সুলুক সন্ধান। ছয় লক্ষ ইরাকী নথি, ক্যাসেট, ভি ডি ও রেকর্ড ঘেঁটেও মেলে নি আল কায়েদার সঙ্গে সাদ্দামের যোগাযোগের কোনও তথ্য-প্রমান। ২০০৩-এর পর থেকে এপর্যন্ত ৬লক্ষ ৬০হাজার ইরাকি জনগনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ৯৯ শতাংশই সাধারণ মানুষ। চমকে দেওয়ার মতো তথ্যটা হলো, প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫০ জন। মার্কিন মুলুক থেকে প্রকাশিত ডাকসাইটে লস এজ্ঞেলস টাইমস পত্রিকার মতে, সংখ্যাটা ঢের বেশি। এই যুদ্ধ এর মধ্যেই কেড়ে নিয়েছে ১০ লক্ষের ওপর নিরপরাধ ইরাকি মানুষের জীবন। পঙ্গু বিকলাঙ্গ করেছে আরও কয়েক লক্ষ ইরাকি মানুষের জীবন।
এখন ইরাকে তাদের পুতুল সরকারের সঙ্গে ‘স্টেটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট’ (সোফা) করতে চাইছে। মার্কিন সেনা মোতায়েনকে চিরস্হায়ী করতে চাইছে। আসলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৩১শে ডিসেম্বরের সেনা প্রত্যাহারের যে নির্দেশ দিয়েছিলো, তাকে অস্বীকার করতেই এই চুক্তি।


যুদ্ধোন্মাদনা


বুশ বলেছিলেন, ইরাক যুদ্ধে বড়জোর খরচ হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। যা অনায়াসে উঠে আসবে ইরাকের তেল থেকে। এখন আমেরিকাকে প্রতি চার মাসে খরচ করতে হচ্ছে এই অর্থ। তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো তথ্যটা হলো, ইরাক যুদ্ধের এই খরচ, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের অন্তত দশ গুণ বেশি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের তিন গুনেরও বেশি। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের দ্বিগুন।
সামরিক খাতে ওয়াশিংটন একা যে পরিমান অর্থ খরচ করে, বাকি বিশ্ব মিলে খরচ করে সেই অর্থ। অন্যভাবে বললে, বিশ্বজোড়া সামরিক খরচের ৪৮ শতাংশই করে একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিরক্ষা খাতে খরচ তুঙ্গে উঠেছিল ১৯৮৮-তে। বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫হাজার কোটি ডলার। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নামতে শুরু করে। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত তা ছিল সাড়ে ৩হাজার ডলারের এদিক-সেদিক। যা সেসময় সুনিশ্চিত করেছিল অর্থনীতির উল্লম্ফনকে। ৯/১১-র পর ফের বাড়তে শুরু করে। এবং আজ তা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
দ্বিতীয় বৃহত্তম খরচের দেশ চীনের তুলনায় সাতগুণ বেশি। ছ’টি তথাকথিত মার্কিন বিরোধী দেশের (কিউবা, ইরান, লিবিয়া, গণতান্ত্রিক কোরিয়া, সুদান) তুলনায় ২৯ গুণ বেশি। ওয়াশিংটনের রিপোর্ট বলছে, ১৩০-টি দেশে আমেরিকার রয়েছে ৭৩৭-টি সামরিক ঘাঁটি। যদিও, গোপন ঘাঁটিগুলি এই তালিয়ায় নেই। নেই ইরাক, আফগানিস্তানের সেনা ঘাঁটির তথ্য। যেমন, ২০০৫ মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের নথি অনুযায়ী, এক ইরাকেই রয়েছে ১০৬-টি সেনা ঘাঁটি। এখন বিশ্বের ৭০ শতাংশ দেশেই মোতায়েন রয়েছে ইয়াঙ্কি সেনা।


সন্ত্রাসবাদ দমনের গল্প

আমেরিকায় যেন ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার ম‍‌তো আর কোনো ঘটনা না ঘটে — এই অজুহাতেই জর্জ বুশের ইয়াঙ্কি বাহিনী আফগানিস্তান ও ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। প্যালেস্তাইন ধ্বংসে মদত জুগিয়েছে ইজরায়েলকে। ইরান, সিরিয়া, লেবানন, উত্তর কোরিয়ার ভয় দেখিয়ে গোটা ইউরোপ জুড়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সীমাহীন পারমাণবিক ও সামরিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। একই জুজু দেখিয়ে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংঘটিত করছে পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়াকে। পরমাণু চুক্তির নাম করে আমেরিকা তার সামরিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে টেনে এনেছে ভারতকে। আমেরিকা নিজেকে বাঁচাবার নাম করে ভয়ঙ্কর মাত্রায় সন্ত্রাসবাদকে বাড়িয়ে তুলেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। যে প্রশিক্ষণে ও অস্ত্রে সি আই এ মুজাহিদিনকে দিয়ে সোভিয়েত পৃষ্ঠপোষিত আফগান সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ করিয়েছিল, এখন তালিবানরা একই কৌশল কাজে লাগাচ্ছে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে। মার্কিনী অভিযানে ভুগতে হচ্ছে গোটা উপমহাদেশের মানুষকে। মূল অপরাধী আড়ালে ঢাকা পড়ছে। আল কায়েদা ও তালিবান সামরিক জঙ্গী বাহিনী আফগানিস্তানের লাগোয়া পাকিস্তানের পাহাড়ী আদিবাসী অধ্যুষিত প্রদেশে ও এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে, অথচ পাকিস্তান কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না অভিযোগ করে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ঐ অঞ্চলে বিমান থেকে আক্রমণ করেই চলেছে। এই দুরভিসন্ধিমূলক কাজে মদত দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের কর্পোরেট মিডিয়া। পেন্টাগনের যেসব গোপন নথিপত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর বিরাট অধ্যায় জুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মার্কিন সেনাদের আক্রমণে অসংখ্য নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যেমন, ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওলমি নামে এক ছোট দ্বীপে মার্কিনীরা নাপাম বোমা দিয়ে আক্রমণ চালিয়েছিল। সেই নৃশংস আক্রমণে ঐ দ্বীপে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ সাবাড় হয়ে যায়। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নির্বিবাদে মানুষ খুন করা এদের বরাবরের বৈশিষ্ট্য। সেই ‘ট্রাডিশন’ সমানে চলেছে। আফগানিস্তানের উপরে আক্রমণকে আরো ‘নিখুঁত’ করে তোলার জন্য ন্যাটো সেনাবাহিনী যে কায়দা বা প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে তা আগের চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক।


তেলের লোভ

মার্কিন বিদেশনীতির অভিমুখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানি তেল একটি বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে। যেসব অঞ্চলে মাটির নিচে তেল বিপুল পরিমাণে আছে, সেসব জায়গার দিকে রয়েছে ওয়াশিংটনের আগ্রাসী নজর। সেই এলাকায় দখলদারি প্রতিষ্ঠার জন্য সে তৎপর হয়ে ওঠে, কখনও পরোক্ষভাবে কখনও প্রত্যক্ষভাবে। সেজন্যই মধ্যপ্রাচ্য ছাড়তে চায় না মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। বরং এই এলাকায় আরো স্থায়ীভাবে ঘাঁটি গাঁড়ার জন্য তারা ২০০৩ সালে সাজানো অজুহাত দিয়ে একতরফাভাবে ইরাক আক্রমণ করেছে। এই আক্রমণের একটি বড় কারণ হলো ইরাকের বিপুল তেলসম্ভার। সেই তেলের উপরে একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করার চেষ্টা করেছে মার্কিন বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলি। তবে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেলের ব্যাপারে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে আটকে থাকতে চাইছে না। কারণ এই অঞ্চলে আমেরিকা খুব স্বস্তিতে নেই। তাই আমেরিকার এখন নজর পড়েছে আফ্রিকার দিকে। যদিও আফ্রিকা তেল, গ্যাস ইত্যাদিতে উপসাগরীয় দেশগুলির মতো সমৃদ্ধ নয়। তবে আফ্রিকার মাটির নিচে যে পরিমাণ তেল আছে তা দখল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে আফ্রিকার উপরে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে তারা চাইছে মোটামুটিভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতে। ওয়াশিংটন জানে, ২০১০ সাল নাগাদ আফ্রিকা বিশ্বের মোট তেল উৎপাদনের ৩০ শতাংশ উৎপাদন করবে। তাই আগামী দিনগুলিতে আফ্রিকার তেলসম্পদ বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমেরিকার তাই একটি বড় উদ্দেশ্য হলো আফ্রিকার তেল সংগ্রহ থেকে অন্যান্য দেশগুলিকে আটকানো এবং সেই তেল সম্পদের উপর তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। এই মহাদেশ দখলে আনতে নতুন কমান্ড ‘আফ্রিকম’ গড়েছে পেন্টাগন। যেমন রয়েছে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলির জন্য সাদার্ন কমান্ড, ইউরোপের জন্য ইউরো কমান্ড। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এশীয় দেশগুলির জন্য প্যাসিফিক কমান্ড।

ক্ষুধার হাহাকার

‘ভারতীয়রা বেশি খাচ্ছেন, তাই টান পড়ছে বিশ্বের খাদ্য ভান্ডারে’, নির্বোধের মতো মন্তব্য করে ছিলেন বুশ। আর বিশ্ব পুঁজিবাদের মুখপত্র ‘দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল’-এ পাতাজোড়া শিরোনাম, ‘বিশ্বায়িত খাদ্য সঙ্কট যত বাড়ছে, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাদ্যশস্য কোম্পানিগুলির মুনাফা’। গত এপ্রিলের শেষে দানাশস্যের একচেটিয়া কারবারি, মার্কিন সংস্হা আর্চার ড্যানিয়েলস মিডল্যান্ড(এ ডি এম)-এর সশব্দ ঘোষনা, শেষ তিনমাসে তাদের মুনাফার পরিমাণ এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫কোটি ডলার। যা তার আগের বছরের ওই সময়ের তুলনায় ৫৫শতাংশ বেশি। বেনজির মুনাফার মুখ দেখেছে মার্কিন কার্গিল। তাদের নিট আয় বেড়ে হয়েছে ১০৩কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার ৮৬শতাংশ। তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো মুনাফা করেছে বীজ প্রস্তুতকারক মার্কিন সংস্হা মনসান্টো। তাদের মুনাফার পরিমাণ ২২৩কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার ৫৪শতাংশ। পাশাপাশি, সার প্রস্তুতকারক সংস্হা পটাস কর্পোরেশনের নিট আয় এক লাফে বেড়ে হয়েছে ৬কোটি৬০লক্ষ ডলার। অন্যদিকে বিশ্বের বৃহত্তম সার প্রস্তুতকারক সংস্হা মার্কিন মোসেইকের নিট আয় ১২০০শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫২কোটি ডলার।

হালফিলের বিশ্ব কৃষি বাজারের একচেটিয়া বা প্রায়-একচেটিয়া কারবারকে কব্জা করে রেখেছে এই সংস্হাগুলি। ছ’টি সংস্হা মিলে নিয়ন্ত্রণ করে দানাশস্যের বিশ্ব বানিজ্যের ৮৫শতাংশকে। তিনটি সংস্হার হাতে রয়েছে কোকো বানিজ্যের ৮৩শতাংশ। তিনটি’র দখলে কলা বানিজ্যের ৮০শতাংশ। এ ডি এম,কার্গিল আর বাঙ মিলে নিয়ন্ত্রন করে ভুট্টার বাজারকে। যার অর্থ,এরাই ঠিক করে উৎপাদিত ভুট্টার ফলনের কতটা যাবে ইথানল তৈরিতে,কতটা যাবে উৎকোচে,কতটা পশুখাদ্যে,আর কতটাই বা মানুষের জন্য। এই একচেটিয়াকরনের মধ্যে দিয়েই বহুজাতিক সংস্হাগুলি এখন নিয়ন্ত্রন করছে তাবৎ বিশ্বের খাদ্যপণ্যের দামকে। তাদের ক্ষমতা এতটাই যে,কেনার সময় তৃতীয় দুনিয়ার কৃষককে দাম দিচ্ছে নামমাত্র। আর বিশ্ব বাজারে তা বিকোচ্ছে চড়ামূল্যে। আর এভাবেই বানাচ্ছে মুনাফার পাহাড়। অন্যদিকে বাড়ছে বিশ্ব জুড়ে খাদ্যের হাহাকার।


আর্থিক বিপর্যয়


মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে তাসের বাড়ির মতো। আর্থিক সঙ্কট আজ এতটা অধোগামী হয়েছে যে, অনেকেই এই ভয়ঙ্কর সঙ্কটের সঙ্গে ১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রিট বিপর্যয়ের তুলনা টানছেন। মার্কিন মুলুক ১৯২৯ সালের সেই বিপর্যয়ের ভূত দেখছে। যখন ব্যাঙ্কগুলি দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছিলো, চোখের পলক পড়ার আগেই লক্ষ লক্ষ মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয় ভোজবাজির মতো উবে গিয়েছিলো, কারখানার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, লক্ষ লক্ষ কর্মরত মানুষ চাকরি খুইয়েছিলেন। কিন্তু গভীরতা ও ব্যাপকতার দিক দিয়ে এবারের সঙ্কটের মাত্রা তীব্রতর হতে চলেছে। বর্তমান যে মহাসঙ্কট তা হলো আর্থিক সংস্থাগুলির অসততা ও প্রতারণার এবং অপর দিকে নীতিনির্ধারকদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার ফসল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্ক লেম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে এবং এই ব্যাঙ্কের ঋণের পরিমাণ ছিলো ৬১৩ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বজুড়ে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদের মালিক মেরিল লিঞ্চ মাত্র ৫০ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়ে গেছে ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকার কাছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ৮৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রদান করেছে বিখ্যাত অর্থনৈতিক বীমা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইনসিওরেন্স গ্রুপকে, নইলে এই সংস্থা দেউলিয়া ঘোষিত হতো। ছ’মাস আগে আরেক বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিয়ার স্টার্নস বিক্রি হয়েছে জে পি মরগ্যান চেজের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের হস্তক্ষেপে। কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি এবং ফেডারেল রিজার্ভ ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থপ্রদান করে দুটি বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফ্যানি মা এবং ফ্রেডি মাকে দেউলিয়া হওয়ার অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছে এবং এই দুটি সংস্থাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। বাড়ছে বড়লোক ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য।
এবছরের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানের বক্তব্য, মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থা সবচেয়ে প্রতারণাপূর্ণ। প্রায় সকলেই একমত: আমেরিকায় দীর্ঘস্থায়ী মন্দা আসন্ন। মার্কিন আর্থিক সঙ্কট স্বাভাবিক নিয়মেই রূপান্তরিত হয় বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটে। বৃহৎ কোম্পানিগুলির আয় কমতে থাকে, বাজারে পণ্যের পরিষেবার চাহিদা দ্রুত পড়তে থাকে, ক্রেতার ক্রয়মানসিকতা সঙ্কুচিত হতে থাকে, এমনকি কোম্পানিগুলি লোকসানের দিকে যেতে থাকে তখন নানা মহলে উচ্চারিত হ‍‌তে থাকে মন্দার কথা। অতঃপর যখন একের পর এক কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই শুরু করে তখন পরিষ্কার হয়ে যায় আমেরিকার অর্থনীতি মন্দায় পতিত।


আক্রান্ত শ্রমিকশ্রেণী, গরিব মানুষ


১৯৩০-র দশকে মহামন্দার সময় আমেরিকায় যা হামেশাই দেখা যেত, গত ৭০/৭৫ বছর ধরে তা ইতিহাস। কয়েকদিন আগে শিকাগো শহরে সেই ইতিহাসেরই যেন পুনরাবৃত্তি। বিশ্বের শ্রমিক-আন্দোলনের ইতিহাসে যে শহর আলোর দিশারী, ধর্মঘট-বিক্ষোভের উত্তাল তরঙ্গে সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষকে নতুন ভোরের হাতছানি দিয়েছিল যে শহর সেই শিকাগোতেই একটি বন্ধ করে দেওয়া কারখানা দখল করে বসেছিলেন শ্রমিকরা। টানা ৭২ ঘন্টা। আসলে আজ মার্কিন অর্থনীতির ঘোর দুর্দিন। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের নজিরবিহীন পরিস্থিতি গোটা আমেরিকায়। গত নভেম্বরেই কাজ হারিয়েছেন ৫লক্ষ ৩৩হাজার শ্রমিক। হিসেবটা গত এক বছরের ধরলে ১৯লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। জেনারেল মোটরস, ফোর্ড, ক্রাইসলারের মতো বিশ্ব বিখ্যাত গাড়ি নির্মান সংস্থা থেকে শুরু করে শিকাগোর রিপাবলিকান উইনডোজ অ্যান্ড ডোরসের মতো ছোট কারখানায় চলেছে অবাধ ছাঁটাই।
স্বাভাবিকভাবেই দারিদ্র্য ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। গত ৭ই নভেম্বর প্রকাশিত মার্কিন শ্রম দপ্তরের রিপোর্ট বলছে, অক্টোবরে বেকারীর সংখ্যা গত ১৪ বছরের হিসাবকে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু অক্টোবরেই বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৬.৫শতাংশ। মার্কিন ভূখন্ডে এখন ৩ কোটি ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছেন। দারিদ্র্য মানে খাদ্যের অভাব, পুষ্টির অভাব, চিকিৎসার অভাব এবং সব মিলিয়ে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব।

মানেনি কিয়োটো চুক্তিও


মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনে আজও কার্যকর হতে পারে নি কিয়োটো চুক্তি। ১৯৯৭ সালে প্রধানত রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে শুরু হয়েছিলো আন্তর্জাতিক স্তরে একটা নিয়মগত কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা। তথাকথিত উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো পরিবেশ দূষণের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটা কাঠামো বানানোর প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে। কিন্তু যে ১৪১টি দেশ স্বেচ্ছায় এই চুক্তিকে শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেছে তার মধ্যে গ্রিনহাউস উৎপাদক গ্যাসের সবচেয়ে বড় নির্গমনকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নেই। অথচ আমেরিকা একাই এই মারাত্মক গ্যাসের মোট পরিমাণের ৩৬ শতাংশের বেশি উৎপাদন করে। ভারত ও চীন যৌথভাবেও এর অর্ধেক উৎপাদন করে না। আমেরিকা শুধু সই করে নি তাই-ই নয়, এই চুক্তি যাতে আদপে সম্ভব না হয় তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। জীবানু এবং রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধ সম্পর্কিত চুক্তিতে বাধা দিয়েছে, মানে নি পারমাণবিক পরীক্ষা নিষেধ সম্পর্কিত সর্বাত্মক চুক্তিও। এই আমেরিকাই ভারতকে বাধ্য করেছে সি টি বি টি-তে সই করতে।



লেখক-মৃণালকান্তি দাস
‘গণশক্তি’,
১৮ই জানুয়ারি, ২০০৯
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০০৯ বিকাল ৩:৩৮
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×