somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বগত আলাপ ০৩:নির্বাসিতের গল্প!

০১ লা নভেম্বর, ২০০৮ ভোর ৬:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩১ শে অক্টোবর, ২০০২ সালের আজকের এই দিনে আমি এখানে আসি। অথচ মনে হচ্ছে এইতো সেদিন। এখনো হিথ্রো'তে অবতরণের সেদিনের ছবি চোখে ভাসছে। বাংলাদেশে ভবিষ্যত নেই তাই ভবিষ্যত খুঁজে নিতে বিলেতে পাড়ি জমিয়েছি। অবশ্য দেশের বাইরে চলে আসা অনেকের মতো আমার জন্য এতোটা সহজ ছিল না। বাসার বড় ছেলে হওয়ায় বাবা মা কিছুতেই রাজী ছিলেন না। মাকে সাত পাঁচ বুঝিয়ে রাজী করানো গেলেও বাস্তববাদী বাবার সম্মতি পেতে আমাকে কাঠখড় পুড়াতে হয়েছিল। যেদিন আমি ভিসা পেয়েছিলাম সেদিন আমার পা মাটিতে পড়ছিল না। আমার চেয়ে আমার বাবাই যেন খুশি হয়েছিলেন বেশি। ছেলের কোন চাওয়াই কখনো অপূর্ণ রাখেননি হয়তো এই কারণেই খুশি হয়েছিলেন।

যেদিন আমি নির্বাসিত হতে চললাম, সেদিন অক্টোবরের অন্যান্য দিনের মতো রোদ ঝলমলে দুপুর ছিল। সকাল থেকে অনেক বন্ধুরা বিদায় জানাতে বাসায় আসছিল। আত্বীয়স্বজনরা আগের দিন থেকেই বাসায় ছিলেন। গাড়িতে উঠা পর্যন্ত আমি ফুরফুরে মেজাজেই ছিলাম। গাড়িতে উঠার আগ মুহুর্তে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেলো। মা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসেনি। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মার চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। আমি কাঁদছি দেখে বাবা এসে গাড়িতে তুললেন। এয়ারপোর্ট যাবার পথে গাড়ি যতই দ্রুতগতিতে সামনে ছুটে চলছে, বাবা আর ভাইবোনদের পাশে একটু বেশি থাকার ইচ্ছে হচ্ছিল। একসময় গাড়ি এসে এয়ারপোর্টে ঠিকই থেমে যায়। তারপর বাইরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করি, যতক্ষণ ফ্লাইটের শেষ ঘোষণার অপেক্ষা করা যায়। আমার দুই বন্ধু মাসুদ আর সুজন এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসেছিল। এই সময়টাতে ওরা সাথে থাকাতে খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়। একটা সময় ঘোষণা আসে। যখন এই ঘোষণা শুনছিলাম মনে হচ্ছিল আমি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কোন আসামি। তারপর সবাইকে বিদায় জানাতে গিয়ে আমি দু'হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি। বাবা ও কাঁদছিল, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এই নিয়ে দুবার বাবাকে কাঁদতে দেখেছি। একবার ছিয়ানব্বই এ যখন আমার দাদী মারা গিয়েছিলেন।
ছোট ভাইবোনদের বুকে নিয়ে বললাম তোরা আমার জন্য চিন্তা করিস না। আমি ভালো থাকব, তোরা ভালো থাকিস। ইমিডিয়েট ছোট ভাইকে বললাম ওদের একদম বকা দিবি না। আমার হয়ে ওদের দেখিস। তারপর আস্তে আস্তে কাঁচের দেয়ালের ওপাশে চলে যায়। সবুজ পাসপোর্টে যেখানে দিন কয়েক পূর্বে সুখের ছাড়পত্র পেয়েছি, প্রথমবারের মতো দুপদাপ করে দু একটা সিলছাপ্পর পড়ে। এইতো শেষ, এখন ফ্লাইটে উঠতে পারলেই শান্তি। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি শুধু শুধু মন খারাপ করছি। বড় হওয়ার মিশনে এসব করতে নেই। উন্নত বিশ্বে পা রাখার সৌভাগ্য খুব বেশি মানুষের হয় না এটা ভেবে নিজেকে সান্তনা দিই। প্লেনে উঠে জানালার পাশের সিটে খুব আরাম করে বসি। কোমরে সিটবেল্ট বেঁধে নিই। আশে পাশে কথা বলার মতো কেউ আছে কিনা দেখে নিই। হঠাৎ বিমান নড়েচড়ে উঠলে আমিও নড়েচড়ে বসি। জানালা দিয়ে আমি বাইরে তাকিয়ে থাকি। আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে সবকিছু। গাছপালা, বাড়িঘর, গাড়ি, মানুষ সবকিছু। এমন সময় কেমন যেন হালকা হয়ে যায় সবকিছু। প্লেনটি উড়াল দিলো। হঠাৎ পাঁজরে টান লাগে। কিছু একটা ছিড়ে গেলো বুঝি। আমার ভিতরের মানুষটা হু হু করে কেঁদে উঠে। প্লেন যতো উপরের দিকে উঠতে থাকে ততই আমি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখি আমার দেশের মানচিত্র আস্তে আস্তে পেছন থেকে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। চোখের পানিতে অস্পষ্ট হয়ে যায় সবকিছু। প্লেনের ঝকঝকে অবয়ব, জানালার বাইরের সুনীল আকাশ, সুদৃশ্য বিমানবালা। সব সবকিছু ঝাপসা মনে হয়। মিলিয়ে যায় উন্নত দেশে নির্বাসিত হওয়ার আনন্দ, উত্তেজনা। বুকের মধ্যে শুধু একটি হাহাকার অবশিষ্ট থাকে।

তারপর এভাবে সেই হাহাকার নিয়েই কেটে যায় ছয়টি বছর। দেখতে দেখতে ছয়টি বছর চলে গেল। চলে যাবার জন্যই এখানে আসা হয়েছিল কিন্তু এখনো যেতে পারিনি। একবার এখানে আসলে ছেড়ে চলে যাওয়া এতোটা সহজ না। দু একজন যারা পারেন তাদের ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করে।

মাঝে মাঝে মার কথা মনে করে জলে চোখ ভিজে গেলে ভাবি, না মন খারাপ করা চলবে না কিছুতেই। আমি তো অনেক বড় হতে চেয়েছি, বড় হতে এখানে এসেছি। বাবার চেয়েও অনেক বড় হব, বাবার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ভালো লাগত না দেখে বাবাকে বলতাম। কতটুকু বড় হয়েছি জানিনা তবে, এতোটুকু জানি আমাকে অনেক বড় হতে হবে। কিন্তু যতই আমি বড় হচ্ছি আমি যেন দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছি। আমার ভিতরের শিশুটা আস্তে আস্তে বেড়ে উঠে কিন্তু আমি আর বড় হতে পারিনা। যেদিন লন্ডনে আসার ছাড়পত্র পেয়েছিলাম, সেদিন ভেবেছিলাম আমি বাবার কাছে জিতে গেছি। এখন মনে হচ্ছে আমিই আসলে পরাজিত হয়েছি। বাবা ঠিকই জিতেছেন। বাবারা কখনো হারেন না। আমার মতো মূর্খ ছেলেরা সেটা অনেক দেরীতে বুঝে।

ছবিসূত্র: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১০ ভোর ৫:২৭
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×