somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ভ্রমন ২০০৮ (৫ম ও শেষ পর্ব)

০৩ রা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১ম পর্ব - Click This Link
২য় পর্ব - Click This Link
৩য় পর্ব - Click This Link
৪র্থ পর্ব - Click This Link

শহরের লোকালয় ছেড়ে আমরা যত বের হয়ে আসছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম। এত সুন্দর একটা দেশ হতে পারে! সবুজ আর সবুজ। পাহাড়গুলো ভয়ঙ্কর কিন্তু ভয়াবহ না। সমুদ্র উন্মাতাল কিন্তু উত্তাল না। রাস্তার দুপাশে ঢেউ খেলে যাওয়া মাঠ। সে মাঠে চরে বেড়াচ্ছে অগুনিত সাদা সাদা ভেড়ার পাল। তাদের ছোট এবং গোলগোল শরীরগুলো নিয়ে হেলে দুলে ঘাস খাচ্ছে। অদ্ভুত নিরব পুরো দেশটা। যেন সবাই জানে কার কি করতে হবে, তাই যার যার কাজ সে সে করে যাচ্ছে।

ঘন্টা দেড়েক পর আমরা এসে পৌছালাম কলেরিনের একটা টুরিস্ট স্পটে। এখানে দেখার মত অনেক কিছু আছে। একটা রোপ ব্রিজ আছে যেটার প্রতি সবার আকর্ষন। সমস্যা হলো ওটা দেখতে হলে আলাদা করে টিকেট কাটতে হয়। ফলে কেউ আর যেতে চাইলো না। অন্যদিকে রয়েছে পাহাড়ের মাঝ থেকে আটলান্টিক মহাসাগর দেখার সুযোগ। যেহেতু এটার জন্য কোন টিকেটের প্রয়োজন ছিল না, তাই সবাই এটাই দেখতে চাইলো। আমার খুব ইচ্ছে ছিল রোপব্রিজটা দেখার, কিন্তু কি আর করা! সবাই যখন অন্য দিকে যাচ্ছে তখন দল ভেঙ্গে সেটা দেখতে যাওয়া অশোভনীয়। মনেমনে ঠিক করলাম পরে আবার এসে সেটা দেখে যাবো।

আমার ধীরে ধীরে পাহাড়ের রাস্তা ধরে নেমে যেতে শুরু করলাম। কঠিন শিলায় গড়া পাহাড়ের ফাক দিয়ে সাবধানে নামতে হচ্ছিল। কোথাও কোথাও রীতিমত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে পাহাড়। শেষ পর্যন্ত পানির একদম কাছাকাছি গিয়ে অনেকে থেমে গেল। এরপর যেতে হলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। আমাদের সাথের ইংলিশ ছেলেটা এক লাফে এলোমেলো এবং ভাঙ্গা পাথরের উপর দিয়ে হেটে চলে গেলো। অবস্থা তখন এমন যে পার হতে না পারলে লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে সবাই। টার্কিস ছেলেটা খানিকটা পার হতে গিয়ে মাঝে থেমে গেলো। একটা চীনা ছেলে পার হয়ে গিয়েছে। মনে সাহস এনে আমিও পার হতে শুরু করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম রাস্তাটা অতটা ভয়ঙ্কর না যতটা ভেবেছিলাম। একসময় পাথরগুলো পার হয়ে সমতল জায়গায় চলে এলাম। বাহ! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সমুদ্রের দিকে, যেন কথা বলারও সাধ্য রইলো না। এত সুন্দর, এত সুন্দর কেন সব কিছু?

এই স্পটটা থেকে স্কটল্যান্ড দেখা যায়। আয়ারল্যান্ড এবং গ্রেট বৃটেন দ্বীপের মাঝে এই অংশে ব্যবধান সবচেয়ে কম। যেন একটা নৌকা হলেই পার হয়ে যাওয়া যায়! ছোটছোট কিছু দ্বীপ রয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর দ্বীপগুলোর ছবি তুলতে শুরু করলাম। ঘুরেঘুরে নীচ থেকে, উপর থেকে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে একেবেকে চার পাশের দৃশ্যগুলোকে ক্যামেরায় তুলে নিতে লাগলাম। ছবি তুলতে তুলতে সময় যে কখন পার হয়ে গিয়েছিল টেরই পাইনি। হঠাৎ একজন বললো আমাদের ড্রাইভার বলেছিল দুটার মধ্যে বাসে ফিরে যেতে। ঘড়ি জানিয়ে দিচ্ছিল দুটা বাজতে আর বেশি বাকি নেই। ফিরতি পথে অনেকটা হাটতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এবার আমাদের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে হবে। তাই সবাই ধীরেধীরে ফেরার পথ ধরলো। কিন্তু আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। এক অদ্ভুত আকর্ষনে আমি তখন থেমে আছি আটলান্টিকের সেই মায়াচ্ছন্ন পাহাড়ের মাঝে। ছবি তুলছি তখনও। বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে। হঠাৎ দেখি আমার দলের সবাই গায়েব। এরা যে উঠে চলে গিয়েছে সেটা আমি লক্ষ্য করিনি। দ্রুত ক্যামেরা গুছিয়ে লাফ দিয়ে পথ চলতে শুরু করলাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে ঘেমে যাচ্ছিলাম। অগাস্ট, তবুও সূর্যের তেজ যেন এপ্রিল-মের মত। বাসে ফিরে এসে দেখি সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আসার সাথে সাথেই বাস ছেড়ে দিল। আবার চলতে শুরু করলাম, অন্য কোন স্পটের উদ্দেশ্যে।

আগ্রহী পাঠক নিচের লিঙ্ক থেকে এই স্পটে তোলা কিছু বাছাই করা ছবি দেখতে পাবেন।
Click This Link

আবার আয়ারল্যান্ডের অপরুপ সবুজের মাঝ দিয়ে আমরা ছুটে চললাম। বাস চালাতে চালাতে ড্রায়ভার জানালো আমরা এখন যাচ্ছি নর্দার্নের সব চেয়ে নাম করা টুরিস্ট স্পট জায়ান্টস কজওয়ের দিকে। পাঠক, নামটা কি পরিচিত লাগছে? যারা মুভি দেখেন নিয়মিত তারা হয়তো ধরে ফেলেছেন। হেল বয় টু - দ্যা গোল্ডেন আর্মি মুভিটা যারা দেখেছেন তারা হয়তো মনে করতে পারছেন যে প্রাচীন রাজা গোল্ডেন আর্মির ভয়াবহতায় আতঙ্কিত হয়ে তাদের ঘুম পাড়িয়ে একটা গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখে। হেলবয় এবং যুবরাজ আলাদা ভাবে সারা ছবিতে এই গোপন স্থানটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। ছবির ক্লাইম্যাক্সে তারা দুজনই এ গোপন স্থানের খোঁজ বের করতে সক্ষম। এই স্থানটা ছিল নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের জায়ান্টস কজওয়ে।

বিশ মিনিটের মধ্যে আমরা জায়ান্টস কজওয়েতে এসে পৌছালাম। ঢালু পথ বেয়ে বেশ খানিকটা নেমে যাওয়ার পর আমরা মূল স্পটে এসে দাড়ালাম। এ স্থানটা ৪০ হাজার হেক্টাগোনাল পাথরের কলামে তৈরী। এ কলামগুলো অনেক অনেক বছর আগে অভ্যন্তরিন চাপে লাভার দ্বারা সৃষ্ট। এগুলোর উচ্চতা একে স্থানে একেক রকম। কোনকোনটা বারো মিটার পর্যন্ত উঁচু। আটলান্টিকের নীল পানি এসে ভেঙ্গে পড়ছিল কঠিন শিলায় গড়া কলামগুলোর উপর। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীটা বড্ড বেশি সুন্দর।

জায়ান্টস কজওয়ে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। যদিও নিতান্তই গাল-গল্প কিন্তু শুনতে মন্দ লাগে না। কথিত আছে যে আইরিশ জায়ান্ট Finn McCool তার স্কটিশ শত্রু Benandonner এর সাথে যুদ্ধ করার জন্য স্কটল্যান্ড যাবার পথে এ রাস্তা তৈরী করে। যাবার পথে সে বিশ্রাম নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমন সময় স্কটল্যান্ড থেকে Benandonner তেড়ে আসতে থাকলে Finn McCool স্ত্রী Oonagh একটা কম্বল দিয়ে তাকে ঢেকে দেয় যাতে Benandonner মনে করে এটা আসলে ওদের বাচ্চা। Benandonner আয়ারল্যান্ড আসার পর যখন Finn McCool কে দেখে এবং ভাবে যে এটা ওর বাচ্চা, তখন ভীত হয়ে পড়ে। মনেমনে ভাবে যার বাচ্চা এত বড়, সে না জানি কত বড় হবে! এরপর Benandonner দৌড়ে স্কটল্যান্ড চলে যায় এবং যাবার পথে রাস্তার একাংশ ভেঙ্গে দিয়ে যায় যেখানে এখন অটলান্টিকের পানি বয়ে চলেছে দুই দেশের মাঝে।

নিচের লিঙ্ক থেকে আমার ক্যামেরায় তোলা জায়ান্টস কজওয়ের কিছু ছবি দেখা যাবে।
Click This Link

জায়ান্টস কজওয়ে দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে গেলো আরো অনেক। আমাদের ডেরী ফিরতে হবে। প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগবে। সবাই ঠিক করলো এবার ফেরা উচিত। ধীরে ধীরে সবাই ফিরে আসলাম বাসে। আবার যাত্রা শুরু আয়ারল্যান্ডের সবুজের মধ্য দিয়ে। রাজনীতি দুই আয়ারল্যান্ডকে ভাগ করে দিলেও প্রকৃতি ঠিকই তাদের আজও এক করে রেখেছে, প্রকৃতির চাদরের নিচে।

সেদিন ডেরী ফিরে এসে যে যার মত রুমে চলে যাই আমরা। পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সোজা অলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যাই। সিদ্দিকী স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার ছোটা শুরু করলাম স্টেশনের উদ্দেশে। ভাগ্য খুব একটা সুপ্রসন্ন ছিল। ট্রেন মিস করলাম। তিন ঘন্টা স্টেশনে বসে থেকে পরের ট্রেনে ডেরী থেকে বেলফাস্ট আসলাম। সেখানে আরো দেড় ঘন্টা কাটিয়ে দিনের শেষ ট্রেনে বেলফাস্ট থেকে ডাবলিন এসে পৌছালাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা হয়ে গিয়েছিল। ক্লান্তিতে দুচোখ বুজে আসছিল। তবুও একটা অদ্ভুত তৃপ্তি লাগছিল। অপরুপা আয়ারল্যান্ডকে দেখার তৃপ্তি, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার তৃপ্তি এবং সর্বপরি ভয়ঙ্কর সুন্দরকে নিজের মাঝে ধারন করার তৃপ্তি।

প্রিয় পাঠক, সেদিন রক্তে ভ্রমনের নেশাটা তিব্র ভাবে বইতে শুরু করেছিল। মনেমনে বলছিলাম, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডতো হলো, এবার তবে ইংল্যান্ড! হ্যা, একমাস পরই ঘর ছেড়ে আবার বের হয়ে পড়ি আমি। গত অক্টোবর মাসে ঘুরে এসেছি ইংল্যান্ডও। সেই বর্ননা নিয়ে আবার আরেকটা সিরিজে হাজির হবো আপনাদের সামনে। আজকের মত এই সিরিজের এখানেই সমাপ্তি।

২ নভেম্বর ২০০৮
ডাবলিন, রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৩৬
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×