somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের দায়...

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কেন নতুন প্রজন্ম এত সোচ্চার হলো? কারণ তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে, লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে রাজাকাররা চলে যাচ্ছে! মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা প্রজন্মকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন ক্ষমতাবানরা। আর একটা প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে পারেনি। কারণ কিছু লোক তাদের কণ্ঠরোধ করে রেখেছিল। আর ’৭১-এ যারা নির্যাতিত হয়েছিল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, স্বজন হারিয়েছিল, স্বাধীনতার পর আবার অসহায় হতে খুব বেশিদিন লাগল না তাদের। সংবিধানের গণতন্ত্র যখন বিশেষ জায়গায় বন্দী হয়ে পড়ল তখন সুবিধাবাদী রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে বসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ক্ষমতার হিসাব আর রাজনীতির বিচ্যুতির মধ্যে জন-আবেগ, জন- আকাক্সক্ষা কোনো জায়গা পায়নি। মূল্য পায়নি। কিন্তু রাজনীতি যতই সেই চেতনাকে ব্রাত্য করে রাখতে চেয়েছে; সাধারণ সমাজ, তরুণ প্রজন্ম ততই তাকে ঘিরে উন্মথিত হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে সেই আবেগ একটা পরিণতির দিকে এগুলো। সুশীল সমাজের চালিয়ে যাওয়া আন্দোলনের মশালের আলোয় আলোকিত নতুন প্রজন্ম সোচ্চার হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। আবেগ প্রাবল্যে অনেক সময় যুক্তিতর্ক হারিয়ে যায়। কিন্তু একাত্তরের চেতনার সঙ্গে জন-আবেগের মিশেলে গণদাবিতে পরিণত হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
কিন্তু শুধু আবেগে রাজনীতি হয় না। কান পাতলেই সেটা শোনা যায়। তবে তর্কহীনভাবে বলা যায়; রাজনীতিতে আবেগের একটা জায়গাও আছে। আবেগ রাজনীতির একটা অনুঘটক বটে। প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভাষা-ই হয় প্রধান। গণতন্ত্রের যে স্তরে আমরা আছি তাকে কিঞ্চিৎ উন্নতি ঘটাতে হলে নানা সামাজিক চাহিদার স্বীকৃতি আবশ্যিক। রাজনীতির পরিসরেও সেই সব চাহিদার প্রবেশ আবশ্যিক। অধিকার সমৃদ্ধ নাগরিক চেতনা বিক্ষিপ্ত হতে পারে। কিন্তু তা রাজনৈতিক প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ নয়। সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব্ও আবার সিভিল সোসাইটির ছিল। তারা সেটা কতটা প্রমাণ করতে পেরেছেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে এটা ঠিক একটা সিভিল সোসাইটির গড়ে তোলা আন্দোলন রাজনৈতিক সমর্থন না পেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো কঠিন একটা বিষয় বাস্তবে রূপ নিত না। তবে সামাজিক সেই দাবির প্রতি কখনো কখনো ক্ষমতাসীনদের উদাসীনতা ,অবহেলা সামাজিক জীবনকে বিপন্ন করেছে। ঠেলে দিয়েছে নৈরাজ্য, হতাশার দিকে। রাষ্ট্রকেও গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। আসলে তখন বাংলাদেশের অন্তরাত্মার সব মূল্যবোধকেইতো বিসর্জন দেয়া হয়েছে।
আবার সেই বাংলাদেশই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাসের দায় মিটিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করেছে। হয়ত জাতির বিবেক জেগে উঠতে সময়টা একটু বেশি লেগেছে। হয়ত তার পেছনে একটা মর্মান্তিক ইতিহাসও আছে। যে ইতিহাসের দায় এদেশের মানুষের চেয়ে ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের একটু বেশি। তাদের হাত ধরেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শক্তি বৃদ্ধি করল। অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের শক্তি বাড়ানো হলো। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কাম্য ছিল অনেক মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য। দুর্ভাগ্যজনক সত্য; হলো উল্টো। ঐক্যমত্য হলো না অনেক বিষয়ে। তাতে যতটা ক্ষতি হলো তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হলো নাগরিক এবং সমাজ জীবনে বিভাজন রেখাটা ক্রমশ বড় হয়ে যাওয়ায়। রাজনৈতিক বিভাজনটা আরও বড় হলো স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে! আর এই বিতর্কে বড় একটা জায়গা পেয়ে গেল সেই সব লোক যারা এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনি। যারা এই দেশটাকে চায়নি। যারা এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের মধ্যে বসবাস করলেও নিজের দেশ মনে করেন আরও দূরের কোনো দেশকে। সেটা ভৌগোলিকভাবে না হলেও চেতনায়, ভাবনায়, রাজনৈতিক দর্শনে অন্য এক দেশকে লালন করেছেন তারা নিজেদের মনে। ধারণ করেছেন জীবনযাপনে। আর সেই ভাবাদর্শের বিস্তার ঘটিয়েছেন ধর্মীয় মোড়কে। তারা বার বার আঘাত করেছে স্বাধীন দেশের অন্তরাত্মার ওপর। তাকে করেছে ক্ষত-বিক্ষত। করেছে রক্তাক্ত। আর তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি যত বেড়েছে ততই বেড়েছে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা। স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে, চক্রান্ত করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল ওই চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার রাজনৈতিক এবং নাগরিক ক্ষমতা!
তবে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া স্বাধীনতাবিরোধীরা যেমন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি; একইভাবে তাদের ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরিয়ে দিতেও প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। সেটা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করল নতুন প্রজন্ম। তারাই বেশি সোচ্চার হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে। সিভিল সোসাইটি যে আন্দোলনের মশালটা জ্বালিয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ’৯২ সালে, সেটা আরও বেশি জ্বলে উঠল সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের হাত ঘুরে তরুণ সমাজের হাতে পড়ায়। ক্ষমতাসীনরা যে অঙ্গীকার করেছিল নির্বাচনের আগে তা পূরণের জন্য চাপ সৃষ্টি করে চলেছে নতুন প্রজন্ম। যারা যুদ্ধাপরাধীমুক্ত এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে। তাদের সেই স্বপ্ন যাত্রার পথটাকে মসৃণ করে দিতে সিভিল সোসাইটি পেছন থেকে শক্তি যুগিয়ে চলেছে। যার ফলে স্বাধীনতার ৪২ বছর পর হলেও ’৭১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে চিহ্নিত রাজাকারদের বিচার চলেছে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। একজনের ফাঁসির রায় ঘোষণা হয়েছে। গোটা দেশ অপেক্ষায় আছে আরও কিছু রায় ঘোষণার।
তবে এর মাঝেও রাজনীতির কারবারিদের একাংশ কোরাস গাইছেন, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিচারের পক্ষে তারা। পরোক্ষভাবে নয় প্রত্যক্ষভাবে তারা এ বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। বিস্মিত হতে হয় তাদের কথা শুনে! এই সব রাজাকার কি ’৭১-এ কোন আইনকানুনের কথা মনে রেখে খুন করেছিল নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষকে! লুটে নিয়েছিল অসহায় মা-বোনের সম্ভ্রমকে! আজ যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের কথা বলছেন তারা কি অস্বীকার করবেন ’৭১ এর শহীদদের? অস্বীকার করবেন সেই সব মা বোনকে যারা ’৭১ এ নির্যাতিতা হয়েছেন? যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা যারা করছেন তাদের জন্য শুধু করুণা হয়! কারণ তারা হয়ত নতুন প্রজন্মের বার্তাটা ঠিক পড়তে পারছেন না। কিংবা শুনতে পাচ্ছেন না। এবং দেখতে পাচ্ছেন না ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির খোলস থেকে বেরিয়ে নতুন এক বাংলাদেশের নব জাগরণ হচ্ছে।
নতুন আধুনিক সেই বাংলাদেশ মানে শুধু রাজনীতিবিদদের মুখনিঃসৃত ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়। আধুনিকতা মানে আইফোন আর ইন্টারনেট ব্যবহার নয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও যদি কেউ ধর্মান্ধ হয়ে পড়ে থাকে তাকে নতুন আধুনিক বাংলাদেশের নাগরিক ভাবা কঠিন হবে। আধুনিক বাংলাদেশে বাস করবেন আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ’৭১-এর গণ্ডগোল বলবেন, সেটা অবশ্যই মিসটেকেন মার্ডানিটি। আর তা অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। একইভাবে অগ্রহণযোগ্য যদি কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে রাজনীতি করেন। কিংবা করতে চান। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শেষ পর্যন্ত যেন সংকীর্ণ রাজনীতির হাতিয়ার না হয়ে দাঁড়ায় সে ব্যপারেও দায়িত্বটা কাঁধে নিতে হবে সেই নতুন প্রজন্মকে। যারা আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চান। যারা স্বপ্নে বিভোর থাকতে চান না। যারা বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে চান। জয় করতে চান আগামী দিনের কঠিন চ্যালেঞ্জকে। কিন্তু নিজেদের রক্তাক্ত গৌরবময় অতীতকে ভুলে গিয়ে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা ভাবা যায় না। আবেগ এবং যুক্তি, ইতিহাস এবং সমসাময়িক আমাদের সে কথাই বলে দেয়।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×