যেদিন আমি নির্বাসিত হতে চললাম, সেদিন অক্টোবরের অন্যান্য দিনের মতো রোদ ঝলমলে দুপুর ছিল। সকাল থেকে অনেক বন্ধুরা বিদায় জানাতে বাসায় আসছিল। আত্বীয়স্বজনরা আগের দিন থেকেই বাসায় ছিলেন। গাড়িতে উঠা পর্যন্ত আমি ফুরফুরে মেজাজেই ছিলাম। গাড়িতে উঠার আগ মুহুর্তে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেলো। মা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসেনি। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মার চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। আমি কাঁদছি দেখে বাবা এসে গাড়িতে তুললেন। এয়ারপোর্ট যাবার পথে গাড়ি যতই দ্রুতগতিতে সামনে ছুটে চলছে, বাবা আর ভাইবোনদের পাশে একটু বেশি থাকার ইচ্ছে হচ্ছিল। একসময় গাড়ি এসে এয়ারপোর্টে ঠিকই থেমে যায়। তারপর বাইরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করি, যতক্ষণ ফ্লাইটের শেষ ঘোষণার অপেক্ষা করা যায়। আমার দুই বন্ধু মাসুদ আর সুজন এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসেছিল। এই সময়টাতে ওরা সাথে থাকাতে খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়। একটা সময় ঘোষণা আসে। যখন এই ঘোষণা শুনছিলাম মনে হচ্ছিল আমি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কোন আসামি। তারপর সবাইকে বিদায় জানাতে গিয়ে আমি দু'হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি। বাবা ও কাঁদছিল, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এই নিয়ে দুবার বাবাকে কাঁদতে দেখেছি। একবার ছিয়ানব্বই এ যখন আমার দাদী মারা গিয়েছিলেন।
ছোট ভাইবোনদের বুকে নিয়ে বললাম তোরা আমার জন্য চিন্তা করিস না। আমি ভালো থাকব, তোরা ভালো থাকিস। ইমিডিয়েট ছোট ভাইকে বললাম ওদের একদম বকা দিবি না। আমার হয়ে ওদের দেখিস। তারপর আস্তে আস্তে কাঁচের দেয়ালের ওপাশে চলে যায়। সবুজ পাসপোর্টে যেখানে দিন কয়েক পূর্বে সুখের ছাড়পত্র পেয়েছি, প্রথমবারের মতো দুপদাপ করে দু একটা সিলছাপ্পর পড়ে। এইতো শেষ, এখন ফ্লাইটে উঠতে পারলেই শান্তি। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি শুধু শুধু মন খারাপ করছি। বড় হওয়ার মিশনে এসব করতে নেই। উন্নত বিশ্বে পা রাখার সৌভাগ্য খুব বেশি মানুষের হয় না এটা ভেবে নিজেকে সান্তনা দিই। প্লেনে উঠে জানালার পাশের সিটে খুব আরাম করে বসি। কোমরে সিটবেল্ট বেঁধে নিই। আশে পাশে কথা বলার মতো কেউ আছে কিনা দেখে নিই। হঠাৎ বিমান নড়েচড়ে উঠলে আমিও নড়েচড়ে বসি। জানালা দিয়ে আমি বাইরে তাকিয়ে থাকি। আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে সবকিছু। গাছপালা, বাড়িঘর, গাড়ি, মানুষ সবকিছু। এমন সময় কেমন যেন হালকা হয়ে যায় সবকিছু। প্লেনটি উড়াল দিলো। হঠাৎ পাঁজরে টান লাগে। কিছু একটা ছিড়ে গেলো বুঝি। আমার ভিতরের মানুষটা হু হু করে কেঁদে উঠে। প্লেন যতো উপরের দিকে উঠতে থাকে ততই আমি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখি আমার দেশের মানচিত্র আস্তে আস্তে পেছন থেকে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। চোখের পানিতে অস্পষ্ট হয়ে যায় সবকিছু। প্লেনের ঝকঝকে অবয়ব, জানালার বাইরের সুনীল আকাশ, সুদৃশ্য বিমানবালা। সব সবকিছু ঝাপসা মনে হয়। মিলিয়ে যায় উন্নত দেশে নির্বাসিত হওয়ার আনন্দ, উত্তেজনা। বুকের মধ্যে শুধু একটি হাহাকার অবশিষ্ট থাকে।
তারপর এভাবে সেই হাহাকার নিয়েই কেটে যায় ছয়টি বছর। দেখতে দেখতে ছয়টি বছর চলে গেল। চলে যাবার জন্যই এখানে আসা হয়েছিল কিন্তু এখনো যেতে পারিনি। একবার এখানে আসলে ছেড়ে চলে যাওয়া এতোটা সহজ না। দু একজন যারা পারেন তাদের ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করে।
মাঝে মাঝে মার কথা মনে করে জলে চোখ ভিজে গেলে ভাবি, না মন খারাপ করা চলবে না কিছুতেই। আমি তো অনেক বড় হতে চেয়েছি, বড় হতে এখানে এসেছি। বাবার চেয়েও অনেক বড় হব, বাবার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ভালো লাগত না দেখে বাবাকে বলতাম। কতটুকু বড় হয়েছি জানিনা তবে, এতোটুকু জানি আমাকে অনেক বড় হতে হবে। কিন্তু যতই আমি বড় হচ্ছি আমি যেন দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছি। আমার ভিতরের শিশুটা আস্তে আস্তে বেড়ে উঠে কিন্তু আমি আর বড় হতে পারিনা। যেদিন লন্ডনে আসার ছাড়পত্র পেয়েছিলাম, সেদিন ভেবেছিলাম আমি বাবার কাছে জিতে গেছি। এখন মনে হচ্ছে আমিই আসলে পরাজিত হয়েছি। বাবা ঠিকই জিতেছেন। বাবারা কখনো হারেন না। আমার মতো মূর্খ ছেলেরা সেটা অনেক দেরীতে বুঝে।
ছবিসূত্র: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১০ ভোর ৫:২৭