somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঝিলিমিলি ভোর - ৭ই নভেম্বরকে নিয়ে একটা শিশুতোষ উপন্যাসের প্রথম অংশ

০৭ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝিলিমিলি ভোর - ৭ই নভেম্বরকে নিয়ে একটা শিশুতোষ উপন্যাসের প্রথম অংশ

(সাতই নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিবস। একদলীয় বিভীষিকাময় দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে সিপাই জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে রুখে দেয়ার এই দিন। আজকের বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের যে শত ফুল হাজার ধারায় ফুটছে , যে বহু সংবাদ মাধ্যমের বিকাশ ঘটছে, লক্ষ মানুষের মত প্রকাশের যে ধারা যাত্রা সূচিত হয়েছে তার শিকড় প্রোথিত রয়েছে এই দিবসে। সে কথা অনেকেই ভুলে গেছেন, কেউ কেউ তা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে দ্যুতিময় প্রভাতের বিকাশই কেবল ঘটেছে। আধার পালিয়ে গেছে বারেবারে। তবুও অন্ধকারের কাপালিক প্রভু এবং তাদের চেলারা নিবৃত্ত হননি। আজও তারা ওত পেতে থাকেন। আজও তারা কৃষ্ণ নি:শ্বাসে ডুবিয়ে দিতে চান মানুষের বিজয় গাথাকে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে আমরা স্পর্শ করব সেই দিবসের সোনালী সুর্যোদয়কে।
অন্ধকারের প্রভুদের অতীত এবং চলমান অপচেষ্টার প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হল শিশুতোষ উপন্যাস ঝিলিমিলি ভোর। আজ তার প্রথম পর্ব প্রকাশ হল।)


ঝিলিমিলি ভোর
সুন্দর সমর


পূবের জানালা দিয়ে সুর্যি মামার আলোর হাত ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিকে পাখির কাকলিকে ছাড়িয়ে জোরাল হয়ে উঠেছে ফেরিঅলাদের ডাক। ঝিনু আস্তে আস্তে বিছানার উপর উঠে বসল। এত বেলা করে কখনও ওঠে না। রোজ রোজ কাক ডাকা ভোরে চারদিক যখন পাখীর পালকের মত নরম আলোয় ভরে থাকে আব্বু বা ভাইমনির ডাকে ঝিনুর ঘুম ভেংগে যায়। ‘ভোর ***** দোর খোল খুকুমনি উঠরে’ আউড়ে আব্বু ওকে ডেকে তোলেন। ভাইমনি, ‘আপামনি এ্যাই আপামনি’ বলে আস্তে আস্তে ঝাঁকাতে থাকেন। এভাবে এক সময় ঘুমের শেষ রেশটুকুও ঝিনুর চোখ থেকে ঝরে যায়। আর ও ঝটপট উঠে বসে। তারপর, হ্যাঁ তারপর বেরিয়ে আসার পালা। সকালের এই বেরিয়ে আসার জন্যেই এতও আয়োজন। মিষ্টি আলোমাখা সাত সকালে বেরিয়ে আসার জন্য ঝিনু একেবারে অস্থির হয়ে থাকে। সকালের সে বেড়ানর আনন্দ আর যেনও কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এক একদিন বেড়াতে না পারলে ওর মনে হয় দিনটা কাল হয়ে গেল। কিংবা বাসি দুধের মত টক হয়ে উঠল। তবে আব্বু এই এতটুকু হেঁটেই ফিরে আসেন। ঘরে ফিরে আব্বু এ্যাই মোটা মোটা সব বই নিয়ে পড়তে বসেন। আব্বুকে স্কুলে যেতে হয় না । কেউ পড়া জিজ্ঞাসা করে না। কিংবা কঠিন কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না। তবুও আব্বু রোজ রোজ কি যে ছাই পড়েন! ঝিনু বুঝে উঠতে পারে না। বইগুলৈা সব প্যাঁচার মত। একটাও ছবি যদি থাকত। বড়দের বইতে ছবি থাকবে না কেন? বড়রা কি ছবি দেখতে জানে না। যত সব ঘোড়ার ডিম। যত সব ‘কুরুক্কামারী!’ আসলে ঝিনু নিজেও জানো ‘কুরুক্কামারী’ জিনিসটা কি। তবে ওর বলতে ভাল লাগে। তাই বলে। কোন কিছুর উপর বেজায় রাগ হয় বা যখন কোন কিছু খুব ভাল লাগলে তক্ষুনই ও ‘কুরুক্কামারী’ বলে বসে। এই যেমন ভাইমনির সাথে ভোর বেলায় হেঁটে বেড়ানো মজার ‘কুরুক্কামারী’ ভাই মনি অনেকদুর পর্যন্ত হেটে আসেন। চলার ফাঁকে ফাঁকে রাজ্যির গল্প ভাইমনি শোনান। এইত সেদিন শোনালেন গ্যালিভারে গল্প। ভদ্রলোক একবার দত্যির দেশে আবার লিলিপুট নামের বামনদের দেশে গিয়ে কি সব মজার মজার কান্ডই না করলেন। ঝিনু ভেবেছিলো ভদ্রলোক বোধ হয় এখন অবধি বেঁচে আছেন। ওমা পরে শোনে ওটা বানানো গল্প। এ ছাড়া ভাইমনি ওকে শুনিয়েছেন হজরত নুহ নবীর কাহিনী। কি ভীষণ বন্যাইনা হল তাঁর সময়। আল্লাহকে মানার জন্যে নূহ নবী বেঁচে গেলেন। সে সাথে বেঁচে গেল তাঁর লোকজন। নূহের ছেলেটার জন্যও ওর খুব কষ্ট লাগল। আহা বেচারা! আব্বুর কথা শোনেনি। আল্লাহকে মানেনি। তাতেই না শেষতক ডুবে মরল।
এক বুক কষ্টের কথা মনে হতেই ওর কষ্ট লাগল টম চাচার জন্য। টম চাচার গল্পটাও বলেছেন ভাইমনি। শুধুমাত্র রং কালো বলেই না তার উপর কত অত্যাচার হত। কতগুলো দুষ্ট শাদা দিন রাত বেচারা টম চাচাকে দিয়ে খাটিয়ে নিত। তাঁকে পেটপুরে খেতে দেয়া হতনা । অমন খাটুনি আর মারধরের চোটে শেষে মরেই গেলেন ভাল মানুষ টম চাচা। বেচারা!! ভাই মনি বলেন, টম চাচা মারা গেলে কি হবে এখনও কালো মানুষদের উপর অত্যাচার কমেনি। এখনও নাকি কালো মানুষদেরকে বাগে পেলেই আগের মতই মারধোর করে নচ্ছার কিছু শাদা মানুষ । ঝিনু আপন মনে ভাবে, বারে কালো হওয়া কি ওদের দোষ। খোদাইত সবাইকে শাদা কালো করে বানান । আচ্ছা এমন হয় না সব শাদা মানুষদের একত্র করে ভালভাবে বুঝিয়ে দেয়া হল যে নিজের ইচ্ছেয় কেউ শাদা বা কালো হতে পারে না। তারপর শাদা মানুষগুলো নিশ্চয়ই কালোদেরকে আর এমন মারধর করবে না । এরপর যদি কোনও শাদা লোক কালো মানুষকে মারধর করে কখনও সখনও যদি কেউ দুষ্টুমি করে তবে? হ্যাঁ সে জবাবও ও তৈরি করে রেখেছে। স্কুলে পাজী ছেলেদেরকে যেভাবে কষে বেতিয়ে দেয়া হয়, অমনি করে বেতিয়ে দেয়া হবে দুষ্টু শাদাদের। এ রকম কি হতে পারে না! আচ্ছা ভাইমনিকে পরে এক সময় জিজ্ঞাসা-টিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়া যাবে। ভাইমনি আজকে যেন কোন গল্প বলবেন? ওহ হো সাদ্দাতের গল্প। ভাইমনি আগে ভাগেই গল্পের নাম বলে দেন। আবার গল্প বলার সময় জিজ্ঞাসা করেন কোন গল্প বলব যেন? ঠিক ঠাক নাম বলতে না পারলে হাঁদা টাদা বলে ফেলেন। আজ যে, উঠতে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তাহলে কখন বেরিয়ে আসা হবে। আর কখনইবা ঝিনু ভাইমনিকে গল্প শোনাবেন। দুর ছাই! আজ ঝিনুর দোষ নেই। ওকে সকালে কেউই ডাকই দেয়নি। বারে এমনত হয় না কখনও। নরম, চপ্পল পায়ে জড়িয়ে ঝিনু ভাইমনির খোঁজে চলল। ফাঁকি দেয়ার মজা দেখাবে। আজকে ও ভাইমনিকে উট বানিয়ে রাখবে। এইত দিন দুই আগে ঝিনু বার বার বলেছে,
-‘ভাইমনি একটা গল্প বল না। প্লিজ মাওর একটা গল্প বল না।’ কিন্তু ভাইমনির কান্ড দেখ, গল্পত বলছেনই না উল্টো ভেংচি কাটছেন। ইশ! ঝিনুর বুঝি রাগ নেই না। ঝিনু ঝপাৎ করে ভাইমনির চুল ধরে টেনে নিয়ে চলল। অগত্য ভাইমনি মাথা নিঁচু পিঠ উচু বেঢপ উটের মত ঝিনুর পিছু পিছু যাচ্ছিলেন। সাথে কি চেঁচানি, ‘এই আপা মনি চুল ছাড় ছাড় লাগছে।’ যে উহু ঝিনু ভাইমনির চুল কিছুতেই ছাড়বেনা। ভাইমনি শেষকালে চেচামেচি জুড়ে দেন, ‘এই আম্মু আম্মু! তোর মেয়ের কান্ড দেখ আমার চুল ছিড়ে ফেলল। উহঁহুঁ আমার মাথা গেলরে।’ ভাইমনি সত্যি সত্যি ব্যাথা পাচ্ছেন? হায় আল্লাহ্ চুল ছেড়ে দিতেই ভাইমনি সোজা দাড়িয়ে হা হা করে হাসনে থাকেন আর বলেন, ‘বাহ কি মজা ঝিনুকে গোল দিয়েছি।’ তবে ঝিনু মন খারাপ করার ফুরসৎ পায় না। ভাইমনি ওকে কোলে তুলে নেয় এবং দিব্যি ঘাড়ে চড়িয়ে একপাক চক্কর দেয়। আম্মু সে সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। আজ যাই হোক ঝিনু ভাইমনি চুল ছাড়বেই না। সে অবধি ভাইমনি না বলছে, ‘আর এমন করব না।’ ঝিনুকে রোজ রোজ ভোরে ডেকে দেবেন। গল্প শোনাবেন। বেড়িয়ে নিয়ে আসবেন বলে যে পর্যন্ত কথা না দেবেন সে পর্যন্ত ভাইমনিকে ঝিনু ‘উট’ বানিয়ে রাখবেই রাখবে ।

মাঝের ঘরে ঢুকে ঝিনু অবাক। ওর চোখ বড় বড় হয়ে উঠে। দেখে আব্বু আম্মু, ভাইমনি, ভাইয়া, আপা ও মেজ আপা রেডিওর চারপাশ ঘিরে বসে আছেন। আব্বু রেডিওর নব ঘোড়াচ্ছেন। অথচ রেডিওতে শো শো ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। আব্বু একবার হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। ঝিনু শুনতে পায় আববুর স্বর-‘সাতটা বাজে।’ ও বুঝতে পারে কোথাও মস্ত গড়বড় হয়েছে। এ সময় আম্মু রান্নঘরে দম ফেলার ফুরসত পাননা। নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন । ভাইয়া হয়ত দাঁত মাজছেন। ভাইয়া সব সময় সুর্যি অনেকদুর ওঠা পর্যন্ত ভোস ভোস করে ঘুমান। আববু বলেন, গাধার মত ঘুমায়। গাধা কি অনেকক্ষণ ঘুমায়? ঝিনু এক একবার ভাবে আব্বুকে জিজ্ঞাসা করলে মন্দ হয় না। তারপর কেন যেন আর জিজ্ঞাসা করা হয় না। সে সময় পাশের বাসার ঝুমু আপা হারমনিয়াম নিয়ে চেঁচান। ঝিনু নিজে নিজেই থুক্কু বলে জিভ কাটে । বাপরে ঝিনুর আপা যদি শোনেন কথাটা তবে নির্ঘাৎ কান চেপে ধরবেন। ঝিনু সেদিন সবে মুখ ফুটে ঁেচচান বলেছে আর যায় কোথায় অমনি কান টান চেপে টেনে নান্তানাবুদ করে আপা বলেন,
-‘একে বলে গলা সাধা, বুঝলি। হাঁদা, যারা গান গেয়ে থাকে তারা সবাই গলা সাধে।’ হুঁ ঝুমু আপার গান ওতো চেচানো। থাকগে বাবা এই সক্কাল বেলায় কান মলা খেয়ে কাজ কি। ইয়ে মানে গলা সাধেন। ঝিনুর আপাটা যে এক্কেবারে খড়ে দজ্জাল। যেন কি একটা । ঝিনুকে যা-তা বলে বকে থাকেন।
-‘সরাদিন ঝিনুর নাকি একদন্ড চই নেই। দুষ্টুমি দুষ্টুমি আর বুড়ি বুড়ি কথা বলা।’ একটু খেলাধুলো করলেই দুষ্টুমি হয়ে গেলো। ধ্যাৎ ঝিনুর কপাল কুঁচকে উঠে। আপার বলার শেষ নেই। মাঝে মাঝে ঝিনুর মাথায় চিন্তা বুড়োরা দলবেধে বাসা বাধে। সে সময় ঝিনু নাকি সারদিন গুম হয়ে বসে থাকতে পারে। আচ্ছা আপাটা এমন কথা কেনো যে বলে। একটু চুপচাপ বসে থাকলেও দোষ। কি বলবে ও সাতপাঁচ ভেবে পায় না। নিজেই নিজকে বলে-‘বাপু সারাদিন খেলাধুলো করতে বুঝি কারও ভাল লাগে?’ ঝিনু ভাবে আপাকে জোরে চেচিয়ে এটা বলবে। তারপর সাহস পায় না। চেচানো তো দুরের কথা আস্তে করেও বলা হয় না। আপার কথার এখানেই শেষ নয়। তিনি আরও বলেন,
-‘রাজ্যির কথা ঝিনুর মনে থাকে কেবল অংক বাদ দিয়ে। সেই কবে অদ্যিববিদ্যকালে কি ঘটেছে ও দিব্যি মনে রাখতে পারে।’ এমন কথা বলা হলে ঝিনু মাথা নাড়ে ইশ অংক যে বিচিছরী। ওগুলো কি ইচ্ছে করলেই মনে রাখা যায়। মোটেই না। পুরোনো যা সব কথা এুি এুি মনে থাকে। ও সব কি আর কষ্ট করে মনে রাখতে হয়। একটা কিছু দেখলেই সেটার মত পুরানো আর একটা কিছু আপনা আপনিই মনে পরে যায়। একেবারে পানি মত মনে পড়ে যায়। আর অংক তো পানি বা তেমন কিছু নয়। একটা অংকের সাথে আর একটার কোন মিল ঝিনু খুঁজে পায় না। সবটা মনে হয় গোবরের মত বিদঘুটে। তবে ভাইমনি ঝিনরু এ কথা শুনে মিটিমটি হাসেন। বলেন,
-‘দুর অংক মোটেও বিচ্ছিরি নয়। তোর কাছে একটু কঠিন মনে হলে কি হবে অংক ছাড়া দুনিয়া একদম অচল। সারাদিন আমাদের সকল রকম কাজে অংকই সবচেয়ে বেশি লাগে। কোনটা বড় কোনটা ছোট থেকে শুরু করে যা সব হিসেব-নিকেশ সবই যে অংক দিয়ে করতে হয়। একটু বড় হলেই অংক ভাল লাগবে।’ তা যাক, আপা ঝিনুকে মারধোর করতে আসলে আব্বু ধমকে দেন। কিন্তু বাঁকানো চোরানো কথা বললে বেশির ভাগ সময়ই আপাকে কিচ্ছুটি বলেন না। বরং আব্বু মিটি মিটি হেসে বলেন, ‘ঝিনুমনি আমার ফুকুর মত হয়েছে।’ আব্বুর ফুফু খুব ছোট বেলায় ঝিনুর মত দুষ্ট ছিলেন। আর বুড়ি বুড়ি কথা বলত বলে তার নামই বুড়ি হয়ে গেছে। বুড়ি দাদীকে নিয়ে এ কথা বাসার সবাই জানেন। ঝিনু আদপেই তা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। আব্বুর ফুফুরা ছোট থাকতেই পারেন না । তারা অমন থুড় থুড়ে বুড়ি হয়েই থাকেন সব সময়। কিন্তু ঝিনু তো অমন থুড়থুড়ে নয়। তা ছাড়া ঝিনুকে কেউ বুড়ি বলে ডাকে না। যতোসব পচা কথা। কিন্তু মুশকিল হল, আব্বু এ সময় আপার দলে চলে যান। আর ঝিনুর মেজাজ বেজায় চটে উঠে। সববাইকে একটু খামচে দিতে পারলে তবেই ভাল হত। তা যখন পারার নয় তখন অগত্যা ঝিনু কাঁদ কাঁদ হতে উঠে। চেহারাটা প্যাঁচার মতো বানিয়ে ফেলে। সে সময় ভাইমনি ওকে ডেকে নিয়ে গাল গল্প ফেঁদে দিব্যি ভূলিয়ে ফেলেন। ঝিনুর মনেই থাকে না কে কি বলেছে। সকালের এ সময়টায় বেড়ানো শেষে ভাইমনি তার ঘরে বসে কোরআন শরীফ পড়েন। মজার কথা হল ঝুমু আপার গানের চেয়ে তা অনেক ভাল শোনা যায়। ঝিনু ভাইমনির পাশে বসে একমনে কোরাআন শরীফ তেলাওয়াত শোনে।


ওসব অন্য অন্য দিনের কথা। তা যাগগে। আজ ব্যাপারখানি কি! ও বুঝতে চেষ্টা করে। সেই ১৫ই আগস্টে একবার এ রকম সবাই রেডিও ঘিরে গোল হয়ে বসে ছিলেন । সবার মুখে হাসি উপচে পড়ছিলো। সে সময় আববু বলছিলেন, নাসরুম মিনাল্লাহে ওরা ফাতহুন ক্বারিব। সেদিন ভাইমনিকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। ঝিনুকে কোলে তুলে নিয়ে দুর্দ্দাড় ঘুরপাকআর পাগলাটে নাচ শুরু করে দেন। আম্মুর হাসি ফেটে পড়ছিলো। বাসার সবার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিল রুপকথার রাক্ষস মরে যাওয়ার বন্দী পাথর রাজপুত্তুররা মুক্তি পেয়ে প্রান মাতানো হি হি হো হো হাসির হুররায় মাতোয়ারা। আব্বু ভাইমনিকে বলছিলেন এবার দেখবি দেশের ভালো হবে। ভাইমনি বললেন,
-‘ আব্বু ওরা যে, চার ধার ঘিরে আছে। যদি আসে? হামলা চালাবে নাত?’
-‘নারে পাগল সে ভয় নেই । আর ওদেরও সে সাহস নেই। একি এতই সোজা। আসল কথা হচ্ছে দেশের লোক। দেশের লোকের বিরুদ্ধে যেয়ে কেউ কোন কালে কিছুই করতে পারেনি। তা তারা যতই বড় হন এবং তাদের যত বেশিই কামান, বম্বার, ফাইটার, সৈন্যই থাকুক না কেন ।’
-‘না আমার মনে হয় তারা যে চেষ্টা যে করবে না তা নয়। যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে তাকে কেউ এমনিতেই ছেড়ে দেয়?’ ভাইমনি বলেন।
-‘সবার উপরে রয়েছেন আল্লাহ তারও একটি বিচার আচার আছে।’ আম্মু ভাইমনির উপর যেন বিরক্ত হয়ে বলে উঠেন । তিনি এবার পষ্টা-পষ্টি বলেন,
-‘তুই বাপু যাই বলনা কেন, আমি খুশি হয়েছি। এবং এ কথা জোরে চেচিয়ে বলতে আমার কোনো ভয় নেই।’
ভাইমনি জবাবে বললেন -‘আহা আমিও খুশি কি কম হয়েছি। কিন্তু তা বলে এখনই হৈ চৈ না করে একটু দেখে নিলে হয় না শেষ পর্যন্ত কি হয়?’
-‘ও সব দেখাদেখি আমাকে দিয়ে হবে না। আমি খুশি হয়েছি। ব্যস, এই সহজ কথা চেঁচিয়ে বলব। তাতে যা হয় হবে উ! কতদিন কথা বলতে পারিনি। ভয় ভয়! রাতে ঘুম আসেনি। নিত্যদিন এখানে ডাকাতি । সেখানে খুন। হাইজ্যাক। রাস্তায় না খেয়ে পড়ে থাকা লাশ। মাগো!’
আপা মেজপা মাথা নেড়ে ঘাড় কাত করে আম্মুর কথায় সায় দিয়েছিলেন। আজ কি হল? ঝিনু ভেবে পায় না। আশে পাশের ষ্টেশনে নব ঘুরিয়ে ট্যা ফো ভেসে আসছে। অথচ শুধু ঢাকার জবান বন্ধ। সবার মুখ থমথমে । ভাই মনি উঠে যেয়ে টেলিফোন নিয়ে পড়লেন। আব্বু প্রশ্নের জবাবে জানালেন ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি, কোথায় যেন ওর বন্ধু থাকে তাকে ফোন করছে। ঝিনুকে কি সবাই ভূলে গেছে। সেই কতক্ষণ অবধি ও দাড়িয়ে আছে অথচ কেউ ওকে দেখছেই না । কাছে টেনে নিচ্ছে না। ভাইমনি এমনভাবে ডায়াল ঘোড়াচ্ছেন যেন একটু এদিক ওদিক হলে মহা কিছু একটা ঘটে যাবে। বাকী সবার নজর আটকে আছে রেডিওর দিকে। চোখ সরিয়ে নিলেই যেন রেডিও পাখনা মেলে চম্পট দেবে। রেডিওর শো শো টেলিফোনের ডায়াল ঘোরানোর শব্দ, ডায়াল ঘোরা শেষ হতেই ক্রাডেলে টোকা দেবার আওয়াজ আবার ডায়াল ঘোরানোর শব্দ, একটানা শো শো ঝিনুর মনে হল, ও যেন একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখছে।
খুট। ভাইমনি আশা ছেড়ে দিলেন। ফোন রেখে জানালেন,-‘ লাইন পাওয়া যাচ্ছে না।’
ভাইয়া হঠাৎ কথা বলে উঠেন-‘আব্বু যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য হয়ত রেডিও খুলতে পারছে না।’ ঝিনু ভাবল আব্বু এই বুঝি ভাইয়াকে ধমকে উঠবেন,- ‘একশ দিন মানা করেছি তোমার বাপু বড়দের বিষয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। যা বোঝনা সে বিষয়ে আবোল তাবোল বকতে আস কেন? লম্বা বোকা, ধলা গাধা বুদ্ধিশুদ্ধি আর ***** না ।’ আব্বু ভাইয়ার উপর চটে উঠলে এমন ধারা কথা বলেন। বাসার সববাই বলে ওর নাকি বুদ্ধিসুদ্ধি কম । না আজ আব্বু দপ করে রেগে উঠলেন না, শুধু আস্তে আস্তে বললেন জাতীয় বেতার যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য..’, হাতের ঘড়ি দেখে নেন, ‘এক ঘন্টা বন্ধ, কেউ বিশ্বাস করবে? এর ভেতরে বড়সড় ঘাপলা আছে।’
-‘ কাল শহর জুড়ে ওরা কাগজ ছড়িয়েছে কি এক শোক দিবস। আজ এই অবস্থা, নিশ্চয়ই এর পিছনে অন্য কিছু আছে।’ ভাইমনি বললেন। আব্বু আবার রেডিওর নব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকেন। না, সেই একই অবস্থা । ভূতের কান্নার মত শো শো আওয়াজ। নব ঘুরিয়ে রেডিও বন্ধ করে দিয়ে আব্বু উঠে পড়েন। ভারী ভারী পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন--‘আমরা বোধ হয় আবার গোলাম হলাম। হায় আল্লাহ্ ।’
আম্মুর এ্যাই এতক্ষনর পর খেয়াল হল ঝিনু নামে কেউ এ বাড়ীতে রয়েছে এবং সে আম্মুর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আম্মু ওকে নিয়ে বাথরুমের দিকে চললেন হাত মুখ ধুইয়ে দিবেন। ঝিনু যে নিজে হাতমুখ ধুতে পারে না, তা নয় । আসলে আম্মু হাতমুখ ধুইয়ে দিলে ঝিনুর খুব ভাল্লাগে। কি মিষ্টি করে পানি ছিটিয়ে নরম করে রগড়ে হাতমুখ ধুইয়ে দেন আম্মু। সে সময় ঝিনুর আরাম আরাম লাগতে থাকে। ওর এই আদুরেপনার কারণ যে আম্মু জানেনা, তা নয় তবুও কখন সখন রাগ রাগ ভাব করে এক ন্



০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দিশ হারা

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২

তোয়াত্তন আ`‌রে কেন লা‌গে?
গম লা‌গে না হম লা‌গে?
রাই‌ক্কো আ‌রে হোন ভা‌গে
ফেট ফু‌রে না রাগ জা‌গে?

তোয়া‌রে আত্তন গম লা‌গে
ছটফড়াই আর ডর জাগে
ছেত গরি হইলজা ফাড়ি
হইবানি হোন মর আগে।

হোন হতার হোন ইশারা
ন'বুঝি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

খাদ্য পন্যের মান নিয়ন্ত্রন

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১২

মশলা প্রস্তুতকারী কিছু ভারতীয় সংস্থার মশলায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান পাওয়া গিয়েছে।সম্প্রতি এমনই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেন্টার ফর ফুড সেফটি’। সংস্থা জানিয়েছে, ভারতীয় বাজারে জনপ্রিয় বেশ কিছু সংস্থার মশলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×