somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুখোশের একটু ভেতরে

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আদিকাল থেকেই সম্পূর্ণ বেকার ঈদের বেশ কয়েকটা সামাজিক অর্থ আছে; এই যেমন নতুন চাকরির সম্ভাবনা, বিদেশ গমনের উচ্চাশা, “ঠিক জায়গায় পৌছানো” আবার তেমনি তুই কোন কামের না, সারাদিন ঘরে বইসা থাকা ভাদাইম্মা, শপিং এর সময় থাকিস (অন্তত এই কাজটাতে যুক্ত থেকে নিজের অস্তিত্বকে অর্থপূর্ণ করা) ইত্যাদি। আমার পরিস্থিত এর চেয়ে একেবারে ভিন্ন না হইলেও এখনো পূর্ণাঙ্গরুপে কোন চেহারা পায় নাই। আমি এই ঘোলাটে চেহারা থেকে যতভাবে সম্ভব নিরাপদে পূর্ণ চেহারায় যাবার চেষ্টায় আছি তবে অনেকের মতে যথেষ্ট উদ্যমের সাথে নয়। হয়ত সংকট উপলব্ধি আমার দেরীতেই হয়। কি আর করা। দীর্ঘদিন এক বন্ধুর সাথে দেখা হয় না, আর তার কাছ থেকে জন্মদিনের বাকী থাকা, কাঠাল চাঁপার গন্ধও নেয়া হয় না। কিন্তু আমার সময় ভালৈ কাটছে বলা যায়, থিসিস আর এই বিষয়ে মাষ্টরের ঝাড়ির মিলনে একটা জটিল পরিস্থিতি।

অবশেষে বন্ধুটি বাসায় এল, তাকে দেয়া পূর্বতন ঝাড়ির (মাষ্টরের ঝাড়ির সংক্রমণের ফলাফল, খুবই অন্যায় কাজ যদিও) শোধ তুলতে। ঝাড়ি এবং অন্যায় আচরণের কারণ হেতু বিষয়ক বেশ চমৎকার দীর্ঘ কোস্তাকুস্তি আলাপের পর যখন পরিস্থিত একটু শান্ত এবং সময় প্রায় সন্ধ্যা তখন সে নিজেই প্রস্তাব করল, চল আজকে একটু বেড়িয়ে আসি। আমি বললাম রেইঞ্জ কতদূর? সে প্রায় অর্ধেক ঢাকা শহরের কথা এক নি:শ্বাসে বলে ফেলল। মিরপুর থেকে শাহবাগ হয়ে ধানমন্ডি পেরিয়ে শুক্রাবাদ পার হতেই আমি তাকে থামিয়ে দিলাম এবং প্রস্তাব দিলাম যে শুধু দুজনে না ঘুরে আমরা বরং তৃতীয় একজন চাকুরীগ্রস্থকে যুক্ত করি, (আমার আরেক বন্ধু, মোটা বেতনে মোটা সংস্থায় চাকরি পেয়ে যে তার স্বতষ্ফূর্ততা হারাতে বসেছে এবং ইদানিং যোগাযোগের এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ভুগতে শুরু করেছে)। যেই কথা সেই কাজ । যদিও অফিস ফেরত তৃতীয় জনকে ১০ নম্বর পর্যন্ত ঠেলে নেয়াতেই আমাদের দম যায় যায় অবস্থা। সে তার অফিসের মতই একের পর এক শর্ত দিতে শুরু করেছে (যেমন ১ঘন্টার বেশি কিন্তু না, ১০ নাম্বারের বাইরে গেলে কিন্তু যাবো না ইত্যাদি ইত্যাদি)।

রিকশায় অনেকক্ষণ গাইগুই করে যখন চাকুরীগ্রস্থ বন্ধুটি রাজি হল ততক্ষণে আমরা প্রায় পৌছে গেছি। নারী বন্ধু ঝটপট রিকশা থেকে নেমে দোকানে ঢুকে পড়ল। ভাড়া মিটিয়ে আমি এবং চাকুরীগ্রস্থ বন্ধুটি তাকে অনুসরণ করলাম। তারপর সে এ দোকান সে দোকান ঘোরে আর মন খারাপ করে বেরিয়ে আসে কিছুই তার পছন্দ হয় না। চাকুরীগ্রস্থ বন্ধুটিও তার অধুনা অর্জিত সমস্ত দক্ষতা ব্যবহার করে পেশাদার কায়দায় নারী বন্ধুটির কাছে তার পোশাকের উদ্দিষ্ট, বাজেট এবং পছন্দটা জানতে চাইল। সেই সময়ই আমি নিশ্চিত হলাম যে নারী বন্ধুটি আমাকে ঈদের উপহার স্বরূপ এবং জন্মদিনের বকেয়া হিসেবে একটি পাঞ্জাবী কিংবা ফতুয়া খরিদ করিয়া দিতে চান। আমার বেশ একটু গদগদ অবস্থা। কিন্তু স্বভাবজাত (যেটাকে খাইসলত বলাই ভালো) শয়তানীতে আমি নারী বন্ধুটিকে বললাম যে এই ধরণের উপহার সাধারণত নারীরা পুরুষদের দিয়া থাকেন সম্ভাব্য জামাই কল্পনা করিয়া। তুমার পরিকল্পনা কি সেইবৎ? আমি আগে থেকেই জানতাম সে তেলেমরিচে বেগুনে বাজারে জ্বলে উঠবে। ঠিক তাই হল, কিন্তু অতিশয় ভদ্র বলে সে আমাকে তখনি কিছু করল না।

এভাবে আমরা এই দোকান দেখি, সেই দোকান দেখি চাকুরীগ্রস্থ বন্ধুটির উষ্মা (যা প্রায় অহমে রূপান্তরিত হয়েছে) আর উদ্বেগ বাড়ে; সে একহাতে পাঞ্জাবী আর আরেক হাতে ঘড়ি দেখে। আমি নারী বন্ধুটির উচ্ছাস ঠান্ডা হবার অপেক্ষা করি, কেননা এরপরই তাকে বুঝিয়েশুনিয়ে বাড়ী নিয়ে যেতে হবে (পাঞ্জাবী/ফতুয়ার টাকাটার পুরোটা ওর নিজের প্রাইভেট পড়ানোর, নাচ শেখানোর এই টাকায় এত দামী উপহার নেয়া আমার ঠিক সহ্য হবে না)। ঠিক সে সময়ই আমার মধ্যবিত্ত মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মত একটা আইডিয়া এল। আমি নারী বন্ধুটিকে বললাম আমি তোমার উপহার নিতে পারি তখনি যদি তুমি আমার মত করে উপহারটা দিতে রাজি হও। সে প্রথম থেকেই আমার অস্বস্তি লক্ষ্য করছিল কিছুটা অসম্মতি নিয়ে সে রাজি হল। আমি বললাম উপহারটা আমি “ও” কে দিতে চাই (নারী বন্ধুটি “ওর” কথা জানতো, পাঠকেরা নিশ্চয়ই মুখ ও মুখোশের তরূণী বিক্রেতার কথা মনে করতে পারছেন মুখ ও মুখোশ... )। এবার সে পূর্ণ সম্মতিতে রাজি হল (এই বন্ধুর জন্য আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা)। আমাদের আলাপে চাকুরীগ্রস্থও তার খোলশ ভেঙ্গে যুক্ত হল। আমরা তিনজনে মিলে “ওর” জন্য উপহার কেনার উদ্দেশ্যে ছুটলাম। চাকুরীগ্রস্থের জমাট চাপও যেন ভেঙ্গে যেতে থাকল।

আমরা তিনজনে মিলে কি দেয়া যায় সেটা নিয়ে আলাপ শেষ করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে “ওর” জন্য ঈদের পোশাক কেনাই সবচেয়ে ভালো হবে (ও যাতে কোনভাবেই অসম্মানিত বোধ না করে এটাই ছিল প্রধান লক্ষ্য, খুব ভালো হয় যদি ও যে দোকানে কাজ করে সে দোকান থেকেই)। ধানমন্ডি শুক্রবাদ ঘুরে যখন “ও” যেই দোকানে কাজ করে সেখানে পৌছলাম তখন আমাকে ও আমার বন্ধুদের দেখে “ও” অবাকই হল। কিন্তু সেই দোকানের কিছুই পছন্দ হয় না। ধানমন্ডি আর শুক্রাবাদ এলাকাতেও পছন্দ আর বাজেট মিলছেনা। “ওর” কাছ থেকে আবার আসছি এমনটা বলে বিদায় নিয়ে আমরা গেলাম গাউসিয়ায়। ভীর-ভাট্টা, বৃষ্টি এবং রাত কোনকিছুই প্রতিবন্ধক মনে হচ্ছিল না। চাকুরীগ্রস্থ তার সমস্ত মোড়ক খুলে আবার পূর্বের রূপে। অনেক দেখেশুনে পছন্দ করে অবশেষে আমরা যেটা কিনলাম সেটাতে তিনজনেরই পূর্ণ সম্মতি আছে। আমার ইচ্ছে ছিল যত রাতই হোক সেই দিনই ওকে উপহারটা দেয়া। কোন এক অদ্ভুত আনন্দে আমরা তিনজনই টগবগ করে ফুটছিলাম। সেদিন রাত এগারোটায় আবার যখন “ওর” দোকানে পৌছলাম ততক্ষনে ও চলে গেছে (সাধারণত এমনটা হয় না ওকে ১১টা পর্যন্তই কাজ করতে হয়, বৃষ্টির কারণে সেদিনে আধ ঘন্টা আগে চলে যেতে পেরেছিল)। আমাদের মধ্যে একটু আক্ষেপ হচ্ছিল। কিন্তু সেটা স্থায়ী না হয়ে বরং উপহারটা দেয়ার উদগ্র কামনা কাজ করছিল।

প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আমরা তিনজন বাড়ী ফিরলাম। উপহারটা আমার সাথেই রয়েছে, আমি একবার খুলি আবার ভাঁজ করে রাখি কিছুক্ষণ দেখি এরপর রেখে দেই। খুবই তুচ্ছ উপহার, দামের, কার্যকারিতার কিংবা প্রয়োজন যেকোন অর্থেই। অথচ একটু ভিন্ন যেন। মধ্যবিত্তের জড় সংবেদনের মধ্যে একটু ব্যাতিক্রম, খুব আশাবাদী হলে হয়ত বলা যেত খানিকটা মুখোশহীন।

পরের দিন উপহার দেবার জন্য আমি ও আমার নারী বন্ধু আবার যখন গিয়েছি তার আগে নারী বন্ধুটি বেশ কয়েকবার পোশাকটা ভালো করে ভাঁজ করেছে, হাত বুলিয়ে দেখেছে। আর আমাকে দোকানদারের কাছ থেকে ভুল করে প্লাষ্টিক প্যাকেটটা না নেবার জন্য ঝাড়ি মেরেছে। আমি আনন্দ নিয়ে সেই ঝাড়ি হজম করেছি। আমার নারী বন্ধুটির মোবাইল নষ্ট হয়েছিল; সেটা ঠিক করিয়ে যখন আবার “ওর” দোকানে ফিরলাম, দেখলাম ও কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর বাইরে ডেকে এনে ওর হাতে উপহারটা দিলাম, প্রথমে ও নিতে চাইলো না। এরপর ওকে বুঝিয়ে উপহারটা ওর হাতে দিয়ে যখন জিগ্গেস করলাম ওর পছন্দ হয়েছে কিনা, ও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলো পোশাকটা এক পলক দেখল (এর বেশি দেখা ওর জন্য সম্ভব ছিল না) এরপর বারবার ধন্যবাদ দিতে থাকলো। ওকে একরকম থামিয়ে দিয়েই পড়াশুনা চালানোর খবরটা দিলাম। এরপর আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার সাহস হল না বিদায় জানিয়ে আমি আর নারী বন্ধুটি ফিরে চললাম। কিছু কিছু মুহুর্ত এমন যেগুলোকে সামাল দেয়ার ক্ষমতা এমনকি আমাদের মুখোশগুলোরও নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সকাল ৭:৪৪
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×