বাসের জানালা দিয়ে আশপাশের দৃশ্য দেখছিল সাহেদ।এই এলাকাটি একেবারে অপরিচিত তার
কাছে।তাই বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।যখন শুনল খালাসী ছেলেটা ডাকছে,এই-যে
ভাই নেমে এসো,তোমার ক্যানেল মোড় এসে গেছে।
বিরক্ত তবু হন্তদন্ত হয়ে বাস থেকে নামল সাহেদ।
বাস থেকে নেমে বুকভরা একটা বাতাস চারপাশে খেলা করছে টের পেল সাহেদ।ভাবল,বাসের
খালাসীটার উপর অহেতুক রাগ করেছে সে।ওরা হয়তো প্রথম পরিচয়ে সকলকে তুমি করে বলে।
কিম্বা এমনও হতে পারে সাহেদের চেহারা দেখে একেবারে ছেলেমানুষ ভেবেছে।তা-তে অবশ্য ভুল
নেই কোন।যে লোক যেখানে যাবে তার ঠিকানা বলতে পারে না,সে নিশ্চয় ছেলেমানুষ।
কনডাকটর যখন তার কাছে ভাড়া চেয়েছিল তখন সে বলেছিল --রুপপুর পঞ্চায়েত।
--রুপপুর পঞ্চায়েত,ওখানে তো আমাদের বাস যায় না,আপনি বরং ক্যানেল পাড়ে নামবেন।
--ক্যানেল পাড় ?
--হ্যঁ ,ক্যানেল পাড়,এই বুধু ভাইকে ক্যানেল পাড়ে নামিয়ে দিস।
এই সেই ক্যানেল পাড় ,বুকে মোড়ামের চাদর জড়িয়ে গড়িয়ে গেছে অনেকদূর।সেই মোড়াম
রাস্তা ধরে হাঁটছে সাহেদ।আশেপাশে ফাঁকা মাঠ।কার্তিকের হিমেল হওয়ায় দুলছে ধানজমির
ভরন্ত শরীর।ক্যানেলে শীর্ণ জলধারা।সেখানে তে-চোখো মাছের কিলিবিলি।
হাঁটতে-হাঁটতে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল সাহেদের।মা বলেছেন যেখানেই যাবি বাপ,
সাবধানে থাকিস।তোর জন্যে আমার বড় ভয় হয়-রে,তুই আমার একমাত্র সম্বল।
বলতে-বলতে মায়ের চোখে পানি চলে এসেছিল।সাহেদেরও।তাই সে কিছু বলেনি।বলতে
পারেনি।তখন মায়ের হাত ধরেছিল শিরিন।বলেছিল--কী-যে বলেন আপনি তার ঠিক নাই,
ছেলে চাকরী করতে যাচ্ছে,কোথায় জান ভরে দোয়া করবেন,তা নয়----।
শিরিনও কথা শেষ করতে পারেনি ।ওড়নায় মুখ ঢেকে চলে গেছিল পাশের ঘরে।মা নিজের
চোখ মুছতে-মুছতে চলে গেলেন তাকে সান্তনা দিতে।
হতভম্ব সাহেদ স্যুটকেস হাতে তুলে বলেছিল--মা এলাম গো,শিরিন আসি।
এখন সাহেদ বুঝতে পারছে,কেন ঘরের ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসেনি।অশ্রুর ভারে
ওদের দুজনের বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল।
মা না হয় কাঁদবে।কিন্তু শিরিন কেন কাঁদে?শিরিন তার কে?
শিরিন তার কে,এই কথাটি অনেকক্ষণ বিড়বিড় করল সাহেদ।তারপর নিজেকে শুনিয়েই বলল--
জানি না,আজ অব্দি বুঝতে পারিনি ওই বিজলী-চোখো মেয়েটিকে।
ভাবতে-ভাবতেই সাহেদ দেখতে পেল গাছপালার আড়ালে থাকা হলুদ রংয়ের বাড়িটিকে।
বুঝল ওটাই সেই পঞ্চায়েত-ভবন।দ্রুত হাঁটলো সেদিকে।
ঘড়ি দেখে নিজেই লজ্জিত সাহেদ।বারোটা দশ।জীবনের প্রথম চাকরীর প্রথমদিন,তাও কিনা
লেট!
হলুদরঙা দোতলা বাড়ি।চারদিকে পাঁচিল-ঘেরা।সামনে লোহার গেট।আধখোলা অবস্থায়।
নিচের বারান্দায় গ্রীল।সেখানে তালা ঝুলছে।তারমানে বারোটা বেজে গেছে,এখনও অফিস
খোলেনি?নাকি খোলা ছিল এতক্ষণ,অন্য স্টাফরা টিফিনে গেছে।কিম্বা এমনও-তো হতে
পারে,জুম্মার নামাজ পড়তে গেছে সবাই।
চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সাহেদ।কী করবে ভেবে পাচ্ছে না সে।ঠিক তখনই সে শুনল
মানুষের কন্ঠস্বর।খুশিতে ভরে উঠলো তার মন।একমাস রোজার শেষে ঈদের চাঁদ দেখলে যেমন
খুশি হয়,এ-যেন ঠিক তেমন-ই খুশি।
সাহেদ শুনল দোতলায় কোন একজন কাশছে।যে-ই হোক সে একজন মানুষ।গ্রহান্তরের মত
মাঠের মধ্যে পড়ে থাকা এই পঞ্চায়েত-ভবনে এখন মানুষের উপস্থিতি যেন চাঁদে মানুষ থাকার
মতই বিষয় একটি।সাহেদের মনে হলো তেমনই।
সাহেদ আরো আশ্চর্য হলো,যখন সে দেখল,দোতলায় ওঠার সিঁড়িটি একেবার কোণে,নারকেল
গাছের আড়ালে।
হাতে চাঁদ পাওয়া যাকে বলে তাই হলো সাহেদের।তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলো সে।
পাক দেওয়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।একপাশে পড়ে আছে একটা তালা-মারা ঘর।তার লম্বা
বারান্দা চলে গেছে সামনে।
বারান্দার শেষে রাস্তাটা দু-ভাগ হয়েছে।ডানদিকের থেকে ভেসে আসা গন্ধ বুঝিয়ে দিচ্ছে ওদিকে
বাতরুম।তাই বামদিকের বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেল সামনে।সেখানেই সে দেখল লোকটাকে।
মাঝবয়সী লোকটা প্যান্টের বেল্ট খুলছে আর লাগাচ্ছে।সম্ভবত পেটের মেদ কতটা বাড়ছে
তাই পরখ করছে।সাহেদ তাকে বলল--আচ্ছা,আর-আই অফিসের লোকজন কোথায় গেছে।
---তা-তো আমি বলতে পারব না,ওরা যে কখন যায়,কখন আসে ,কেউ জানে না,কি বলো
হলধর?
হলধর নামের লোকটি এতক্ষণ বিড়ি টানছিল আর ধোঁয়া ছেড়ে কাশছিল।সে মাথা নেড়ে বলল--
ওদের খবর আমরা জানি না।
উদ্বিগ্ন সাহেদ বলল--তাহলে ওদের খোঁজ কোথায় পাব বলুন,মানে ওদের ফোন নম্বর যদি থাকে?
--ওদের ফোন-টোন বাপু আমি জানি না,আমরা ওদেরকে দেড়শো টাকায় ঘর ভাড়া দিয়েছি,তাই
তো দুবছর ধরে দেয় না।বলতে-বলতে পাশের ঘরে ঢুকে পড়ল প্যান্টের বেল্ট লাগানো লোকটি।
হতাশ সাহেদ দেখল,বিড়ি টানা লোকটি ঢুলতে শুরু করেছে।বুঝল এদের দ্বারা কোন কাজ
হবে না,যা করার তা নিজেই করতে হবে।
(পরের কথা জানতে পড়ুন---আগামী পোস্ট--অন্তরালের মুখ--২)