somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বীভৎস.. (ছোট্ট একটি গল্প)

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের পর দু-সপ্তাহের ছুটি। ভাবছি, কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়। সবুজ বললো, চলে আয় শেরপুর। খালাতো বোনের বিয়ে। গ্রামের বিয়ে দেখে যা। আমিও রাজী। কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে আসল বিয়েবাড়িতে বিয়ে দেখার সুযোগ তো হয় না। আর সবুজের বাসাতেও আগে কখনো যাওয়া হয়নি।

সবুজের সাথে বন্ধুত্ব মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর। হোস্টেলে থাকতো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই ও বাড়ি চলে গেল। আমি গেলাম বিয়ের অনুষ্ঠানের দুদিন আগে। শেরপুর সদরে সবুজদের বাড়ি হলেও ওর খালার বাড়ি সদর থেকে দূরে শ্রীবর্দির এক গ্রামে। একরাত সবুজের বাড়ি থেকে সকালে দুজন গেলাম ওর খালার বাড়ি। সবুজের বাবা-মা যাবেন বিয়ের দিন।

গ্রামের বিয়ে। ভেবেছিলাম, মেয়ে আমাদের বয়সীই হবে। এখানে তো আগেভাগেই বিয়ে হয়ে যায়। গিয়ে দেখি, ওর খালাতো বোন সুমি আরো ছোট। বয়স মোটে পনের। কেবল ক্লাস নাইনে পড়ে। অবাক হলাম। সবুজ বললো, গ্রাম এলাকা, তার উপর সুমি সুন্দরী হওয়ায় ছেলেরা বিরক্ত করতো। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে শিস, বাজে মন্তব্য, হাতে চিঠি গুজে দেয়া, ফুল ছোড়া, ওড়নায় টান তো আছেই, অন্যদিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে সুমির জন্য ভালো ভালো প্রস্তাবও আসছিল অনেক। সুমির বাবা-মা মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তায় এবং কিছুটা অতিষ্ঠ হয়েই বিয়ে ঠিক করে ফেলেন পাশের গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের এক ছেলের সাথে।

সুমিদের পরিবারও এখানকার হিসেবে বেশ সচ্ছল। টিনের বাড়ি, বেশ বড়। এই এলাকাতে ইলেকট্রিসিটি না থাকলেও ওদের বাড়িতে বড় হ্যাজাক বাতি আছে। ব্যাটারীতে চলা টু-ইন-ওয়ান আছে। বিয়ের আয়োজনও ভালই। দুদিন আগে থেকেই বাড়ি বিয়ের সাজে তৈরী। সবুজ ছাড়াও সুমির আরো কাজিনরা এসেছে। ওরা মিলেই বাড়ি সাজিয়েছে। লাল-নীল-বেগুনী কাগজ কেটে বানানো ফুল, কাঠ-বাঁশ দিয়ে ছোট একটা গেট, গান বাজানোর জন্য ক্যাসেট-প্লেয়ার, মাইক -সবকিছুর বন্দোবস্তই করা হয়েছে। বাড়ির সামনের বড় উঠোনেই খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। সামিয়ানা টানানোর বাঁশ-খুটিও গাঁথা। রান্নার জন্য বড় কয়েকটা ডেকচি এক পাশে রাখা।

সুমির খালা-ফুফু-চাচারাও কেউ কেউ চলে এসেছেন। সবুজ সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সবার মধ্যেই উৎসবের আনন্দ। অল্প সময়ের মধ্যেই অপরিচিতের সংকোচ কাটিয়ে আমিও সবার সঙ্গে সহজ হয়ে উঠলাম। সুমিও দেখি নিজের বিয়ে নিয়ে বেশ আনন্দিত। লাজ-রাঙা মুখ নিয়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিবেশী মহিলারা যাচ্ছে-আসছে, ওর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় অথবা গায়ে খোঁচা দিয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে, কানে কানে কি যেন বলছে, সুমির ফর্সা গাল গোলাপী হয়ে যাচ্ছে। সবার আনন্দ দেখে আমারও খুব ভাল লাগছে। ঢাকায় কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে খেতে গিয়ে কখনো এরকম ভাল লাগেনা।

রাতে আমাদের থাকার জন্য উঠোনে তাবুমতো খাটানো হলো। কারো থাকার ব্যবস্থা হলো প্রতিবেশী লোকজনের বাসায়। আমি শহুরে মেহমান বলে এক প্রতিবেশীর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা হলো। তবে আমি সবুজের সাথে তাবুতেই থাকব ঠিক করলাম। কিন্তু ওদিন কি আর ঘুম আছে কারো? হৈ-চৈ, আড্ডা আর তাস পিটিয়ে রাত তিনটার দিকে শুতে গেলাম ,তা-ও বড়দের দাবড়ানিতে। সকালে উঠেই আবার বাজার-সদাইসহ নানা কাজ আছে।



হঠাৎ বিকট চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাড়ির ভেতরে মহিলাদের হৈ-চৈ,কান্নার শব্দ। ছুটাছুটির আওয়াজ। ভেতরে গিয়ে দেখি, সুমি দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাটা মুরগীর মতো তড়পাচ্ছে মেঝেতে, চিৎকার করছে-পুড়ে যাচ্ছে মা,জ্বলে যাচ্ছে,আমাকে বাঁচাও। সুমি ওর মায়ের সাথে ঘুমিয়েছিল একঘরে। প্রায় ভোরের দিকে ,সবাই যখন গভীর ঘুমে, জানালার ফাঁক দিয়ে সুমির মুখে এসিড ছুঁড়ে মেরেছে পাশের গ্রামের এক ছেলে। সুমির চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে মা ঐ ছেলেসহ দুজনের চেহারা দেখতে পান জানালার পাশে। সবাই জেগে ওঠায় ওরা পালিয়ে যায়। সবুজ পরে আমাকে বলেছে, বখাটে ঐ ছেলেটা সুমিকে বিয়ে করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল। সুমির বাবা-মা রাজী না হওয়ায় হুমকি দিয়েছিল ,সে দেখে নেবে কিভাবে সুমির বিয়ে দেয়া হয়। স্কুলে যাওয়ার পথে সুমিকে বেশ আজেবাজে কথাও বলেছে। কিন্তু বাড়িতে এত লোকজন থাকা সত্ত্বেও ছেলেটা এত সাহস করবে এটা কেউ চিন্তা করেনি।
সবুজ দ্রুত টিউবওয়েল থেকে বালতি ভর্তি পানি এনে সুমির মুখে ঢালতে লাগল। ঐ দিনই সুমিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। ভর্তি করা হলো ঢাকা মেডিক্যালের বার্ণ ইউনিটে।

হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় আমি একবারই দেখতে গিয়েছিলাম সুমিকে। এসিডে শুধু মুখমন্ডলই বিকৃত হয়নি ওর, ডান হাত আর বুকের অনেকটা অংশ ঝলসে গিয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে। ভাবী বধূর লাজরাঙা,সজীব চেহারাটা তখনও আমার চোখে ভাসছিল। বিষাক্ত তরলের গ্রাসে সেই চেহারা এখন অবিশ্বাস্যরকম কদাকার। দ্বিতীয়বার আর ঐ চেহারা দেখতে যাওয়ার সাহস করতে পারিনি। সবুজের কাছে খোঁজ নিয়েছি। মাসখানেক পর সুমিকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।

পরের কথা:
সুমির বিয়ে তো ভেঙ্গে গিয়েছিলই, যার সাথে সুমির বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সে-ও কখনো ওকে দেখতে আসেনি। বাড়ি ফিরে যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক পর সুমি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। ঐ নরপশুদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও উপযুক্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় সবাই।

এখন কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে চমৎকার সাজ-পোশাক আর অলংকারে সজ্জিত কনের মুখের দিকে তাকালে হঠাৎ-ই ঐ বীভৎস মুখটা ভেসে ওঠে চোখে। আমি কনের সামনে থেকে দ্রুত সরে আসি।
........
(এটি 'মৌচাকে ঢিল' ঈদ সংখ্যায় ছাপা হওয়া গল্পের ইউনিকোড কনভার্সন)
..........................................................................
'মৌচাকে ঢিল' ফাল্গুনী ভালবাসা সংখ্যায় ছাপা হওয়া গল্পের ইউনিকোড কনভার্সন লিংক -
'সেই তিন শব্দ'
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:৫০
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×