somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সীমান্ত শহরে তিনটা দিন

১৬ ই অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৫:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আবার ঘুরে এলাম বর্ডার টাউন 'সাতক্ষীরা' থেকে। তবে এবার উপলক্ষ ছিলো ভিন্ন। পৌছেছিলাম দশমীর দিন, বিসর্জন দেখতে। সাথে সুন্দরবন ঘুরে এসেছি খানিকটা।

যাত্রা:
আমার বাস রাত সাড়ে দশটায়। কিছু কেনাকাটা বাকি থাকায় খানিকটা আগেই বাসা থেকে বেরুলাম। কিন্তু যা কিনবো তা পেলাম না, বন্ধু আমিন অপেক্ষা করছিলো ক্যাম্পাসে, ওর ও যাওয়ার কথা ছিলো আমার সাথে, যেতে পারছে না বলেই টিকিট কাটার ঝামেলাটা ওই করেছে। ক্যাম্পাসেই আড্ডা মারলাম সাড়ে নয় পর্যন্ত। তারপর আমিনকে নিয়েই কলাবাগানের জন্য রওনা, আমার সাথে না যেতে পারার কারনে খানিকটা অপরাধ বোধ থেকেই বোধহয় আমাকে এগিয়ে দিতে চাইলো। যেহেতু খাওয়া হয়নি, কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডের কাছে এক হোটেলে বসে পড়লাম, চাইলাম পরাটা-গরুর মাংশ। বাসস্ট্যান্ডের হোটেলের মানুষগুলোর একটু তাড়াতাড়ি কাজ করার অভ্যাস থাকার কথা, কেননা খদ্দের সবাই এখানে ব্যস্ত। কিন্তু এ হোটেল দেখলাম একদম উল্টা। যাইহোক, পেটের শান্তির পর এবার নতুন টেনশন 'পাশের সহযাত্রী না জানি কেমন'!

কল্যানপুরে বাস বদলের পর আসল বাসটায় উঠতে পারলাম, যেটা আমাকে সাতক্ষীরা নিয়ে যাবে। তবে তার আগে কল্যানপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা দারুন জিনিস দেখলাম, সেটা হলো বাসের চাকা থেকে টায়ার খোলা। জিনিসটা নিয়ে আমার খানিকটা কৌতুহল ছিলো, তা মিটলো। শুরুটা তো অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে, মূল কাহিনীতে যাই। ও আচ্ছা, সহযাত্রী কোন জামাত-শিবির বা হুজুর বা মুরব্বি কেউ ছিলো না। কোন ঝামেলার মনে হয় নাই। কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুম দিয়েছি। একঘুমে রাত পার, আর আমি সাতক্ষীরা।

দশমীর ইছামতি: বাংলাদেশ-ভারত মিলন মেলা:

নদীর নাম ইছামতি। বয়ে গেছে বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানায়। নদীও আধা আধি ভাগ। শুধু এই দশমীর দিন দেবী বিসর্জন দিতে এখানে দু দেশের মানুষ মিলিত হয় সীমানা ছেড়ে। এপারে টাউন শ্রীপুর, ওপারে টাকি।

সকালে খানিকটা ঘুম দিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম দেবহাটা যাওয়ার জন্য। ওখান থেকেই ট্রলার নিয়ে নদী ধরে এগুলাম টাউন শ্রীপুরের দিকে। যেতে যেতে দেখছিলাম ওপার থেকেও নৌকা-ট্রলার এগুচ্ছে একই পথে। আর এপারে নদীর পার ঘেষে পায়ে হাটা পথ দিয়ে অসংখ্য মানুষ যাচ্ছে একই উদ্দেশ্য, যারা নদীর পারে থেকেই দেখতে চায় এই মিলন মেলা।










ট্রলারে প্রায় আধা ঘন্টা যাওয়ার পর অবশেষে পৌছালাম সে মেলায়, যেখানে অসংখ্য নৌকা সেজে আছে, কোনটায় বাংলাদেশের পতাকা, কোনটায় ভারতের। এসেছে নানা সংগঠন, মন্দির কমিটি তাদের দেবী বিসর্জনে, কোনটা আবার নানা রংয়ের মানুষ নানা ধরনের ভাড়া নৌকায়। আবার কোনটায় পরিবার, যাদের উদ্দেশ্য মূলত বেড়ানো, চেয়ার, মাদুর, বালিশ বিছিয়ে একেবারে নৌ ভ্রমণ। কোনটায় বন্ধুরা আড্ডায়। আমরা এপার ওপার করলাম বেশ কয়েকবার, যায়গাটা নিয়ে ঘুরলাম কয়েক পাক। যখন দু দেশের নৌকা পাশাপাশি, তখন চলছে নানা রকম শুভেচ্ছা বিনিময়, ইশারায়, হাত নেড়ে। কেউ কেউ এগিয়ে দিচ্ছে নাড়ু, কোন ফল, সিগারেট। ওরা খুব খুশি হল আমাদের বেনসন পেয়ে, যতগুলো ছিলো ওদের দিলাম, আগে মনে থাকলে আরও বেশি করে নিয়ে আসতাম। বিডিআর - বিএসএফ টহল দিচ্ছিলো এর মধ্যেই, যেন এক দেশের নৌকা অন্য দেশে ভিরাতে না পারে। দু-পারের অসংখ্য মানুষ দাড়িয়ে ছিলো গ্যালারীর মত, আমরা ভারতের পারের মানুষদের সাথে হাতে হাত মিলিয়েছি, কিন্তু নৌকা থামাইনি পারে। যদিও শুনেছি, এ মেলা চলবে রাত পর্যন্ত। অন্ধকার নামলে চলবে পারাপার।

একটু অন্ধকার হলেই ওপারে শুরু হলো আতশ বাজির খেলা। প্রথমে খানিকটা ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করে বুঝলাম এ চেষ্টা বৃথা। তাই আর চেষ্টা না করে দেখতে থাকলাম শুধু। এবং অবশেষে আমাদের ফেরার সময় হলো। দুপুর থেকে ধীরে ধীরে জমা মানুষরা সন্ধ্যায় যখন ফিরছে তখন তা এক মিছিলে পরিনত হয়ে গেছে, এবং আমি নিশ্চিত এর মধ্যে কিছু হলেও ভারতের মানুষ আছে। আমরাও সে মিছিলে মিশে ফিরে এলাম।

নলতা মাজার:

দেবহাটা থেকে আরও খানিকটা সামনে সখিপুর পেড়িয়ে নলতা। সেখানে মাজার আছে একটা, যাকে ঘিরে আমার ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি আছে। এ মাজারটা জনাব আহসানুল্লার। যতদুর জানি, তিনি তথাকথিত পীর ছিলেন না, আধুনিক শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। আহসানিয়া মিশন বা এর সাথে যুক্ত সব সংগঠনই তার নামে। তিনি তার উত্তরসূরি রেখে গেছেন তার এক খাদেম কে। তিনিও একজন অসাধারণ মানুষ। তিনিই এ মাজারের পরিচালক, একই সাথে দেখাশুনা করেন পাশের মাদ্রাসা, এতিম খানার। কিন্তু থাকেন খুব সাধারণ। তার থাকার রুমটা দেখতে গিয়ে অবাক হলাম। খুবই সাধারণ ঘর, প্লাস্টার ছাড়া দেয়াল, উপরে টিন, মেঝেতে একটা বিছানায় দুটা বালিশ, একটা মিটসেফ, একটা আলমারি, আসবাব বলতে এতটুকুই। পরেন সাদা একটা কাপড়, খালি পা। পাশেই অতিথিদের জন্য তিনটা অতিথিশালায় খুব ভালো থাকার ব্যবস্থা রাখলেও তিনি সাদামাটা থাকতেই পছন্দ করেন। বৃহস্পতি আর শুক্রবার গরিবদের খাওয়ান, নিজেই রান্না ও খাওয়ার তদারকি করেন, নিজে যদিও সারা বছরই রোজা রাখেন (কয়েকটা দিন ছাড়া)।



নলতা বেড়ালাম, ওখানে খেলাম, দু-একটা ছবি তুললাম। তারপর আবার রওনা দিলাম বুড়িগোয়ালিনীর দিকে। ওদিকে সুন্দরবন।

জোছনা মাখা সুন্দরবন:

সুন্দরবন যাবার সিদ্ধান্ত নিতে নিতে দেরি হয়ে গেল আমাদের। নলতা থেকে রওনা দিতে তিনটা। শ্যামপুর থানা থেকে এসি (ল্যান্ড) সাহেবকে জানালাম আমাদের সুন্দরবন যাবার ইচ্ছের কথা। উনি নিজেও রাজি হয়ে গেলেন আমাদের সাথে যেতে। নীলডুমুর রেঞ্জে পৌছাতে আমাদের বিকেল হয়ে গেল, ট্রলার ভাড়া করে রওনা হতে সন্ধ্যে প্রায়। মাঝে আরেকটা সাব -রেঞ্জ অফিস থেকে গার্ড নিতে হলো। শেষ পর্যন্ত যখন সুন্দরবন খালে ঢুকলাম তখন সূর্য ডুবে গেছে, আকাশে অর্ধেক চাঁদ। আধো অন্ধকার আর অর্ধেক চাঁদের আলোয় আমরা যতটা সম্ভব ভিতরে ঢুকতে থাকলাম। কিন্তু ফেরার তাড়া ছিলো, ফিরতে হবে সাতক্ষীরা আবার প্রায় ৭০-৮০ কিঃমিঃ পেড়িয়ে মটর সাইকেলে। খালের এক বাঁকে শেষে ট্রলার থামিয়ে বসে থাকলাম খানিকটা, শান্ত পানি, সুন্দরবনের নির্জনতা, ঘরে ফেরা কিছু পাখির ডাক আর জোছনা মাখা বন খানিকক্ষণের জন্য হলেও অন্য এক জগতের স্বপ্ন দেখালো আমাদের।

বিশ্রামের দিন: সাথে বোনাস আড্ডা:

গত দু'দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত ছিলাম খুব। একটা দিন তাই বিশ্রামে কাটালাম। সারাদিন টিভিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের হেরে যাওয়া দেখলাম, দুপুরে দাওয়াত খেলাম এক বাসায়, বিকেলে আড্ডা দিতে গেলাম এক বন্ধুর সাথে। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। এখন এখানে ব্যবসা করে। শ্যামনগর এক বন্ধু চাকরি করে। সেও এলো। রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ফিরলাম সেদিন।



এবং মায়া:
সাতক্ষীরা এবার ছিলাম ডরমেটরিতে। প্রতিদিন সকালে ছাদে উঠে সিগারেট খেতাম। এ ডরমেটরীর বাসিন্দা খুব কম, গড়ে ৪/৫ জন থাকে। প্রথমদিনই ছাদে উঠে বুঝেছিলাম এখানে তেমন কেউ আসে না। অনেকদিনপর আমাকে দেখতে পেয়ে ছাদে বেড়ে ওঠা আগাছাগুলো যেন খুশি হয়েছিলো। আমার সকালে ফিরতি বাস। প্রতিদিনের মত ছাদে উঠলাম, সিগারেট খেলাম, নেমে আসার সময় হঠাৎ খুব মায়া হল এ জায়গাটার জন্য, আগাছাগুলোর জন্য, এ নির্জনতার জন্য। আবার আমাকে ফিরতে হবে ধুলো-বালি মাখা শহরের জঞ্জালে। মায়াটা তবু থেকেই যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৫:১৯
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×