somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

থাইল্যান্ড ভ্রমন ১৯৯০ (২য় ও শেষ পর্ব)

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব - Click This Link

আজও যেন আমি চোখ বন্ধ করলে বেভার্লি কফি হাউজকে দেখতে পাই। আমাদের রুমটা ছিল দোতালায়, একদম সামনে। পর্দা সরালেই কাঁচের গ্লাসের দেয়ালের ভেতর দিয়ে রাস্তা দেখা যেত। বাস, ট্রাক, কার আর মানুষের ভীড়ে এক ব্যস্ত শহর থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক। সেই ব্যস্ত শহরের এক নির্জন রুমকে বাসা বানিয়ে নিলাম আমরা।

সকাল শুরু হতো অমলেট আর ব্রেড এন্ড বাটারের ব্রেকফাস্ট দিয়ে। বাঙালী খাবারে অভ্যস্থ এই আমার কাছে ইংলিশ ব্রেকফাস্টটা বেশ লাগতো। যদিও পরিমানে অল্প থাকতো, তবুও চলে যেত। এরপর বের হতাম শপিং-এ। প্রাতুনাম (ব্যাংকককের সবচেয়ে বড় শপিং সেন্টার) সহ অন্যান্য শপিং মলগুলো আমরা চষে ফেলতাম। আম্মুর শপিং করার অবস্থা দেখে মনে হতো সাত দিনে পারলে পুরো ব্যাংকক কিনে ফেলবে। শপিং-এ আমার আপত্তি ছিল না, কিন্তু যন্ত্রনা শুরু হতো অন্য জায়গায়। হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম, কিন্তু আম্মুর শপিং আর শেষ হয়না। মাঝে মাঝে লাঞ্চ করে নিতাম শপিং-এর ফাকে ফাকে। লাঞ্চে আমাদের ভাত দিত, সাথে একটা স্যূপের মত কি যেন থাকতো। আমার বদ্ধমূল ধারনা ছিল ওটা ভাতের মাড়। না হলে ভাতের সাথে ওটা দিত কেন!

হোটেলে ফেরার সময় হলে একটু শান্তি শান্তি লাগতো। টেক্সিতে বসে পাগুলোকে আরাম দেয়ার কথা ভাবলেই মনটা ভালো হয়ে যেত। সাধারন টেক্সিগুলো একটু ব্যয়বহুল হলেও তুকতুকগুলো বেশ সস্তা ছিল। আমাদের দেশে বেশ ছোট কিছু মাইক্রবাস আছে, যেগুলোর দুই দিকেই দরজা থাকে। সেগুলোর দরজা কেটে এবং ভেতরের সিট মুখোমুখী করে এক বিশেষ ধরনের টেক্সি বানানো হয় যার নাম তুকতুক। আমার খুব প্রিয় বাহন ছিল এটা। আমরা যখনই বের হতাম, তুকতুক নিতাম। যদিও আম্মুর খুব একটা পছন্দ ছিলনা। আম্মুর আবার বরাবরই "ঠাটে-বাটে" চলার স্বভাব! বাহিরে বের হলে টেক্সি না নিলেই মেজাজ গরম হয়ে যেত। তবে ভোটে হেরে শেষ পর্যন্ত তুকতুকে চড়তে হতো।

কয়েকদিন আমাদের দুই ভাই-বোনকে সাথে নিয়ে আম্মু বুঝে ফেলেছিল শপিং নামক ক্রিয়ার মূল তৃপ্তি তার সংসার অনভিজ্ঞ ছেলেমেয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অতএব, একদিন পরিকল্পনা হলো আমাদের রেখেই শপিং-এ যাবে। আমার বরং ভালোই লাগলো। এত হাটা আর সহ্য হচ্ছিল না। একা রুমে আমি এবং আমার ছোট বোন পিংকী রাস্তার গাড়ী যাওয়া দেখতে দেখতে বেশ কাটাচ্ছিলাম সময়। হঠাৎ পিংকী পানি খাবার বায়না ধরলো। কি বিপদ! রুমে পানি নেই। আম্মু দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল ইন্টারকমে করে কিভাবে নীচে রিসিপশনের সাথে কথা বলে। চাইলেই ওরা পানি দিয়ে যাবে উপরে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। কি বলবো ওদের? ফ্লাইটের সেই জুসের ঘটনা মনে পড়ে গেলো। কিন্তু কিছু একটা করতেতো হবে। শেষ পর্যন্ত অনেক সাহস সঞ্চার করে রিসিপশনে কল দিলাম। ওপা জানতে চাইলো কি ব্যপার। আমি কোন ক্রমে বললাম, "টু বোটল ওয়াটার প্লিজ।" একটু পর দুই বোতল পানি দিয়ে গেলো আমাদের রুমে। আমার উল্লাস কে দেখে তখন! জীবনে প্রথম আমি অবাঙালী কারো সাথে পরিপূর্ন ভাবে ইংরেজীতে কথা বলেছি। আনন্দে তখন লাফাতে ইচ্ছে করছিল। এই স্মৃতিটাও আমার সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে আছে।

ঘোরাঘোরী করেছিলাম অনেক। বিভিন্ন পার্ক এবং ভিজিটিং স্পটে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেসব স্মৃতি আজ আর পরিষ্কার মনে নেই। তবে এক রাতের কথা জ্বলজ্বলে হয়ে আছে স্মৃতিতে। সন্ধার পর আমরা হাটতে বের হয়েছিলাম। নির্জন রাস্তা ধরে হাটছিলাম। হঠাৎ দেখলাম একটা আন্ডারগ্রাউন্ডের মত কি যেন দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখলাম আলো জ্বলছে। যেই নীচে নামলাম, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। বিশাল শপিং মল। অথচ উপর থেকে একটুও বোঝা যাচ্ছিল না। শপিং মলের ভেতর দিয়ে হাটছিতো হাটছি, শেষ আর হয় না। যাইহোক এক সময় যেভাবে ঢুকেছিলাম সেভাবেই আবার হুট করে বের হয়ে আসলাম উপরের ফুটপাতে। সামনে এক বড় রাস্তা, যেখানে ভারী যানবাহন চলাচল করছে। কি করবো ভাবছি, এমন সময় একটা তেলের ট্যাঙ্কার এসে আমাদের সামনে থেমে গেলো। তারপর একটা বাস এবং তার পর অন্যান্য গাড়ী। আমার আট বছরের বালক দৃষ্টি বিস্ফরিত হয়ে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমরা আসলে একটা জেব্রা ক্রসিং-এর সামনে দাড়ানো। যদিও কোন সিগনাল ছিলনা (যেমনটা এখন উন্নত শহরগুলোতে দেখা যায়), তবুও ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এতগুলো গাড়ী থেমে গিয়েছে। নিজের মনে আমি এর পর বহুবার ভেবেছি, আমার দেশে এমন দিন কবে আসবে? এখনওতো দেখি সিগনাল ছাড়ার সাথে সাথে ড্রাইভাররা গাড়ীগুলোকে প্রায় মানুষের উপর দিয়ে চালিয়ে দিতে চায়। অথচ পাশের দেশের মানুষ এই নূন্যতম ভদ্রতা জ্ঞানটুকু আঠারো বছর আগেই বেশ ভালো ভাবে শিখে নিয়েছিল।

দেখতে দেখতে আমাদের ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো। কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল ব্যাংককের উপর। শহরটাকে অনেক আপন লাগছিল তখন। যাবার বেলায় দিনে ফ্লাইট থাকায় মেঘের খেলা দেখতে দেখতে ফিরতে পেরেছিলাম। বিশাল আকাশের বুক থেকে নীচের পৃথিবীকে স্ববিস্ময়ে দেখছিলাম। কি সুন্দর ছিল সে ভ্রমনটা। আব্বুর সাথে সেই প্রথম এবং সেই শেষ বিদেশ ভ্রমন। মাঝে আরেকবার সুযোগ এসেছিল। অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া ট্যুরে যাচ্ছিল আব্বু। আমারও যাবার কথা ছিল। কিন্তু আমার ভিসা হয়ে যাবার পর আর যেতে ইচ্ছে করছিল না, তাই সে দফায় যাত্রা বাতিল করেছিলাম। তখন কি জানতাম, আব্বু আমাদের এত দ্রুত ফাকি দিয়ে চলে যাবে। এক-জীবনে যেন জীবন আমাকে কয়েক-জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে দিয়েছে। যাইহোক, এর পর বিদেশ ভ্রমনে গিয়েছি আরো বেশ কিছু দেশ। কিন্তু সেই প্রথম ভ্রমন সব সময় অন্যরকম, যেন সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে আছে অমলিন ভাবে। (সমাপ্ত)

৫ নভেম্বর ২০০৮
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×