somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিজয় দিবস ২০০৮ ভাবনাঃ- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক আর ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ১১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এখনও মাঝে মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন করেন - মুক্তিযুদ্ধ কি খুবই দরকার ছিল। পরের প্রশ্নটা প্রায়ই শুনতে হয় - যদিও মুক্তিযুদ্ধ হয়েই থাকে কোন লক্ষ্য ছাড়াই বা ভারতের লাভের লক্ষ্যকে ঘিরে - এই নিয়ে এখন আর এতো মাতামাতির দরকার কি? এতে পক্ষ বিপক্ষ তৈরী হয় - দেশের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মোদ্দাকথা হলো বলার চেষ্টা করা হয় - মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়া মুলত দেশের উন্নয়নের পরিপন্থী।

আসলেই কি তাই। আমরা যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকাই - দেখবো হিটলারের পক্ষে একটা টু শব্দ করার মতো কেউ এখন আর অবশিষ্ট নেই। মিত্রশক্তি যুদ্ধের পরপরই সম্ভাব্য সকল অপরাধী বিচারে সন্মুখিন করেছে। আইন তৈরী করা হয়েছে - যাতে হিটলার বা নাজীদের পক্ষে বিতর্ক তৈরীর কোন সুযোগ না থাকে। দেশে দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর বিজয় গাঁথাকে মিউজিয়াম আর স্থাপত্যের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনও একদল মানুষ নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে - যাতে নাজীদের অবশিষ্ট কোন নেতা বা যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করা যায়। এরা সতর্ক দৃষ্টি রাখে - যাতে কেউ ইতিহাস নিয়ে কোন বিতর্ক তৈরীর সুযোগ না পায়। সাম্প্রতিক অস্ট্রিয়াতে কার্টিজ ব্রাউন নামক একজন ইতিহাসবিদ কারাবাস করছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপরাধে। জানডাল নামের এক জার্মান - হিটলারের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্যে একটা ওয়েব সাইট খুলে বিচাররাধীন।

তাহলে বিষয়টা পরিষ্কার। যদি বিতর্ক না করার মতো পরাজিত শক্তি সংগঠিত হতে না পরে - তা হলে বিতর্কের সুযোগ থাকে না। ১৯৭১ সালে যারা পরাজিত হয়েছিলো এবং পরাজয় মেনে নেয়নি - এরা এই দেশে থাকার অধিকার হারিয়েছে। যদি সেই পরাজিত শক্তি তাদের বাংলাদেশের জন্মবিরোধী মতাদর্শ নিয়ে কর্মকান্ড চালাতে না পারতো - তবে ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক করার কোন প্রশ্নই উঠতো না।

পরাজিত শক্তির অস্তিত্বের কারনেই এরা বাংলাদেশের ইতিহাস আর জন্মকে অস্বীকার করেই থাকতে হবে। সেই পরাজিত শক্তি আর তাদের উত্তরসুরীরাই প্রকৃত ইতিহাস লুকানোর চেষ্টার করবে। এরা চাইবে না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এদের চিনুক। ইতিহাস বিকৃতির সুযোগ তৈরীর জন্যে প্রথম কাজটা হলো ইতিহাস চর্চা বন্ধ করা। এতে প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। কারন - জানার ইচ্ছা মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি - মানুষ তার অতীত জানতে চাইবেই। সৃষ্ট শূন্যস্থানে কিছু রূপকথা ধরনের ইতিহাস দিয়ে ভরে দেওয়া হবে। তাতে "পাকিস্তানী সেনাবাহিনী" স্থলে লেখা হবে "হানাদার বাহিনী", আল বদরের স্থলে লেখা হলো "কালোশক্তি" অথবা "সন্ত্রাসী" আর "রাজাকার" শব্দটা চিরতরে হারিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে রাজনীতির চোরাগলিতে ঠেলে দিয়ে একটা বিতর্কিত ইতিহাস তৈরী পথ তৈরী হবে। কারন একদল মানুষতো সবসময় সত্যের সন্ধান করে আর সেই সত্যের পক্ষে দাড়ায়। তখন শুরু হয় রূপকথার ইতিহাসের সাথে প্রকৃত ইতিহাসের বিতর্ক।

অবশ্যই একসময় না একসময় সত্যের বিজয় হবে। মধ্যের থেকে কিছু সময় অপচয় হবে। একটা প্রজন্ম বিভ্রান্তির জালে আটকে থাকবে আর অপচয় হবে কিছু মেধা আর মননের।

বাংলাদেশে এই প্রচেষ্টা চলেছে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত কোন রকম বাঁধা না পেয়েই। তারই ধারাবাহিকতায় আজও মুক্তিযুদ্ধকে অবমূল্যায় করা হচ্ছে। এই অবমূল্যায়নের জন্যে দায়ী কে?

যদি একটু ভাল ভাবে দেখি - দেখবো এই জন্যে দায়ী আমরা সবাই। আমাদের আগের প্রজন্ম যুদ্ধ করেছে। দেশ স্বাধীন করে গেছে। কিন্তু সেই ঘটনাবলীকে ইতিহাসে সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। ১৯৭৫ থেকে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে - এই বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরী না করে আমাদেরই একদল সহায়তা করেছে। প্রতিটি বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসে আমাদের নাট্যকারগন নাটক লিখেছে - হানাদার বাহিনীকে নিয়ে - সেখানে সযত্নে রাজাকার আলবদর শান্তিকমিটি শব্দগুলো সেন্সরড হয়েছে। আমাদের অভিনেতা অভিনেত্রীগন - যাদের মধ্যে একদল মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন - অভিনয় প্রতিভা দিয়ে বিকৃত নাটকগুলো বিশ্বাসযোগ্য করেছেন।
আমাদের নতুন প্রজন্ম এই বিকৃত ইতিহাসের মধ্যেই ডুবে গেছে।

বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অনেক কলেজ আর স্কুলের ইতিহাস পড়ানো হয়। ইতিহাসের ছাত্র শিক্ষকগন কি কখনও বাদশা আকবরের ইতিহাস মুখস্থ করার পাশাপাশি সেই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ করা চেস্টা করেছেন? মনে হয় না।

রাষ্ট্রীয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ আর ইতিহাস রক্ষার জন্যে তেমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি ৭৫ এর পর। পচাত্তরের আগে হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংগ্রহ আর প্রকাশের পর রাস্ট্রীয় কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতিকে রক্ষার জন্যে কোন সৌধ না গড়ে বাংলাভাষার বিরোধীতাকারী নুরুল আমিনের কবরে স্মৃতি সৌধ বানানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধদের শ্রদ্ধা দেখিয়ে একটা গোরস্থান তৈরী বিপরীতে রাজাকার সবুর খানকে সন্মানের সাথে সংসদ ভবনে সমাহিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে মুক্তিযুদ্ধাদের বিপরীতে রাজাকারদের উপবিষ্ট করা হয়েছে। শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাও এই ঘৃন্যকাজ গুলো সমর্থন করেছে।

তারপর দেখি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবীতে আন্দোলন হলো। উনিসহ আর দশজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষের নামে যিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনলো সে ছিলেন একজন রাজাকার - আব্দুল মতিন চৌধুরী - তখন আসীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে।

অনেকেই বলে গনআদালত ব্যর্থ হয়েছে। এরা প্রকৃতপক্ষে গনআদালতের মুল বিষয়টাই বুঝে না। গনআদালতই মুলত আমাদের ইতিহাসের পতনের গতিকে মন্থর করেছে। তরুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধে মুল্যবোধে উদ্দিপ্ত করেছে। এগিয়ে এসেছে অনেক মুক্তিকামী যুবক - ইতিহাসের বিকৃতি বন্ধের জন্যে একত্রিত হয়েছে। একক ভাবে বা দলগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে। এর মধ্যে ইন্টারনেটে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক মেধাবী তরুন এগিয়ে এসেছে। বেসরকারীভাবে স্থাপতি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর। পৃথিবীর আর বোধ হয় একটা দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে সেই দেশের জন্মের ইতিহাস সংরক্ষনে সরকার নিষ্ক্রিয় থাকে আর বেসরকারী উদ্যেগে সেই ইতিহাস সংরক্ষিত হয়।

ইতিহাস বিকৃতি যখন পূর্নগতিতে চলছিলো তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির থেকে রক্ষার জন্যে নিরবে কাজ করেছে একদল লেখক। যারা নিজেদের উদ্যোগেই লিখেছেন এবং এখনও লিখে যাচ্ছেন ইতিহাস। সংগ্রহ করছেন প্রমানাদি আর প্রকাশ করছেন আর প্রতিবাদ করছেন বিকৃতির।

বিজয় দিবস ২০০৮ এ সেই মানুষগুলোকেই স্মরন করছি - যারা শত লোভ আর ভয় ভীতির উর্দ্ধে উঠে জাতির জন্যে সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। যিনি স্বাধীনতার তিনদশক পরেও শুধু মাত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার অপরাধে জেএমবির বোমাবাজির ঘটনায় স্বাধীনতার শত্রু সমর্থিত সরকার কর্তৃক জেলে নিক্ষিপ্ত হয়ে নির্যাতিত হয়েছেন।

আজকের মহান বিজয় দিবসে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই মহান ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনকে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের জন্যে রইল প্রানঢালা সন্মান। আশা করি জাতি এই মহান ইতিহাসবিদের অবদান সন্মানের সাথে স্মরন রাখবে।
১৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×