somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহবাগের কণ্ঠস্বর...

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৩:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা সবাই অফিসে বসে ছিলাম। আর থেকে থেকেই, সহকর্মীরা একেক জন নিজেদের রাগ, ক্ষোভ ঝারছিলেন কাদের মোল্লাহকে দেয়া আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে।

তারা কেউ খুশী নয়; সবাই আশাহত, ক্ষুব্ধ এবং বলা চলে, খানিকটা উত্তেজিতও ।

এইরকম সংক্ষুব্ধ সময়ে, নানমুখী আলাপের ভেতরই- আমার সহকর্মী প্রবীর বিধান বললেন, 'শাহবাগে প্রতিবাদ হচ্ছে। মানব বন্ধন হচ্ছে। আমি সেইটাতে জয়েন করতে চাই।'

শাহবাগের উদ্দেশ্যে প্রবীর বিধান যখন অফিস থেকে বেরিয়ে যান, তখন বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা। বেরিয়ে যেতে যেতে, প্রবীর শুধু বললেন, 'এরই মধ্যে প্রতিবাদ সভা শুরু হয়ে গেছে।'

ঘরে ঘরে জনে জনে একা একা রাগ ঝাড়ছিলেন যে সব সংক্ষুব্ধ মানুষ, এরা সব পথে নামতে শুরু করেছে। প্রতিবাদের জন্য জোটবদ্ধ হতে শুরু করেছে একেক জন বিচ্ছিন্ন মানুষ।

প্রবীরের মতই কেউ অফিস থেকে, কেউ বাসা থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এরা সব জড়ো হতে শুরু করেছে শাহবাগে।

আমি যখন শাহবাগে পৌঁছাই তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বা প‌ৌনে ছয়টা বাজে।

শাহবাগ মোড় তখন মানুষের মঞ্চ। মোড়ের ঠিক মধ্যিখানে, গোল হয়ে জমেছে মানুষ।

শিশুপার্ক এর দিক থেকে শাহবাগ মোড়, পিজি হাসপাতাল এর দিক থেকে শাহবাগ, আজিজ মার্কেট এর দিক থেকে শাহবাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর দিক থেকে শাহবাগ— শাহবাগ মোড়ে আসার যতগুলো রাস্তা আছে, সবপথ মানুষের দখলে। সব পথে যান চলাচল বন্ধ।

ক্রমাগত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মোড়ে যারা আসছে সেখানে কেউ প্রবীরের মত অ্যাক্টিভিস্ট, কেউ আমার মত পর্যবেক্ষক আর কেউ পথচারী, কৌতুহলী মানুষ।

সে যে যাই হোক, শাহবাগ মোড় এখন মানুষের দখলে। এক ঝাঁক তরুণ গোল হয়ে বসে আছে মোড়ে। আর মাইকে ভেসে আসছে বক্তৃতা: হতাশা, প্রতিবাদ, ক্ষোভ এবং দাবী আদায়ের সংকল্প।

এই প্রতিবাদের স্রোতের মধ্যে আমি কিছুক্ষণ দাঁড়াই। এদিক ওদিক ঘুরে মানুষের মুখ দেখি। তারপর, শাহবাগ মোড়ে, জাদুঘরের উল্টোদিকে আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে শুনি ফারুক ওয়াসিফের বক্তৃতা। দেখি, মানুষের সেই বৃত্তের মধ্যে সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল, বেলায়েত হোসেন মামুন এবং আরো সব চেনা চেনা মুখ।

প্রতিবাদ চলছে। এর মধ্যেই শাহবাগ ছেড়ে আমি চলি বই মেলার দিকে। কিন্তু বাংলা একাডেমীর দিকে যাবার পথে, রাজু ভাস্কের্য্যের কাছাকাছি প‌ৌঁছাতে না পৌঁছাতেই দেখি, রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে রওনা হয়ে টিএসসিতে চক্কর দিচ্ছে হাতে মশাল ধরা একদল তরুণের একটি মিছিল।

মিছিলে স্লোগান বাজছে। আর হাতে মশাল। স্লোগানের সমন্বিত স্বর, সন্ধ্যার তারা ভরা আকাশের নিচে মশালের লাল শিখা সঙ্গে নিয়ে আমি ঢুকে যাই বই মেলায়।

মেলা থেকে বেরিয়ে দেখা হয় কবি টোকন ঠাকুরেরর সাথে। তার সাথে চা খাই, গল্প হয়, উত্তপ্ত শাহবাগের কথা হয়।

তারপর আবারো রাত নয়টার দিকে আমি এসে শাহবাগে নোঙর করি।

কিন্তু এ যেনো আর সেই বিকেলের শাহবাগ নেই! চারিদিকে এখন তার উপচে পড়ছে ভীড়। বিশ-বাইশ-পঁচিশের ঘর ছোঁয়া টগবগে তরুন-তরুনী, তিরিশ, চল্লিশ পেরোনো নিজের মধ্যে থিতু হওয়া ঋদ্ধ তারূন্যের ঝাঁক, এমনকি পঞ্চাশ পেরোনো মানুষেরা শাহবাগে জড়ো হয়েছে।

একদিকে, মানুষের হাতে হাতে অসংখ্য ফেস্টুন। ফেস্টুনে নানা রকম কথা, নানা রকম ছবি। তার সাথে আছে বড় বড় ব্যানার। সে ব্যানারে ছবির রঙে ও রেখায় আকাঁ হয়েছে ঘাতকের মুখ। আঁকা হয়েছে নতুন দিনের জেগে ওঠার ডাক।

অন্যদিকে, মোড়ের চারদিকে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে অগণন মোমবাতি। মোমের আলোয় শাহাবাগে তৈরি হয়েছে আলোর এক অনন্য বেরিক্যাড। এই বেরিক্যাড আজকের আগে আর কখনই দেখে নি শাহবাগ; কখনই দেখে নি বাংলাদেশ।

শীত থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া রাতের শাহবাগে চারদিক প্রকম্পিত হচ্ছে মাইকে ঝড় তোলা বক্তৃতার ঝাঁঝালো গলা, সমন্বিত ঢেউ এর মতো থেকে থেকে গর্জে উঠছে স্লোগান, বড় পর্দায় প্রজেক্টরে সেখানে দেখানো হচ্ছে জহির রায়হানের 'স্টপ জেনোসাইট', আর ঢোল, খোল ও গিটারের সুরে শাহবাগে তখন সে-কী প্রতিবাদ; সে-কী প্রাণের প্রকাশ!

এমন আমূল কাঁপানো প্রাণের সম্মেলনে একবার ঢুকে পড়লে কী করে আর সহসা ফেরা যায়! তাই, আমি আর কবি নির্লীপ্ত নয়ন এর-ও ফেরা হয় না। আমরা দু'জনে মিলে আঁতি পাঁতি করে এদিক ওদিক ঘুরি, দাঁড়াই, দুই জন দুই দিকে চলে গিয়ে কথা বলি নিজেদের চেনা সব মুখের সাথে। তারপর আবার এক জায়গায় আসি, দেখা হয়, গল্প হয়, আবারো ঘুরি।

ঘুরতে ঘুরতে আবারও প্রবীর বিধানের সাথে দেখা হয়। কথা হয়। সেই যে, সাড়ে তিনটায় এসেছিলো তারপর থেকে এখানে আছে সে এবং
ঘটনাস্থল থেকে প্রতিমুহূর্তের আপডেট জানাচ্ছে ফেসবুকে।

বাকি ভাই [বাকিবিল্লাহ] ও সৈয়দ ফয়েজ আহমদ এর সাথে কথা হয়। আন্দোলনের কর্মসূচী কেমন চলছে, সামনে আর কী কী কর্মসূচী আছে, কী কী আসতে পারে, সারারাত কি এখানে সবাই থাকবে... এইসব বিভিন্ন কথা।

ব্লগার কৌশিক এর সাথে কথা হয়। কী করছেন, কী করবেন, কীভাবে করবেন... আরো সব নানা কথা।

ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক, ছাত্রইউনিয়ন, উদিচী, মুভ্যিয়ানা সবাই এই আন্দোলনে আছে। এই আন্দোলনে এসে সংহতি প্রকাশ করেছে ছাত্রলীগ-ও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদের একটি দল এসে নিজেদের সংহতি জানিয়ে গেছেন এই সমাবেশে।

শাহবাগে অবরোধ, শাহবাগে বিক্ষোভ; শাহবাগ আজ জনতার মঞ্চ। এখানে আজ জেগেছে যে বজ্র কণ্ঠ, সে কি নয় নতুন দিনের ঘোষক?

কুয়াশামুক্ত এই মাঘে, শাহবাগের আকাশে আজ জ্বলে উঠেছে যে সব তারা, তারাভরা আকাশের নিচে শাহবাগে যারা আজ জোটবদ্ধ হয়েছে, স্লোগানে দিয়েছে ডাক, তারা কি অবিরাম বাংলাদেশকে দেবে না পাহারা?
















সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৪:২৩
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×