somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০৪

২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১০:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই সুযোগে মধ্যবিত্তের জন্ম-বৃত্তান্ত এবং বিকাশের ঘটনাটিও জেনে নেয়া যেতে পারে। কারা এরা, এলোই-বা কোত্থেকে? একথা সবাই জানেন যে, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে মধ্যসত্ত্বভোগীরাই এই শ্রেণীর জন্ম দিয়েছিলো যারা কখনো উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকতো না, অথচ উৎপাদক ও ভোক্তার মাঝখানে থেকে সুবিধা লুটে নিতো (অর্থাৎ মধ্যবিত্তের জন্মই একটা সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে), এবং এই অঞ্চলে এই শ্রেণীর জন্ম ও প্রাথমিক বিকাশ ঘটে মূলত হিন্দুদের মধ্যে।

এখন অবশ্য সে চিত্রটি আর নেই। আগের দিনের মধ্যসত্ত্বভোগী মধ্যবিত্তের সঙ্গে আজকের দিনের একজন চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের তুলনাই চলে না। এমনকি চাকরিজীবী লোকটিকে ঠিক মধ্যসত্ত্বভোগীও বলা যায় না। সে-ও ভোক্তারই দলে। অতএব উদ্ভবকালের মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা এখন আর নেই।

তাহলে এদেশের মুসলমান মধ্যবিত্ত এলো কোত্থেকে? বাংলাদেশে এই শ্রেণীর জন্ম একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। '৪০-এর দশকে দেশভাগের ফলে হিন্দু মধ্যবিত্তরা দেশত্যাগ করলে নানা ক্ষেত্রেই একটি শূন্যতা তৈরি হয় এবং বাঙালি মুসলমানরা ব্যাপারটাকে গ্রহণ করে একটি সুযোগ হিসেবে। নিরক্ষর কৃষকরা তাদের সন্তানদেরকে স্কুল-কলেজে পাঠাতে শুরু করেন। তাদের আশা ছিলো - এই সন্তান শিক্ষিত হয়ে চাকরি বাকরি করবে - 'বড় অফিসার' হবে, 'ভদ্রলোক' হবে। তাদের সেই আশা পূরণও হয়েছিলো, কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়। কৃষকের সন্তান হঠাৎ করে ভদ্রলোকে পরিণত হলে এবং মধ্যবিত্তের জীবনযাপন শুরু করলে তাদের পক্ষে পিতৃপরিচয়টিই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। কারণ বাপ-মা-ভাইবোন বা অন্য আত্নীয়স্বজন তাদের 'মর্যাদা' কমায় বৈ বাড়ায় না। ফলে পিতৃ-মাতৃকুলের সঙ্গে তারা একটি ইচ্ছেকৃত দূরত্ব তৈরি করে নিলো। কৃষকের সন্তানেরা চাকরি-বাকরি করে ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করেছিলো এবং যথাসম্ভব দ্রুত নিজেদের শরীর থেকে মাটির গন্ধ মুছে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু এই কাজে তারা পুরোপুরি সফল হয়েছিলো তা বলা যাবে না। যতই চেষ্টা করুক না কেন, হাজার হলেও মা-বাপ, তাদেরকে একেবারে অস্বীকার তো করা যায় না! তবে এই মধ্যবিত্তদের প্রথম প্রজন্ম নানাবিধ কারণে নিজেদের অতীতকে পুরোপুরি অস্বীকার না করতে পারলেও, দ্বিতীয় প্রজন্ম তা অনেকখানিই করেছিলো এবং তৃতীয় প্রজন্মে এসে এই অস্বীকৃতি পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তারা ভুলেই গেছে যে তাদের পূর্বপুরুষ কোনো একসময় কৃষক ছিলো। অর্থাৎ একজন কৃষকের পুত্র ভদ্রলোকে পরিণত হবার পর নিজের বাপ-মাকে অস্বীকার না করতে পারলেও, তার পুত্র অর্থাৎ ওই কৃষকের নাতির জন্য তার দাদাকে অস্বীকার করাটা খুব বেশি অসম্ভব নয়। তবে আফটার অল দাদা তো, তাই পুরোপুরি অস্বীকার সে করে না, কিন্তু তার পুত্র অর্থাৎ ঐ কৃষকের পৌপুত্রের জন্য কৃষকের অস্তিত্ব স্বীকার করবার কোনো প্রয়োজনই নেই। আমাদের দেশে এই ঘটনাটিই ঘটেছে। ৩/৪ পুরুষ ধরে শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত পরিবারের কাউকে খুব শক্ত করে ধরে আপনি যদি জেরা করতে থাকেন, তাহলে তারা একসময় হয়তো স্বীকার করবে যে, তাদের কোনো এক পূর্বপুরুষ গ্রামে বাস করতেন বটে, তবে তিনি মোটেই কৃষক ছিলেন না, ছিলেন জমিদার! একসময় যেমন মুসলমান সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন দাবি করতেন যে, তাদের পূর্বপুরুষরা আরব থেকে এসেছেন - এই দাবিটিও সেরকম। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে সবার পূর্বপুরুষই যদি জমিদার ছিলো তাহলে কৃষক ছিলো কে? কিংবা বাংলাদেশে মোট জমিদারের সংখ্যাই-বা কত ছিলো? কতই-বা ছিলো মুসলমান জমিদারের সংখ্যা?

১৪/১৫ বছর আগেও আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন অন্তত ৫০% ছাত্র আসতো গ্রাম থেকে - মূলত কৃষক পরিবার থেকে। কিন্তু পারতপক্ষে তারা সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করতো না, প্রসঙ্গ উঠে গেলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতো, নাছোড়বান্দার মতো কেউ লেগে থাকলে স্বীকার করতো বটে যে সে গ্রাম থেকেই এসেছে - কিন্তু সেখানে তার বাবা বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক। ঘনিষ্ট বন্ধুরা ছাড়া কেউ আসল সত্যটা জানতে পারতো না। এই অবস্থা এখনও চলছে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্তত শতকরা ৫০ ভাগ ছাত্রই গ্রাম থেকে আসে, কিন্তু সেটা তারা স্বীকার করে না। এ অবস্থায় আপনি যদি এ নিয়ে সেখানে জরিপ চালান, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ভুল এবং বিভ্রান্তিকর ফলাফল পাবেন। আর আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এইসব পরিসংখ্যানজাত ফলাফলের ওপরই সবসময় নির্ভর করেন এবং পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। জনজীবনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের হাতে পড়ে আমাদের চিন্তার জগৎটি কেমন যেন একপেশে তত্ত্বনির্ভর-পরিসংখ্যাননির্ভর-বইনির্ভর হয়ে পড়েছে; যার ফলে আসল সত্য কোনোদিনই আমাদের জানা হয়ে ওঠে না। যাহোক, দেখা যাচ্ছে - মধ্যবিত্তরা, কিংবা মধ্যবিত্ত হবার প্রক্রিয়ার ভেতরে আছে এমন লোকেরা নিজেদের শেকড়কে অস্বীকার করতে চায় - এটি মধ্যবিত্তদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। যেমন, আমাদের মধ্যবিত্তরা ভুলে গেছে তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন এদেশের খেটে খাওয়া মানুষদেরই একজন। আর ভুলে গেছে বলেই নিম্নবিত্তদের সম্বন্ধে অত্যন্ত নিচু ধারণা পোষণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়।

আগের পর্বগুলোর লিংক :

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০১
Click This Link

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০২
Click This Link

মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০৩
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১০:৪০
২৩টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুরনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:১৫

ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×