somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার ভাষা - আমার ভালোবাসা - পর্ব ১

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার ভাষা - আমার ভালোবাসা - পর্ব ১
--------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ


ভূমিকাংশ

শহীদ মিনারের সাদাকালো ছবি তার নীচে লেখা, 'আমরা সালামের ভাই, আমরা বরকতের ভাই'। খুব ছোটবেলায় ('৭৫/'৭৬ সালের কথা বলছি) ফেব্রুয়ারী মাস এলেই দৈনিক সংবাদপত্র 'দৈনিক বাংলা'-য় একটি কলাম দেখতে পেতাম এই শিরোনামে। আগ্রহ জাগলো মনে, প্রতি ফেব্রুয়ারীতে এই কলাম আসে কেন? কি লেখা আছে এই কলামে? কে সালাম? কে বরকত? কেন তারা আমাদের ভাই? একটু জ্ঞান হলে পড়তে শুরু করলাম আর জানতে শুরু করলাম আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরব গাঁথা। আরও বেশী পুলকিত হলাম যখন জানলাম আমার নিজেরই দাদা ও ফুপু ছিলেন এই আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

আমাদের পূর্বপুরুষদের শ্রম ও মেধার মূল্যে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরা সকল দেশের সেরা আমাদের জন্মভূমির সহসা পতন ঘটে পলাশীর ট্রাজেডী-তে। স্বাধীনতা হারিয়ে আমরা দিন দিন শ্রীহীন হতে থাকি। একই সাথে স্বাধীনতার প্রয়োজনও উপলদ্ধি করতে শুরু করি। স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধির সাথে সাথে স্বাধীনতা হারানোর কারণটি কি সেটাও খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণটি খুঁজে বের করতে পারলেই প্রাপ্তির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা আমরা হারিয়েছি কেবলমাত্র উমিচাঁদ ও জগৎ শেঠের চক্রান্ত ও মসনদলোভী মীরজাফরের নির্বুদ্ধিতায় নয় তার চাইতেও বড় কারণ জাতীয়তাবাদের অভাবে । জাতীয়তাবাদ - অর্থাৎ দেশ আমাদের, নবাব আমাদের, মাটি আমাদের ভাষা আমাদের, এই বোধ। এই বোধ যদি দেশবাসীর মধ্যে সজীব থাকত তো কয়েকটা স্বার্থপর মানুষের চক্রান্তে বাংলার পতন ঘটত না।

স্বাধীনতা লুপ্ত হলো যে জিনিসের অভাবে স্বাধীনতা মিলিয়ে দেয়ার ক্ষমতাও তারই হাতে। ধীরে ধীরে এদেশের মানুষ তা বুঝতে শুরু করলো। যতই এই বোধ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো ততই দানা বেধে উঠতে শুরু করলো বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন - ফকীর মজনু শাহ্‌-র বিদ্রোহ, তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা, হাজী শরিয়তুল্লাহ্‌র আন্দোলন, এক একটি সোপান। যার ফলাফল ছিল ১৯৪৭ সালে বাংলার মাটিতে বৃটিশ শাসনের পতন।

স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা আবারও নতুন করে উপলদ্ধি করতে শুরু করলাম ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা বিরোধী জিন্নাহ্‌র ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। এবার জাতীয়তাবাদ নিঃসন্দেহে ১৭৫৭ সালের চাইতে অনেক বেশী মজবুত ছিল, তাই ঘোষণা কানে প্রবেশ করতে না করতেই গর্জে উঠেছিল উপস্থিত জনতার প্রতিবাদী কন্ঠস্বর - 'নো নো নেভার'।

'অপমানে, অপমানে যেদিন জ্বলে উঠেছিলে বর্ণমালা,
সেইদিন থেকে শুরু হলো পালা বদলের খেলা'

সেই পালা বদলের খেলা-য় '৪৮ থেকে '৫২, '৫২ থেকে '৫৪, '৫৪ থেকে '৬৯, '৬৯ থেকে '৭১, সর্বপোরি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

কি ঘটেছিল ১৯৪৮-এ, কি হয়েছিল ১৯৫২-তে, কেন এতগুলো তাজা প্রান ঝরে গেল ভাষা আন্দোলনে? ভাষার জন্য আন্দোলন করতে হলো কেন? রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা কি সত্যিই খুব জরুরী? মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষা হলে কি লাভ হয়? কবে থেকে যাত্রা শুরু হলো বাংলা ভাষার? কেমন ছিল বাঙলা ভাষার নানা কাল? আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি? আগামী গন্তব্য কোথায়? আমার শিশু মনে এইসব প্রশ্ন যতই উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করলো, ততোই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম যেখানে যত তথ্য পাই।

শুরু হয়েছিল সেই শহীদ মিনারের সাদাকালো ছবি তার নীচে লেখা, 'আমরা সালামের ভাই, আমরা বরকতের ভাই'- দিয়ে, শেষ এখনো হয়নি। হয়তো হবেও না। এযাবৎ কাল নিজের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা সম্পর্কে যা জেনেছি ও যা বুঝেছি তা ধারাবাহিকভাবে লিখে যাওয়ার চেষ্টা করব এই সিরিজে। পাঠকদের গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।


ভাষা কি?

বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, সে প্রতীকের জগতে বসবাস করে। তার জীবনের প্রয়োজনে নানা ধরনের প্রতীক সে ব্যবহার করে। এমন একটি প্রতীক হলো ভাষা - ধ্বনীর পিঠে ধ্বনী সাজিয়ে সৃষ্ট এই প্রতীক। ভাষা মানুষ ব্যবহার করে তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য এবং অন্যের মনের ভাব নিজে বোঝার জন্য। মূল কথা - ভাষা হলো মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম। ভাষা বিষয়ক বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ভাষাবিদ্যা বলা হয়। বর্তমান বিশ্বের ভাষাসমূহের সঠিক সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না, তদুপরী ভাষা ও উপভাষা (dialect)-র মধ্যে আংশিক বা অবাধ পার্থক্য বিষয়টির উপরও তা নির্ভর করে। যাইহোক, আনুমানিক হিসাবে বিশ্বে ছয় থেকে সাত হাজার ভাষা রয়েছে।

ইংরেজি শব্দ "langage" ইন্দো ইউরোপীয় dn̥ǵ ʰ wéh ₂ ল্যাটিন lingua অর্থ "জিহ্বা, বক্তৃতা, ভাষা"। ভাষা শব্দটি মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হয় কোড , সাইফার , এবং কৃত্রিমভাবে নির্মিত যোগাযোগ সিস্টেমে (যেমন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ) । এই অর্থে ভাষা হল প্রতীকের সিস্টেম যা তথ্য এনকোডিং এবং ডিকোডিং ব্যবহৃত হয়।

ভাষার জন্ম হয় ও কালের স্রোতে তা বিবর্তিত হয়ে নব নব রূপ ধারণ করে। আবার অনেক সময় ভাষার মৃত্যু হয়ে কেবল লেখ্য রূপটিই বিরাজ করে, আবার কখনো কখনো একেবারেই হারিয়ে যায়। কোন ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস নিরুপন করা যাবে আধুনিক ভাষার সাথে তার পূর্বতন ভাষার তুলনা করে। একদল ভাষা যার পূর্বতন ভাষা ছিল একটি তাদেরকে একটি ভাষা পরিবার বলা হয়। যেমন, ইন্দো ইউরোপীয় পরিবার - স্প্যানিশ, ইংরেজি, পর্তুগীজ, বাংলা, হিন্দি, রাশিয়ান, জার্মান, মারাঠী, ফরাসি, ইতালিয়ান, পাঞ্জাবি, এবং উর্দু। সেমিটিক ভাষা, যার অন্তর্ভুক্ত আরবি, আমহারিক, হিব্রু; এবং বান্টু ভাষা, যা সোয়াহিলি, জুলু, শোনা, এবং সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে আরও শত শত ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। ইদানিং সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে যে আজকের কথ্য ভাষার মধ্যে সম্ভবত 50 থেকে 90% ভাষা 2100 সালের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

মানুষের ভাষা কেন অনন্য?

মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণিও নিজেদের মধ্যে নানাভাবে যোগাযোগ করে থাকে। যেমন মৌমাছি বা বানর তারাও নৃত্য, ইশারা ও ধ্বনীর মাধ্যমে যোগাযোগ করে । কিন্তু তাদের সিস্টেমটি একটি বদ্ধ সিস্টেম। সেখানে কিছু সীমিত সংখ্যক প্রতীক রয়েছে। অন্যদিকে মানুষের ভাষা উন্মুক্তএবং উত্পাদনশীল, যার মানে হল মানুষ সসীম সেট ধ্বনি থেকে অসীম সেট নতুন শব্দ ও বাক্য তৈরি করতে পারে।


এছাড়াও, কোন বিশেষ ভাষার ব্যাকরণ মূলত অবাধ, অর্থাত্ যে কোনো সিস্টেম শুধুমাত্র সামাজিক মিথস্ক্রিয়া মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রাণীরা কেবল সীমিত সংখ্যক ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারে যা জেনেটিকালি সঞ্চারিত হয়।


বেশ কিছু প্রজাতির প্রাণী (যেমন Bonobo Kanz) সামাজিক শিক্ষার মধ্যে দিয়ে যোগাযোগের মাধ্যম শিক্ষা গ্রহন করতে পেরেছে। একইভাবে, পাখি এবং বহু প্রজাতির তিমি তাদের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যদের কাছ থেকে গান শিখতে পেরেছে। যদিও বেশ কিছু প্রাণী প্রচুর শব্দ ও প্রতীক শিখতে পেরেছে, তার পরেও কোন প্রাণীই মানব ভাষার জটিল ব্যাকরণতো দূরের কথা এমনকি চার বছর বয়সী মানব শিশুর চাইতে বেশী সংখ্যক প্রতীক শিখতেও সমর্থ হয়নি।

(চলবে)
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×