somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিনলিপি ৬: ঈদের বাজারে ওভারব্রিজের ভেড়া

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মৌচাক ওভারব্রিজটার উপর দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তা পার হবার জন্য ওভারব্রিজে উঠে যাবো এত ভদ্র বাঙ্গালি এখনো হইনি,বিশেষ করে রাত ৯টার পরে যখন মূল রাস্তাটা পার হবার একটা সুযোগ আছে। উদ্দেশ্য হলো উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা জরিপ করা চারমাথার কোনদিক থেকে একটা পা গলানোর মত বাস আসবে যেটাতে উঠে নিজের গুহায় ফিরবো, সেই সাথে ঈদের নাচন দেখে গরম হয়ে যাওয়া মাথাটা খোলা হাওয়ায় একটু ঠাণ্ডা করে নেয়া,যদিও এই মুহূর্তে দু'টোর কোনটাই ঠিক কার্যকরী মনে হচ্ছেনা।

ব্রিজটাতে অন্য সময় আমার মতই কিছু হাওয়া প্রত্যাশী বেকার লোকজন থাকে,কিন্তু আজকে ঠিক এই সময়ে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না,শুধু বস্তাখানেক শপিং করে যাওয়া মোটাসোটা ছানাপোনাসহ দুয়েকজন মহিলার পার হবার জন্যই ওভারব্রিজটা ব্যবহৃত হচ্ছে,এই পরিমাণ জিনিস নিয়ে নিচ দিয়ে রাস্তা পার হওয়া বিপজ্জনক বটে। হাওয়া খেতে খেতেই নিচের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি,খালি বাস আসার কোন লক্ষণ নেই,চারদিক থেকেই অধৈর্য্য গাড়ি আর বাসের হর্নে এই রাতের রাস্তা অস্থির,মাঝ দিয়ে রিকশার টুংটাং গিট্টু আর দানবীয় ট্রাকের পিষে যাওয়ার ইচ্ছাকে দমন করতে ট্রাফিক পুলিশের লাঠিবাজি আর দাঁত খিঁচুনি,সব মিলে পারশিয়ান নট সিচুয়েশন,খোলে কার বাবার সাধ্য! এরই মাঝে,বা বলা চলে,উপরে,দাঁড়িয়ে আমি,মৌনী সাধুর মত কি আছে দুনিয়াতে ভাব ধরার চেষ্টায় আছি।অন্য ওভারব্রিজগুলোর মত বর্জ্য পদার্থের গন্ধ নেই বলে আর নিজের স্বাস্থ্যটা সাধুদের কাছাকাছি চলে গেছে বলে মৃদুমন্দ হাওয়াতে নিজেকে কৈলাসের চূড়ায় ভাবাটা খুব একটা কঠিনও ছিল না,তবে কিনা, নিচের আইল্যান্ডে শুয়ে থাকা হাভাতে কংকালসার মানুষগুলোকে উপেক্ষা করা গেলেও হাইহিল চেগিয়ে হেঁটে যাওয়া রঙচঙে আঁটোসাঁটো ললিপপদের উপেক্ষা করতে হলে সাধনার অনেক উচ্চস্তরে আরোহণ করতে হবে, বিশেষ করে যখন তাঁরা প্রতিজ্ঞাই করে বসেছে পোশাকের
বাহারে না হোক স্বল্পতায় আর চুলের দৈর্ঘ্যে না হোক উৎকট রঙে হলেও সবার নজর তাদের দিকে ফিরিয়েই ছাড়বে।

কাজেই পারছি না। অবশ্য রংঢং দেখার জন্য মার্কেটের ভেতরে ঢোকাই উচিত ছিল,কিন্তু খোদা জানেন কাজটা আমি পছন্দ করি না, একগাদা লোকের অর্থহীন অর্থের ছড়াছড়ি দেখলে নিজেকে কেমন জানি মিসকিন মিসকিন লাগে,তারপরেও টিউশনি করে ফেরার পথে ভেবেছিলাম নিজের দীনহীন বেশ নিয়েই ঢুকে পড়বো। কিন্তু ওভারব্রিজের গোড়ায় দাঁড়িয়েই মানুষের কোলাহল ছুটোছুটি টুংটাং ধুমধাম ঘামের আর খাবারের গন্ধ আর নিচের ভিখারি আর টোকাই আর কাগজকুড়ানো বাচ্চাটা আর মৌচাকের ভেতরের গরম হাওয়াটা এমন ধাক্কা মারলো যে বেশি না ভেবেই একছুটে আমার আপাত কৈলাসে উঠে গেলাম, উপর থেকে মজা দেখা সবসময়ই ভালো যেমন আমাদের উপরওয়ালারা আমাদের লাগিয়ে দিয়ে মজা দেখেন আর দৈ মেরে খান।

তো আমি আধো আঁধারে ডুবে আছি,যদিও দৈ খাবার সামর্থ্য আপাতত নেই,বরং আরেকবার অপ্সরাদের দিকে নজর দেয়া যাক। নিচে দুই সুন্দরী দু'হাতে বেড় দিয়ে অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে রিকশা খুঁজছে,মাবুদ সাক্ষী রিকশাওয়ালাদের প্রাণে দয়ামায়া নেই,তাদের করুণ মিনতি দেখে আমারই ইচ্ছা হচ্ছে নেমে ব্যাগগুলো বাড়ি দিয়ে আসি কিন্তু চালকরা সিটের উপর পা তুলে যেভাবে বিড়িতে টান দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী চেয়ে আছে,এখন উর্বশী-রম্ভা নেমে এলেও তাদের ধ্যান ভাঙানো যাবে এমন বোধ হয় না, পুরাণের যুগে রিকশা থাকলে নিশ্চিতভাবেই এদের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য ইন্দ্রকে নতুন কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হতো।

দাঁড়িয়ে মজা দেখি,মানুষের মাঝে একটা ভয়ংকর প্রতিহিংসাপরায়ণ কেউ আছে,ঈর্ষাপরায়ণ একটা দানব সবসময় বেরিয়ে আসার জন্য খোঁচাখুঁচি করে,বড় বেশি স্যাডিস্ট,শুধু কষ্ট দেখে আনন্দ পেতে চায়,শুধুই নিজের অপ্রাপ্তিকে অন্যের ধ্বংস দিয়ে ঢেকে দিতে চায় টাকা থাকলে নিশ্চিত আমার অবস্থান উল্টো মেরুতে হতো,সেটা জানার পরেও আইল্যান্ডের ঘুমন্ত মানুষগুলোকে নির্মম পরিহাস করে ঝুড়ি ঝুড়ি কাপড় কিনে হাজার হাজার টাকা একবেলায় উড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে অভিশাপ দিতে ইচ্ছা করে। নিশ্চিতভাবেই আইল্যান্ডের লোকটা আমাকেও অভিশাপ দেয় যখন ঈদের দিনে ধোয়া পান্ঞ্জাবি পরে আমি নামাজ পরতে যাই,নিশ্চিতভাবেই আমি রাস্তার কাগজকুড়ানো শিশুটার নীরব অভিশাপে ভস্ম হয়ে যাই যখন ঈদের দিনে ঘন দুধের সেমাই খেয়ে গ্রীলড চিকেনের সন্ধানে বের
হই। অভিশাপ আমাদের পায়ে পায়ে ঘোরে,সমস্যা হলো,সেটা মাপার জন্য কোন যন্ত্র এখনো বের হয়নি,নয়তো নিজের শাপমিটার দেখে আমরা অনেক আগেই আত্মহত্যা করে যেতাম।

অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছি,হয়তো ১০টা বাজে,মোবাইলটা বের না করেও বুঝতে পারি। নেমে যাওয়া দরকার,নয়তো আমাকেও ছিনতাইকারী ভেবে বসা বিচিত্র কিছু না,নিজের চেহারার উপর বিশেষ ভরসা কোনকালেই ছিল না। নামার পথে সিঁড়িতে আরো ভিক্ষুক, নানা বয়সের,বুড়ো,শিশু। হয়তো পাপ ভিক্ষা করা,কিন্তু বাড়ানো হাতগুলো এখনো তো ঝাঁপিয়ে পড়েনি পাশ দিয়ে নির্লজ্জের মত গাড়ি হাঁকিয়ে যাওয়া কারো উপর,যারা কিনা গুলশানের ৪২০০ টাকার ইফতার প্যাকেজ দেখে বিজ্ঞ মতামত দিয়ে যাচ্ছে হুম প্রাইসটা রিজনেবল। এখনো তারা আগুন ধরিয়ে দেয়নি কারো বাড়িতে যারা লাখ টাকার ঈদের শপিং করে চলেছে
আমাদেরই টাকা মেরে,আর বলে যাচ্ছে নাহ এবারের কেনাকাটা মনমতো হলো না,আমার ক্লাসমেট কিনেছে ১০ হাজার দিয়ে,আমাকে কিন্তু আরেকটা কিনে দিতে হবে,ঐটার দাম খুব কম কিন্তু,মাত্র ২৫ হাজার। ঝুড়িটাকে বিছানা বানানো বাজারের মুটে এখনো দাবী তোলেনি আলীশান ঘুষের বাড়িগুলোর ইট খুলে তার ঝাঁকা ভরে দেয়ার,বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলের মজুররা এখনো শুধু নিজেকেই মশাল বানাতে চেয়েছে,কিন্তু সেই মশাল দিয়ে যাদের পোড়ানোর কথা ছিল সেই রক্তচোষা আমলা ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ কারোরই বিবেকের সলতেতে এতটুকুও শিখা জ্বলেনি। তারা খাবারের মূল্য তেলের মূল্য প্রতিদিনের বাঁচার মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ঘরে রঙিন আলো জ্বালিয়ে ঈদ করবে,তাদের মেয়ের জুতো আসবে প্যারিস থেকে লেহেঙ্গা আসবে ভারত থেকে সালোয়ার কামিজ আসবে পাকিস্তান থেকে,তাদের ছেলের কেডস আসবে নাইকি বা অ্যাডিডাস থেকে গাড়ি আসবে বিএমডব্লিউ এর দোকান থেকে,তাদের হার্টের সার্জারি হবে মাউন্ট এলিজাবেথে আর সেখান থেকে এসে তারা স্কচ হুইস্কি দিয়ে ঢাকা ক্লাব অথবা হয়তো গুলশান ক্লাবে ফ্যাশন শো দিয়ে আমাদের সংস্কৃতি উদ্ধার করে জনগণের পশ্চাতে বাঁশ ঢোকাবেন ঈদের রাতে,শেরাটনের মাতাল সন্ধ্যায় ভবিষ্যৎ সুনাগরিকরা ডিজে পার্টি করে দেশ গড়ার প্রত্যয় নেবে আর ব্লাডি পুওর পিপলদের গুষ্ঠী মারবে ভদকার আর হেরোইনের টানে,আর আমরা ঈদ করবো কোরবানীর ভেড়ার মত পরের বার,আবারো পরের বার এবং তারও পরের বার পৌনপুনিক কোরবানী হবার আশাবাদ নিয়ে।

বৃত্তের শেষ বলে আসলেই কিছু নেই,গুরু আসিমভের ভাবের ডায়ালগের মর্ম উদ্ধার করতে করতে একটা ১০ নম্বর সিটিং সার্ভিসে উঠে পড়ি,যাক ঝিমিয়ে হলেও অন্তত হেঁটে বাড়ি ফেরা লাগবে না,সূর্যমুখর ব্যস্ত শহরে এগুলোই ভেড়াদের ছোট ছোট শান্তিবৃষ্টি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:১০
৫৭টি মন্তব্য ৫৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×