somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রজন্মের উত্তরাধিকার

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিশাল হলরুমটা স্তম্ভিত হয়ে আছে উপস্থাপকের ভরাট গলার ঘোষণাটি শুনতে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জুরিদের রায় আর উপস্থিত শ্রোতাদের অনলাইন ভোটের সমন্বয়ে ঘোষিত হবে চূড়ান্ত ফলাফল। জানা যাবে কে হতে যাচ্ছে এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মুক্তকথন প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠ বক্তা।

অবশ্য সায়কের বৃদ্ধ মা-বাবার স্তম্ভিত হওয়ার কারণ তার চেয়েও ভিন্নতর কিছু। তাদের সন্তান সায়ক আজ তাদেরকে চমকে দিয়েছে তার অভিনব কৃতিত্বে। একইসাথে গর্বিতও নয় কি? এই ২০৫২ এর অতি-আধুনিক সময়ে এসে সামাজিক স্ট্যাটাস-আভিজাত্য রক্ষা করতে গিয়ে যখন তাদের মতো উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো থেকে বাংলা নামক ভাষাটির ব্যবহার বিলুপ্তপ্রায়, তখন কিনা তাদেরই ছেলে ইউনেস্কো সদর দপ্তরের সুবিশাল হলরুমে বিশ্বের নানাভাষার বরেণ্য মানুষদের সাথে পাল্লা দিয়েছে, কথা বলেছে বাংলা ভাষায়!

কিন্তু কিভাবে এত সুন্দর বাংলা বলতে শিখল সায়ক? ছোটোবেলা থেকেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করেছে, জন্মের পর থেকেই ওকে তৈরি করা হয়েছে ইংরেজীর সান্নিধ্যে। এমনকি পারিবারিক আবেশেও সতর্কতার সাথে এড়ানো হয়েছে দেশীয়, আঞ্চলিক ভাষার অনুপ্রবেশ। তারপর ও-লেভেল শেষে স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো। এর মাঝে বাংলা শেখার ফুসরত পেল কোথায় ও? অথচ আজ বিশ্বমঞ্চে সেই কিনা করছে বাংলার প্রতিনিধিত্ব! এই ধাঁধার কোনো জবাব নেই এ মুহূর্তে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতোই টিভি স্ক্রীনের সামনে মুগ্ধ হয়ে বসে থাকা সায়কের বাবা-মার কাছেও।

অন্যদিকে সায়কের তখন আর এসবে মন নেই। তার কেবলই মনে পড়ছে শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত সেই বৃদ্ধটিকে। যার ধবধবে চাদর আর পাঞ্জাবি পরিহিত সেই অবয়বটা এখনো ওর চোখে ভাসে। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। আবাল্য শৃঙ্খলে বাঁধা জীবনে সেদিনই কেবল ক্ষণিকের জন্য নিয়মের ব্যতয় ঘটেছিল। বিদেশযাত্রার আগের দিন ওল্ডহোমের পরিপাটি সাজানো ঘরটিতে ওর সাথে দেখা হয়েছিলো সেই অশীতিপর বৃদ্ধের। বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহ, কুচকে আসা চামড়া, কপালের বলিরেখা সবকিছুকে অগ্রাহ্য করেও কি এক অদ্ভূত দ্যুতি ঠিকরে বের হচ্ছিল তাঁর চোখদুটো থেকে। সেই বৃদ্ধটি তার পিতামহ। খুব একটা কিছু বলতে পারেন নি, শুধু বিছানার পাশ থেকে একটা বইয়ের প্যাকেট হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, “এটা তোমার জন্য। সাথে নিও।” যেন তিনি জানতেন একদিন ও আসবে, তাই আগে থেকেই সব তৈরি করে রেখেছিলেন।

বাবা-মা জানলে নানারকম প্রশ্ন করবে ভেবে সায়ক বইয়ের ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল। বিশাল লাগেজে ওটার জন্য জায়গা করতেও খুব একটা বেগ পেতে হয় নি।

অবশ্য বিদেশে এসে বহুদিন সেটা খুলেও দেখা হয় নি। তারপর একদিন হটাৎ করেই বৃদ্ধ পিতামহের মৃত্যুসংবাদ পায় সে। ভুলতে বসা মুখটা আবার মনে পড়ে তার। প্যাকেটটা বের করে নিয়ে বসে। ভেতরে কেবল দুটো বই। একটা ইংরেজীতে আর একটা বাংলায়। বাংলা বইটার মাঝে একটা খামে ভরা চিঠি। সে তখনো বাংলা পড়তে জানত না। ইংরেজী বইটা ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আর ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন নিয়ে। বইটা পড়ে ও কেবলই জেনে আসা কিছু জিনিসকে প্রথমবারের মত হৃদয়ে অনুভব করে। অনুভব করে, বাংলাদেশ নামক একটি দেশ তার জন্মস্থান আর বাংলা সেই দেশের রাষ্ট্রভাষা, মানুষের মাতৃভাষা যার সাথে জড়িয়ে আছে মর্মস্পর্শী আবেগ আর আত্মত্যাগের কাহিনী।

এভাবেই বাংলার প্রতি ওর উৎসাহ জন্ম নেয়। অনলাইনে খুঁজতে খুঁজতে একসময় বাংলা শেখার সুযোগও পেয়ে যায় সে। তারপর এই তিনযুগের দীর্ঘ প্রবাস জীবনে নীরবে নিভৃতে চলেছে ওর বাংলা শেখার সাধনা। এই তিনযুগে একটিবারের জন্যও আর দেখা হয় নি দেশের মাটি। হয়তো বিদেশের আয়েশী জীবনের জন্য, হয়তো দেশে গিয়ে মানাতে না পারবার আশংকায়। মা-বাবা, ভাই-বোনেরা মাঝেমাঝেই এসে ঘুরে যান, স্ত্রীর সূত্রে বিদেশের সমাজে মিশে যাওয়া- হয়তো এসবও কারণ হিসেবে কাজ করেছে বিদেশেই স্থায়ী হয়ে যাওয়ার পিছনে। একসময় জাতীয়তা বদলে গায়ে পড়ে গেছে ভীনদেশী নাগরিকত্বের ছাপও। তবু হৃদয়ের কোথায় যেন আজো একটা পিছুটান কাজ করে শত-সহস্র মাইল দূরের ঐ দেশটার জন্য।

উপস্থাপকের গমগমে কণ্ঠস্বরে বাস্তবে ফেরে সায়ক। অবশেষে আসে কাঙ্ক্ষিত ঘোষণাটি। ১৯৫২ এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের শতবর্ষে এসে বাংলা পায় অন্যরকম আরেক বিজয়। শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে ঘোষিত হয় ড. সায়ক শাহরিয়ারের নাম। কিন্তু পুরো হলরুম যখন করতালিতে মুখর, সায়ক শাহরিয়ারের চোখে তখন জল। তবু আপ্রাণে আবেগ সামলে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। স্লোগান মুখর যুবকের আদলে গড়া ক্রেস্টটা হাতে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় স্টেজে। তার দুই চোখে তখন সেই পুরনো দ্যুতি, যা সে একদিন দেখেছিল তার বায়ান্নের ভাষাসৈনিক, অশীতিপর বৃদ্ধ পিতামহের চোখে।

সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি হয় না ওর। শত-সহস্র মাইল দূরের ঐ লাল সূর্য আর সবুজ প্রান্তরের দেশে তাকে ফিরে যেতেই হবে। নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে স্বদেশ চেনানোর জন্যে হলেও। আনমনেই বলে উঠে ও, “নাহ, এবার দেশে ফিরতে হবে। আমার ভাষা, আমার মা- এবার অভিমান ভেঙ্গে তোমার কোলে ফেরার পালা।”
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×