খুব ছোট বেলার কথা। সম্ভবত আমার বয়স তখন ছয় কিংবা সাত।আমার ডাকনাম ‘সিজার’।আমাদের বাসায় শেক্সপিয়রের একটা গল্প সমগ্র ছিলো।সবে মাত্র পড়তে শিখেছি। বানান করে পড়ি।খেলার ছলে শেক্সপিয়রের বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা গল্পের নাম দেখলাম ‘জুলিয়াস সিজার’।নিজের নামে গল্প। বিশাল ব্যাপার। হোচট খেতে খেতে পড়ে ফেললাম পুরো একটা গল্প।বেচারা জুলিয়াস সিজারকে তার বন্ধুর হাতে মারা যেতে হয়।ছোট হৃদয়ে ছোটখাটো একটা কষ্টও হলো জুলিয়াস সিজারের জন্য। এর ঠিক পরের গল্পটাই ছিলো ‘রোমিও জুলিয়েট’।জুলিয়াস সিজারের জন্য কষ্টের ধাক্কায়ই কিনা কি জানি ‘রোমিও জুলিয়েট’ গল্পটাও শেষ করে ফেললাম।ছোট মানুষ প্রেম বিরহের কি বুঝলাম কে জানে তবে এটা মনে আছে যে গল্পের শেষে রোমিওর জন্য বেশ কষ্টই হচ্ছিলো।একটু আধটু কান্নাও পাচ্ছিলো।তব সেই থেকে মনে হয় আমার মধ্যে প্রেমিক পুরুষের উদ্ভব হলো।তার প্রকাশ দেখলাম যখন ছয়মাস পরেই স্কুলে ভর্তি হলাম।ভর্তি পরীক্ষার আগে আম্মু এতবার বলে দিয়েছে যেন পরীক্ষা হলে পেন্সিল,স্কেল কিছু ফেলে না আসি।আর আমি যেটা করলাম সেটা হলো আমার সাথেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে তেমন এক মেয়ের সাথে খাতির করে ফেললাম।গোলগাল চেহারা।একটা বিড়াল বিড়াল ভাব আছে চেহারায়।তো আমি সেই বিড়াল কন্যার সাথে গল্প করতে করতে বের হয়ে এলাম। অতি সাধের স্কেলটা ফেলে এলাম পরীক্ষা হলে।পরে আম্মু কত যে রাগারাগি করলো, কিন্তু আমি আমার নতুন বন্ধুর(!) কথা ভাবতে মশগুল তখন।মজার ব্যাপার ভর্তি পরীক্ষায় সে হলো ফার্স্ট আর আমি সেকেন্ড। তার রোল এক, আমার দুই।দুইজন পাশাপাশি বসি।তখনই মনে হয় জীবনে প্রথমবার প্রেমে পরে গেলাম।বিড়াল কণ্যা আবার খুবই ভালো ছাত্রী।সব হোমওয়ার্ক করে আনে।আর আমি মাঝে মাঝেই হোমওয়ার্ক আনি না।নতুন প্রেমিকার পাশে কান ধরে দাড়িয়ে থাকি বেঞ্চের উপর।কান ধরা অবস্থায় মাথায় টোকাও দেই তার আর এমন ভাব দেখাই যে কান ধরে বেঞ্চের উপর দাড়িয়ে থাকাটা বিশাল একটা বীরপুরুষের মতো ব্যাপার যেটা সবাই পারে না।সব প্রেমের কাহিনীর মাঝেই একটা ট্রাজেডি থাকে।আমারো এলো।আমি সেই ছয় সাত বছর বয়সেই বিরহ ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম যখন আব্বু বদলি হয়ে আমাদের নিয়ে ঢাকা চলে এলো।আর আমার প্রথম প্রেমও সেখানেই শেষ কেননা জীবনতো আর সিনেমা না, যে আমি সেই মেয়েকে মনে রেখে তার জন্য বসে থাকবো ।
ঢাকায় এসে আমি পেয়ে গেলাম আমার নতুন প্রেমিকাদের। প্রেমিকাদের- বললাম, কারন ঢাকায় আমি নতুন যে স্কুলে কে.জি তে ভর্তি হলাম, সেখানে দুই জমজ মেয়ে ছিলো। খুবই সুন্দর দেখতে।প্রেমিক হৃদয় আমার।প্রেমে পরে গেলাম।কিন্তু ঠিক কোন জনের প্রেমে পরলাম তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কারন দুইজনের চেহারাই একরকম।একই রকম কাপড় পরে, একই ভাবে ঝুটি বাধে মাথায়।স্কুল ব্যাগও একইরকম।তো আমি আমার প্রেমিকাকে ঠিক আলাদা করে চিনতে না পারলেও তাদের কোন একজনের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকলাম।একদিন তারা স্কুলে আসে নাই, আমি আমার দুই বন্ধুকে নিয়ে স্কুল পালিয়ে তাদের বাসায় চলে গেলাম।দেয়ালের উপর দিয়ে উকি ঝুকি দিলাম।তাদের মা আমদের দেখে ফেললো। আমরা এক দৌড়ে আবার স্কুলে। লাভের মধ্যে লাভ যেটা হলো, দৌড়াতে গিয়ে আছার খেয়ে পরে আমার হাটু ছড়ে গেলো আর ডান পায়ের হাটুর কাছে প্যান্ট গোল হয়ে ছিড়ে গেলো। আমার প্রেমিকা কিংবা প্রেমিকারা কেউই জানতে পারলো না আমার বিশাল আত্মত্যাগের কথা।এই স্কুলেও আমার বেশিদিন থাকা হলো না।পায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ নিয়ে আমি চলে গেলাম অন্য স্কুলে। আমার প্রেমিকারা রয়ে গেলো পুরোনো স্কুলে।
নতুন এলাকায় আমরা যে বাসাটা নিলাম,তার ঠিক পাশের বাসাতেই থাকতো আমার বয়সী একটা মেয়ে।দুজনেই কেজি তে পরি।স্কুল আলাদা হলেও স্কুল শেষে ফিরে দুজন একসাথেই খেলতাম বাসার সামনের ছোট করিডোরটাতে।কারন বাসার বাইরে যাওয়া যেতো না।খেলতে খেলতেই মনে হয় তার প্রেমে পরে গেলাম।সকাল বিকাল কাটে তার সাথে।আগে খেয়াল করি নি, হঠাৎ করে আবিস্কার করলাম মেয়েটা দেখতে তো দারুন। আর এমন সময়ই আমার প্রেমের মাঝে তৃতীয় শক্তির উদ্ভব ঘটে। আমাদের বাসার সামনেই আমাদের বয়সীই একটা ছেলে ছিলো। তার আম্মার সাথে আবার মেয়েটার আম্মার ভালো খাতির। তো সেই ছেলে প্রায়ই খেলতে আসে মেয়েটার সাথে। আমি গাধা টাইপের ছেলে। তেমন স্মার্ট না। আর সেই ছেলে কঠিন স্মার্ট।ফট ফট ইংলিশ বলে।আর তার অনেক খেলনাও আছে। খেলার সময় আমাকেও ডাকে। আমি যাই না। ওরা দু’জন খেলে। আর আমি হিংসায় মরতে থাকি। ছেলেটার এই বাসায় আসাও বেড়ে যায় ধীরে ধীরে। আর তখনই আমরা আবার বাসা পাল্টাই। আর আমাদের বাসায় উঠে আসে ওই ছেলের পরিবার, সাথে ছেলেটা। এখন থেকে সবসময় ওই ছেলের সাথে মেয়েটি খেলবে। নিজেকে রোমিও আর মেয়েটাকে জুলিয়েট বলে মনে হয় আমার। যদি আম্মুকে বলা যেতো, আমি ওকে ছাড়া কোথ্থাও যাবো না। কিছুতেই না। কিন্তু কি করে বলি, আমি যে ছোট্ট রোমিও।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৪:৩৩