somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মমি দেখতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গে‍লাম....

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০০৯ ভোর ৬:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ব্রিটিশ মিউজিয়াম শুধু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাদুঘরই নয়, আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে এটা পৃথিবীর এক নম্বর হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছে। এখানে সারা পৃথিবী থেকে নিয়ে আসা ৭০ লাখ মূল্যবান বস্তু থেকে মানুষের ইতিহাসের অনেক কিছু জানা যায়। গবেষকরা প্রতিনিয়ত এসব থেকে সংগ্রহ করেন অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য। প্রায় আড়াইশ বছর আগে ১৭৫৩ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়।

গত দুই মাস বাসাতেই বসে আছি। তাই কয়দিন আগে যখন আমার বন্ধু তার একটা কাজে লন্ডনে যাবার জন্য আমাকে বললো আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। জানালাম, যাতায়াত ভাড়াটা পেলেই আমি খুশি। এতোদিন নানা কাজেকর্মে আর টাকা পয়সার টানাটানিতে এখানে যাবার সুযোগ পাইনি...

লন্ডনের দর্শনিয় স্থানগুলোর মাঝে ব্রিটিশ মিউজিয়ামটাই আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। জানতাম বিখ্যাত এ জাদুঘরটার সংগ্রহ খুবই সমৃদ্ধ। অনেক আগে কোন একজন বিখ্যাত লেখকের ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখার অভিজ্ঞতা পড়ে খুবই ভালো লেগেছিলো। তাই ব্রিটেনে আসার পর থেকেই এখানে যাওয়ার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে সুযোগ পেলাম এ দেশে আসার প্রায় দেড় বছর পরে।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বিল্ডিংটা খুজে বের করতে আমাদের কোনো অসুবিধাই হলো না। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে করে সেদিকে রওনা দিয়েছিলাম। বিশাল বড় বিল্ডিংটা দেখে ভাবছিলাম এটা গ্রিক না রোমান স্টাইলে তৈরি, কে জানে….

ভেতরে ঢুকতে টিকিট লাগবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। হাঁটতে হাঁটতে যখন একেবারে ভেতরে পৌছে গেলাম কিন্তু কেউ টিকিট চাইলো না। বুঝতে পারলাম এখানে ঢুকতে টিকিট লাগে না। পরে ডোনেশনের বাক্সগুলোতে লেখা দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। ব্রিটিশ মিউজিয়াম ১৭৫৩ সাল থেকেই ফ্রি।



তবে ভেতরে ব্যাবিলনের ওপর একটা প্রদর্শনী হচ্ছিলো। সেটা দেখার জন্য টিকেটের ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বিশাল সংগ্রহ একদিনে পুরোটা দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। এর পরে আবার টিকিট কেটে প্রদর্শনী! প্রদর্শনীর পথে আর মাড়ালাম না।
বাংলাদেশের জাদুঘরগুলোতে অজ্ঞাত কারণে ছবি তোলা নিষেধ। এখানে এসেও আমি তাই প্রথমে ক্যামেরাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দেখি আশপাশের লোকজন সমানে ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছে, নানা পোজে ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলে যাচ্ছে। তখন নিজেকে বেশ বোকা বলেই মনে হলো। ক্যামেরা বের করে আমিও ছবি তোলা শুরু করলাম।



এ জাদুঘরে মোট ৯৪ টা গ্যালারি আছে। সবগুলোতে ঢুকা একদিনে আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই ভেতরে গিয়ে কি দেখবো আগে থেকে তার কোনো পরিকল্পনা করি নি। ফলে ভেতরে গিয়ে অনেকটা গোলকধাধায় ঘুরে চলার মতো দেখতে থাকলাম।
প্রথমেই সামনে পড়লো প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার নানা নিদর্শন। গ্রানাইটের তৈরি রামেসেস-২ এর বিশাল একটা মূর্তির ছবি তুললাম। খ্রিস্টপূর্ব ১২৭০ সালে তৈরি এ মূর্তিটি এ জাদুঘরের অন্যতম বড় একটা মিশরীয় দর্শনীয় বস্তু। এর ওজন সোয়া ৭ টন…….




এখানে পাথরের তৈরি মিশরীয় বিভিন্ন জিনিস দেখছিলাম। কালো গ্রানাইটের আরো কিছু জিনিস দেখে চমৎকৃত হলাম। খ্রীস্টপূর্ব ১৩৮০ সালে তৈরি মমি রাখার জন্য নক্সা করা একটা শবাধার এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এগুলোতে লেখা ছিলো হাত দেয়া নিষেধ। তবে শুধুমাত্র অন্ধ মানুষরা হাত দিয়ে ধরতে পারবে। এ সুযোগে কিছু সুস্থ মানুষকেও দেখলাম হাত দিয়ে ধরে দেখছে। শুধু চোখের দেখায় মন ভরছে না….


শুধু পাথরের তৈরি জিনিস দেখে মন ভরছিলো না। কোনটা কোন সালের তৈরি এসব পড়তে পড়তে মাথা ঘুরতে লাগলো। এতো জিনিস দেখার সময় কই? আমি জানতাম এ জাদুঘরেই কয়েকটা মিসরীয় মমি রাখা আছে। সেগুলোর খোজে বের হলাম। কিন্তু তার আগেই আরো বেশ কিছু আকর্ষণীয় জিনিস চোখে পড়লো। কিছু ছবিও তুলে রাখলাম।


পুরো জাদুঘরটার মাঝেই একটা ঐতিহাসিক ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এজন্য কখনো দরজায় ব্যবহার করা হয়েছে প্রাচীন নিদর্শন।
ভেতরের আলো ছায়ার খেলাটাও দারুণ। অনেকগুলো গ্যালারিতে কৃত্রিম লাইটের পাশাপাশি প্রাকৃতিক আলো ঢোকার জন্যও ব্যবস্থা ছিলো্। আর ছবি তোলার জন্য প্রাকৃতিক আলোই আমার পছন্দ….


গ্রীক দেবী আফ্রোদাইতের ‘লেলিস ভেনাস’ নামের মূর্তিটা দেখে মুগ্ধ হলাম। প্রচুর গ্রীক ভাস্কর্যে এ দেবীকে নানা ভঙ্গীমায় পাওয়া যায়। খ্রীস্টাব্দ ১ম বা ২য় শতাব্দীতে তৈরি এ মূর্তিতে তার গোসল করার সময়কার অবস্থা কল্পনা করা হয়েছে…






প্রাচীন গ্রীসের মন্দিরের গায়ের অনেকগুলো শীলালিপি দেখলাম। ভারী ভারী বিশাল শিলালিপিগুলো তুলে এনে এখানে লাগানো হয়েছে। পুরো শীলালিপিতে নানা ছবির মাধ্যমে একটা কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে…..



ঘুরতে ঘুরতে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম টুম্ব রাইডার গেমে দেখা একটা দৃশ্যের মতো জায়গায়। বিশাল কয়েকটা পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে মানুষের মতো মাথা বিশিষ্ট ষাড়। যার আবার পাখাও আছে। এগুলো খ্রীস্টপূর্ব ৭২১-৭০৫ সালে তৈরি। আনা হয়েছে উত্তর ইরাকের খোরসাবাদ নামে একটা প্রাচীন শহর থেকে।



২৫০ বছর আগে প্রতিষ্ঠার সময় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রাকৃতিক বিষয় আর শিল্পকর্ম রাখার পরিকল্পনা ছিলো। তবে পরে এখানে সংগৃহিত অধিকাংশ বই দিয়ে দেয়া হয় ব্রিটিশ লাইব্রেরীকে। আর প্রাকৃতিক ইতিহাসের সংগ্রহগুলো দিয়ে দেয়া হয় ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। এর পরও এখানে কিছু প্রাচীন বই আছে দেখে অবাক হলাম….



আরেক গ্যালারিতে গিয়ে দেখি প্রচুর দেব দেবীর ছোট ছোট মূর্তি রাখা। কিন্তু ভালো ছবি তুলতে পারলাম না। কাঁচ দিয়ে ঘেরা গ্যালারিগুলোর ছবি তোলা খুব মুস্কিল। আলোর প্রতিফলন হয়।
দক্ষিণ আমেরিকার ডাবলাডা নাচের অদ্ভুত সুন্দর মুখোশ আর রঙ্গীন পোশাকগুলো দেখে মুগ্ধ হলাম…..






আমাদের উপমহাদেশের শিব ও পার্বতীর মূর্তিও আছে দেখলাম। এগুলো উড়িষ্যাতে ১২-১৩ শতাব্দীতে তৈরি…..


অমিতাভ বুদ্ধর বিশাল একটা মার্বেল পাথরের মূর্তি দেখলাম। ৫৮১-৬১৮ সালে তৈরি এ মূর্তিটি চীন থেকে আনা….



একটা পাথরের বাজপাখি দেখে বেশ ভালো লাগলো। এদিন আমরা দুই বন্ধু বেড়াতে গিয়েছিলাম। এ বন্ধুর অবস্থাও আমার মতো আনস্মার্ট। এখানে আসার সময় কয়েকবার বলেও ওকে দাড়ি সেভ করাতে পারিনি। তাই বুদ্ধি করে ওকে সেটার পাশে দাড় করিয়ে ছবি তুলে ফেললাম। দেখুক অবস্থা, লন্ডনে এমন আনস্মার্ট অবস্থায় ঘুরতে থাকলে আগামী ৩০ বছরেও কিছু হবে না….


ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে মমি খুজে পেলাম। নানা দেশ থেকে আনা বিভিন্ন ধরনের মমি দেখে মাথা ঘুরছিলো। তাই কয়েকটা ছবি তুলেই বন্ধুকে বললাম চল এবার বাইরে যাই। আর দেখতে পারবো না….








ব্রিটিশ মিউজিয়াম আইন:
ব্রিটিশ মিউজিয়াম সহ পৃথিবীর নামী দামী জাদুঘরগুলো তাদের সংগ্রহগুলো এনেছে সারা পৃথিবী থেকে। এগুলো আনা হয়েছে জোর করে, কখনো দাম দিয়ে কিনে, কখনো বা চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে। এ কারণে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সমালোচনাও কম না। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে গ্রিস থেকে আনা এলীগন মার্বেল ও নাইজেরিয়া থেকে আনা বেনিন ব্রোঞ্জের জন্য। এ দেশগুলো তাদের এসব মূল্যবান সামগ্রী ফেরত চেয়েছে।
তবে ব্রিটিশ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ অবশ্য এগুলোর কিছুই ফেরত দিতে রাজি হয়নি। তাদের বক্তব্য, এসব জিনিস ফেরত দেয়া শুরু হলে পৃথিবীর যাবতীয় জাদুঘরই খালি হয়ে যাবে। এ ব্যাপারটাকে বৈধতা দেয়া হয় ১৯৬৩ সালের মিউজিয়াম অ্যাক্ট অনুযায়ী। যা অনুযায়ী, মিউজিয়ামে কোনো জিনিস ঢুকলে তা ফেরত দেয়া নিষেধ। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, অস্ট্রেলিয়া সরকারের সাথে ২০ বছর ব্যাপী এক মামলার পর কর্তৃপক্ষ তাদের তাসমানিয়া অ্যাশেস ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে।

[ছবি: লেখক]
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ৮:০৬
২২টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×