somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষ হলো সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কুস্তি খেইড়

২২ শে অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুনামগঞ্জের গ্রাম এলাকার ঐতিহ্যবাহী কুস্তি খেইড় (খেলা) ধুমধামের সঙ্গে শেষ হয়েছে। প্রতিবারের মতো এ বছরও প্রায় সহস্রাধিক কুস্তি উৎসব অনুষ্টিত হয়েছে। গত শনিবার জামালগঞ্জ উপজেলা মাঠে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টের মাধ্যমে এ বছরের কুস্তিখেলার সমাপ্তি টানা হয়েছে। মানুষে মানুষে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে এমন নির্মল উৎসবের জন্য এলাকাবাসী আগামী বছরের জন্য মুখিয়ে রয়েছেন।
গ্রাম ভেদে এই খেলাকে ভাইয়াপি ও দাওয়াতি কুস্তি নামে পরিচিত এ উৎসব বর্ষা মওসুমে শুরু হয়ে টানা প্রায় ৪-৫ মাস লোকজন এই খেলায় মেতে থাকে। বর্ষার পর গ্রাম হাওর এলাকার মানুষের হাতে যখন কোনও কাজ থাকেনা তখনই মালদের (কুস্তিগীলরদের) চাপে মুরব্বিরা এই খেলার আয়োজন করেন। সদরের মোহনপুর, লণশ্রী, গৌরারং , শিমুলবাক , জামালগঞ্জের ভীমখালি , সাচনাবাজার ইউনিয়নসহ বিশ্বম্বরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার বেশ কিছু গ্রামে বেশি কুস্তিখেলা অনুষ্টিত হয়।
কুিস্তখেলা বুঝতে হলে আগে এই খেলার পরিভাষা বুঝতে হবে। কুস্তিগীরদের ’মাল’ বলা হয়। খেলাস্থলকে বলা হয় ‘থলা’ বা মাঠ।' খেলোয়াড়দের উদ্দিপ্ত করতে যে ছড়াধর্মী গান গাওয়া হয় তাকে ‘হাইর’ বলে। খেলাকে চিহ্নিত করা হয় ‘ভাইয়াপি’ (প্রীতি) ও দাওয়াতি খেলা হিসেবে। খেলায় যারা বিচারকের দ্বায়িত্ব পালন করেন তাদের ‘আমীন’ বলা হয়। এখন এসবের পাশাপাশি টুর্নামেন্টও হচ্ছে। খেলোয়াড়দের পরাজিত করার কৌশলকে বলা হয়, ‘প্যাছ’। বিভিন্ন প্যাছের নাম হলো, বাইমা, আউকরা, বাল্লা, ঘারি মোছকা, বস্তাটান ইত্যাদি। বিভিন্ন কারণে খেলায় আগের চেয়ে উত্তেজনা বেড়েছে, এসেছে বৈচিত্র।
কুস্তি খেলাকে কেন্দ্র করে এলাকায় সপ্তাহখানেক আগ থেকেই উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। আয়োজক গ্রামের লোকজন আতœীয় স্বজনকেও খেলা দেখার জন্য দাওয়াত দেন। কুস্তিখেলার মাধ্যমে আশপাশের গ্রামের লোকদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়, বাড়ে সাংস্কৃতিক লেনদেন। প্রবীন কুস্তিগীররা জানান, যুগযুগ ধরে কুস্তিখেলা এই অঞ্চলের বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কের েেত্রও বড়ো ধরনের ভুমিকা রেখে আসছে। তাই এই খেলাকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা পৃষ্টপোষকতা কামনা করেন।
গত এক দশক এই ঐতিহ্যবাহী খেলাটি বন্ধ ছিল। ২/৩ বছর আগে আবার এই খেলাকে জাগিয়ে তুলেন প্রাক্তন খেলোয়াড়রা। তারা সময়ের প্রয়োজনে ভাইয়াপি ও দাওয়াতি খুস্তির বদলে শুরু করেন টুর্নামেন্ট। দাবি উঠে খেলার লিখিত আইন কানুনের। এক সময় ভাইয়াপি-দাওয়াতি খেলায় শুধু স্বাগতিক গ্রাম ও আমন্ত্রিত গ্রামের লোকজন অংশ নিলেও স¤প্রতি টুর্নামেন্ট রূপে আয়োজন করায় এতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এখন এই খেলায় ইচ্ছে করলে যে কোনও গ্রামের লোকজন তাদের গ্রামের ‘মালদের’ গ্র“প নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। মোহনপুর গ্রামের সাবেক নামকরা কুস্তিগীর ফরিদ মিয়া বলেন, কুস্তিখেইড়ের যৌবন ফিরে এসেছে। নতুন প্রজন্মের শিতিরা আকৃষ্ট হচ্ছে।
তিন পর্বের দাওয়াতি খেলা একদিনে শেষ হলেও টুর্নামেন্টে কয়েক দিন লেগে যায়। প্রথম পর্বে প্রাথমিক মানের খেলোয়াড়দের, ২য় পর্বে ছানি দাগা বা ২য় সেরাদের, এবং ৩ য় পর্বে দাগার মাল বা সেরা কুস্তিগীরদের দিয়ে খেলানো হয়। দাগার মালদের খেলার উপরই জয় পরাজয় নির্ধারিত । দাগার খেলা শুরু হলে মাঠের দর্শকরা রুদ্ধশাসে অপো করেন কে কাকে ধরাশায়ী করে। কোনও মাল যখন কোনও মালকে ধরাশায়ী করে তখন বিজয়ী শিবিরসহ পুরো মাঠ বিভিন্নধর্মী শ্লোগানে কেঁপে উঠে। হাজারও মানুষের কন্ঠধ্বনীতে ‘সবাই বলরে আল্লার নাম’ হাইর তুলে বিজয়ী শিবির। মালদের স্তুতি বেড়ে যায় সর্বত্র। তাদের পৌরুষ নিয়ে রমনীমহলেও আলোচনা ওঠে।
সুনামগঞ্জের এই কুস্তিখেলার সাথে অন্য অঞ্চলের খেলার তফাত লণীয়। এখানে ‘মাল, পরাজিত ধরা হয় হাঁটু থেকে শুরু করে শরীরের কোনও অঙ্গ মাটি ছুঁলে। শূন্যে তোলা দিলেও পরাজিত ধরা হয়। খেলার বিচারকের দ্বায়িত্ব পালন করেন সাবেক প্রখ্যাত কুস্তিগীররা।
কুস্তিখেলার দিন তারিখ নির্ধারিত হলে মুরব্বিরা কুস্তিগীরদের নিয়ে স্বাগতিক গ্রামে হাজির হন। আমন্ত্রিত গ্রামের কুস্তিগীর ছাড়াও গ্রামের অধিকাংশ লোকজনই স্বাগতিক গ্রামে আথিথেয়তা গ্রহণ করে। খেলা শেষে ফলাফল খারাপ হলেও আবারো আপ্যায়িত করেন মেহমানদের।
স্বাধারণত নদী তীরবর্তী গ্রাম ও হাওরএলাকার গ্রাম গুলোতেই এই খেলা হয়ে থাকে। খেলায় যাওয়ার সময় ‘হাইর’ গেয়ে গ্রামের লোকজন যান। আবার বিজয়ী হলেও ঢোল করতালের বাদ্যে গ্রামে ফিরে আসেন। এই সময় গ্রামের চারণ কবিরা বিজয়গাঁথা ও মালদের প্রশংসা করে গান রচনা করেন। এ গান গেয়েই বাড়ি ফিরেন তারা। বিজয়ী মালদের ‘হাইর’ শোনে ঘরের বউঝিরাও বেড়িয়ে আসে। গ্রামের যারা খেলায় যেতে পারেনি তারাও মালদের বরণ করে নেওয়ার জন্য হাইর-মিছিলে এগিয়ে আসে। এভাবেই কুস্তি-বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠে পুরো গ্রাম।##



৬টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×