somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০৫

৩১ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধ্যবিত্তদের চরিত্রটি ভালোভাবে বুঝে নিতে হলে তাদের মূল্যবোধকে বুঝতে হবে। কারণ, এই শ্রেণীর সবচেয়ে বড় সম্পদ তাদের মূল্যবোধ এবং এগুলো নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের মতো করে নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছে তারা। মধ্যবিত্ত হবার জন্য যেহেতু শিক্ষা একটি অপরিহার্য মাধ্যম - এদের চরিত্র বোঝার জন্য তাই বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থাটাও বুঝে দেখা দরকার। শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক ইত্যাদিকে বোঝালে চলবে না, কারণ, শিক্ষাটা শুধু প্রতিষ্ঠানেরই বিষয় নয়। পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আরো বহু ধরনের বই থেকে, মিডিয়া (রেডিও-টেলিভিশন-সংবাদপত্র-নাটক-সিনেমা ইত্যাদি) থেকেও একজন মানুষ নানারকম শিক্ষা লাভ করে থাকে। এসবকিছু বিবেচনায় আনলে আমরা দেখতে পাবো - আমাদের পরিবারগুলো, বিদ্যমান সমাজকাঠামোটি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপকরণগুলো (বই-পুস্তক, শিক্ষক, ক্লাসরুম, পরিবেশ ইত্যাদি), মিডিয়াগুলো (আগেই বলেছি অধিকাংশ মিডিয়ার মালিক উচ্চবিত্ত হলেও সেসব দখল করে আছে মধ্যবিত্তরা এবং তারা প্রচার করছে মধ্যবিত্তেরই মূল্যবোধ) একজনকে কেবলই মধ্যবিত্ত হবার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। একজন দরিদ্র পিতা যখন তার সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন দেখেন তখন একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখেন যে, তার পুত্র শিক্ষিত হয়ে 'বড় অফিসার' হবে, 'ভদ্রলোক' হবে। এই ভদ্রলোক কিন্তু মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক। অর্থাৎ তার সামনে আদর্শ ও স্বপ্ন বলতে মধ্যবিত্তরাই আছে এবং সে সফলভাবে এই স্বপ্ন তার সন্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতে পেরেছে, ফলে পুত্রটিও কেবল মধ্যবিত্তই হতে চায়। শুধু পরিবারই নয়, স্কুলের প্রথম বইটিও তাকে নীতিবাক্য শেখায় - 'সদা সত্য কথা বলিবে' , 'অসৎসঙ্গ পরিত্যাগ কর' ইত্যাদি। এগুলোও মধ্যবিত্তেরই নীতিবাক্য। এই সত্য মধ্যবিত্তের সত্য, এই সৎ-অসতের সংজ্ঞাটিও মধ্যবিত্তেরই তৈরি। তারচেয়ে বড় কথা - সদা সত্য কথা বললে বা অসৎসঙ্গ পরিত্যাগ করলে বড়জোর মধ্যবিত্তই হওয়া যাবে, কোনোভাবেই উচ্চবিত্ত হওয়া যাবে না। শুধু পাঠ্যপুস্তকই নয়, যাঁরা এইসব নীতিবাক্য খুব মন দিয়ে শেখান, সেই শিক্ষকরাও মধ্যবিত্ত। অর্থাৎ সমাজের যাবতীয় অনুষঙ্গ তাকে মধ্যবিত্তই হতে বলে। আজ পর্যন্ত কোনো পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, মা-বাবা, বইপুস্তক কাউকে উচ্চবিত্ত হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে বলে আমার জানা নেই। বরং সিনেমা নাটকে, গল্প-উপন্যাসে উচ্চবিত্তদের চিত্রিত করা হয় রীতিমতো ভিলেন হিসেবে! উচ্চবিত্তদের নিয়ন্ত্রাধীন মিডিয়াগুলো যে ভাষায় উচ্চবিত্তদের নিন্দনীয় কীর্তিকাহিনী তুলে ধরে, তা অন্য কোনো শ্রেণীর ক্ষেত্রে করে না। মধ্যবিত্তের চিন্তাশীল অংশটি, অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীরা, তো এ বিষয়ে রীতিমতো সোচ্চার। তারা একদিকে যেমন উচ্চবিত্তদের গালাগাল করে, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত হবার জন্য কিংবা থাকার জন্য নানারকম যুক্তিতর্কের ও রীতি-নীতির অবতারণা করে।

মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে তার শ্রেণীকে নীতি শেখান তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। মহান কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিজে মধ্যবিত্ত হয়েও মধ্যবিত্তদের সমালোচনায় ছিলেন মুখর, নিজেও সারা জীবন ধরে মধ্যবিত্তদের অনড়-অচল মূল্যবোধের সীমানা ডিঙিয়ে চলে যেতে চেয়েছেন, এবং এইসব রীতি-নীতিকে তীব্রভাবে আঘাত করেছেন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তিনি নিজেই যে বেশকিছু মূল্যবোধের জন্ম দিচ্ছেন, সেটা হয়তো খেয়ালও করেননি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন - 'সাধারণ মানুষ যে ভালোভাবে বাঁচবে এটা আমি কোনো নীতিবোধ থেকে বলিনা - বলি কাণ্ডজ্ঞান থেকে; সাম্যের সমাজ চাওয়াও কাণ্ডজ্ঞানেরই চাওয়া।' - বলাইবাহুল্য তিনি যে কাণ্ডজ্ঞানের কথা বলেন তা মধ্যবিত্তেরই কাণ্ডজ্ঞান। উচ্চবিত্তের এই কাণ্ডজ্ঞান থাকার প্রশ্নই আসেনা, কারণ তা তাদের শ্রেণীস্বার্থের বিপক্ষে যাবে, নিজের শ্রেণীর ধ্বংস ডেকে আনবে। আবার এমন কাণ্ডজ্ঞান যে থাকতে পারে বা থাকা উচিৎ নিম্নবিত্তরা তা ভাবতেই পারেনা, এমনকি কল্পনাও করে না বা কল্পনা করার সাহস পায়না।

মধ্যবিত্তের এই কাণ্ডজ্ঞানকে কি আপনি ভালো বলবেন না খারাপ বলবেন? যদি ভালো বলেন তাহলে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, মধ্যবিত্তরা এমন কিছু কাণ্ডজ্ঞান বা মূল্যবোধ বা নীতিবোধ তৈরি করে যা নিজ শ্রেণীর সীমানা ডিঙিয়ে অন্য শ্রেণীর জন্যও কল্যাণকর বলে বিবেচিত হয়। এখানটায় এসে মধ্যবিত্তদের প্রশংসা না করে পারা যায় না। যুগ যুগ ধরে এরা এইসব মূল্যবোধের কথা বলে আসছে। সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়নতা, দেশপ্রেম, মানবকল্যাণ ইত্যাদি নিয়ে মধ্যবিত্ত চিন্তাবিদদের চিন্তার অন্ত নেই, এবং শুধু তত্ত্বেই নয়, বিষয়টি তারা প্র্যাকটিসও করে। তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের সমস্ত গণআন্দোলনে মধ্যবিত্তদের অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করলেই। সত্যি বলতে কী - '৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে '৯০-এর গণআন্দোলন পর্যন্ত সবই পরিচালিত হয়েছে মধ্যবিত্তদেরই নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে। আরো পরিস্কার ভাবে বলা যায় - '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া অন্য সবগুলো আন্দোলন আসলে মধ্যবিত্তদেরই আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধে আপামর মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও এর পটভূমি তৈরি করেছিলো মধ্যবিত্তরা এবং এর নেত্বত্বেও ছিলেন মধ্যবিত্তরাই। এইসব আন্দোলন-সংগ্রাম-যুদ্ধ মধ্যবিত্তরা কেবল নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার জন্যই করেছে, এমনটি ভাবা খুব ভুল হবে। এর মধ্যে দেশপ্রেম ছিলো, ছিলো জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, মানুষের জন্য কল্যাণচিন্তা। এই ভাবনা-চিন্তাগুলো তাদের মধ্যে এতটাই প্রবল ছিলো যে, নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেনি তারা। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া অন্যান্য আন্দোলন সংগ্রামগুলোতে যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের প্রায় ৮০ ভাগই মধ্যবিত্ত। যারা মধ্যবিত্তদের বাছবিচারহীনভাবে গালাগালি করেন তারা এই বিষয়টি ভুলে যান। এদের ইতিবাচক কোনোকিছুই তারা খুঁজে পান না, পেলেও প্রশংসা করতে দারুণ কার্পন্য করেন, যদিও এই প্রশংসা তাদের প্রাপ্য।

মধ্যবিত্তরা, বিশেষ করে এই শ্রেণীর তরুণ অংশটি, যখন নিজ শ্রেণীর মূল্যবোধগুলোকে তীব্রভাবে ধারণ করে, তখন তারা কী ঘটিয়ে ফেলার ক্ষমতা অর্জন করে তার প্রমাণ তারা রেখেছে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৯০-এর গণআন্দোলন পর্যন্ত সমস্ত আন্দোলন ও সংগ্রামে। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তারা নিরংকুশ বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু এই সঙ্গে এ-ও বলা দরকার যে, তারা তাদের এই বিজয় ধরে রাখতে পারেনি। যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে তারা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলো, বিজয় অর্জিত হবার পর তারা আবিষ্কার করে - এই বিজয় ছিনতাই হয়ে গেছে, এবং যারা ছিনতাই করেছে তারাও তাদেরই শ্রেণীর লোক। মধ্যবিত্তরা কী পরিমাণ সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে তার প্রমাণও তারা রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের পর ব্যাপক লুটতরাজ-চুরি-ডাকাতি-কালোবাজারি-রাহাজানি-ছিনতাই করে। ওই সময় জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার বারোটা বাজিয়ে তারা নিজেরা ফুলে ফেঁপে বিকট চেহারা ধারণ করেছে। এতটাই বিকট যে তাকে আর মধ্যবিত্ত বলে চিহ্নিতই করা যায় না। একই ঘটনা একটু সীমিত আকারে হলেও ঘটেছে '৯০-এর গণআন্দোলনের পর। তবে বলা দরকার - যে মধ্যবিত্ত যুদ্ধ করেছিলো আর যে মধ্যবিত্ত এই লুটতরাজে অংশ নিয়েছিলো তারা একই মধ্যবিত্ত নয়। বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে আমরা হয়তো কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পাবো। আগামী পর্বে (অর্থাৎ শেষ পর্বে) আমরা সেই বিশ্লেষণটিই করতে চাই।

আগের পর্বগুলোর লিংক :

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০৪
Click This Link

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০৩
Click This Link

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০২
Click This Link

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০১
Click This Link
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×