somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ গ্রীষ্মের দিনলিপি

২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ দুপুর ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক
আমাদের এখানে দারুন গ্রীষ্ম এখন। কাঠফাটা রোদে রোদ-চশমা, সানস্ক্রীনের নীচে উদোম জীবন, বেড়াতে-যাব আর বেড়াতে চলো চেহারা সবার। আমাদের স্বজনেরা যখন বাঙ্গী পাকা গরমে- চাঁদনী চক কিংবা নিউমার্কেটে সিদ্ধ হয়, তখন আমরা বিভূঁইয়ের গরমকাল নিয়ে নেকু-পুশু হই।

পশ্চিমের শীত মানেই বরফ খুঁড়ে গাড়ী আবিষ্কারের অসহ্য স্মৃতি। আমরা পূবের মানুষেরা, পশ্চিমের চাদি-ফাটানো গরমে আহ্লাদের-বেনারসি হয়ে গ্রীষ্ম-পালন করি। আর অনভ্যস্ত হাফপ্যাণ্টে উরু পুরিয়ে, ফেলে আসা পুকুর পাড়ের ল্যাংড়া-আম গাছটার কথা ভাবি।

এসব গ্রীষ্মের বিকেলে কাজ শেষে ঘরে ফিরলে, 'ফ্রিজে খাবার আছে, গরম করে নিয়ো' বলে আরেকজন কাজে ছোটে। একজনের ঘরে ফেরা, আরেকজনের কাজে ছোটার ফাঁকতালে আমাদের বয়স বাড়ে; ক্লোরেস্টরলের মাত্রা সহ্যসীমা ছাড়ায়। জীবনটাকে গোছানোর কথা ভাবলেই- লাইফ ইন্সুরেন্সের লোকদের শোনাতে হয় বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস এবং জানা যায়, নিজের পয়সার টয়লেট বানানোর আগেই আমরা বহুমূত্রে আক্রান্ত হয়েছি।

এমন উথাল-পাথাল গ্রীষ্মে টের পাই- আমরা সাতাশ থেকে সাঁইত্রিশে এসে ঠেকেছি। বয়সের একমুখী সমীকরনে বিরক্ত হয়ে, আয়নার মুখোমুখি দাঁড়ালে- বয়স বেড়ে যাওয়ার দুর্ঘটনায় আমরা বিব্রত হই। তারপর খুব চালাকের মতো নিজেকে ত্রিশে বসিয়ে অন্যের মাথায় পাকা-চুল গুনি। এতসবের পরেও বছর বছর আমাদের বয়স বাড়ে। শুধু গরমের বন্ধে দেশে ফিরে গেলে, মা যখন মাথায় হাত বুলিয়ে দেন- তখনই বুঝি খুব একটা বুড়ো হইনি। পাতে চিতোই-পিঠা, আর কসানো-মুরগীর-ঝোল নিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে- আমরা উচ্চরক্ত চাপের কথা ভুলে যাই। অনুচ্চ-জীবনের সহজলভ্য অসুখ-বিসুখ পরোয়া না-করে- শুধু এ সময়টাতেই আমরা সুস্থ বেঁচে থাকি।

আমরা সাঁইত্রিশে পরলেও, বাবাকে ঘিরে খেতে বসার দৃশ্যটি ভুলে যেতে পারিনা। একদিন ভাবতাম, আমরা ছানা-পোনারা সন্ধ্যা হলেই ঘরে ফিরে আসবো; আর মায়ের নাম-লেখা কাঁসার প্লেটে কাজলী মাছের চর্চরি দিয়ে ভাত মেখে খাব। আঙ্গুল ডোবানো ঘন-ডালে পাঁচ-ফোঁড়ন ভেসে থাকবে। আর, ঢেকুর ওঠার আগেই মা ঠাণ্ডা পানি বাড়িয়ে দেবে। মা কেমন করে যেন সব কিছুই জানতো। আশ্চর্য সব ম্যাজিক জানে মায়েরা! মায়ের পাখার বাতাসে এসব গ্রীষ্মের দুপুর ভাতঘুম দেয় আমাদের উঠানে।

এখানে গ্রীষ্মের দিন দীর্ঘ বলেই, আমরা টাঙ্গাইল শাড়ীর আঁচলে মাকে খুঁজি। আমাদের মায়েরা এমন দুপুরেই আচারের বয়াম রোদে দিয়ে রাখে; গরমে কষ্ট পাব ভেবে আমাদের জন্য হাতপাখা বানায়।


দুই

এখানে এখন সন্ধ্যা নামে দেরীতে; আর সন্ধ্যা নামলেই কেমন নীরব হয়ে যায় চারপাশ। বিকেলে হাওয়া খেতে এখানে কেউ ছাদে ওঠেনা বলে- গোধূলী নামেনা এসব শহরে; রাত হয়। উরু আর ভ্রু'র জ্যামিতিতে, কনে-দেখা আলোর বাগধারা কোথায় মুখ লুকায় কে জানে! এরই মাঝে মনে পড়ে, বাড়ীর কলতলায় এখন ঝমাঝম শব্দ উঠেছে; দু'শ পঁচিশটা চড়াই সকালের বাসি-ভাতের লোভে হুটোপুটি খাচ্ছে ওখানে। পশ্চিমে আমরা যখন ঘুমাই, পৃথিবীর অন্যপাড়ে- আমাদের পূবের মায়েরা জেগে ওঠে।

এখানের গ্রীষ্মে মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হয়; ঝুম বৃষ্টি। বাংলাদেশের ব্যাঙ ডাকা বর্ষার মতো এই-সেই বৃষ্টি। ছাতা হারানো মানুষগুলো বৃষ্টিভেজা হয়ে ঘরে ফেরে। আবার কেউ কেউ ভিজবে বলে বৃষ্টি মাথায় পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকে। কাদা-জলে মাখামাখি নেই বলেই- এ বৃষ্টির বরিষণ খেতাব নেই। তবু, হিসেবের বর্ষায় কলিম শরাফী মনে করিয়ে দেন, 'এমনও দিনে তারে বলা যায়।' এমন দিনে- যারে বলা যেত, সে কাজে গেছে। কাউকে কিছু বলার নেই।

আমাদের ঘরে রবীন্দ্রনাথ অকারনেই বেজে চলেন।

আমরা যারা আদার ব্যাপারী, আর যারা কোন এককালে জাহাজের খবর রাখতাম- তারা একটু একটু করে অচেনা রোদ-জলে নিজেকে বুঝতে শুরু করি। চিনতে শুরু করি, পশ্চিমের সিঁদুরে মেঘে ঘরপোড়া গরুদের। আমাদের মেনীমুখো জীবন, হুলোর গান শোনায় দেশভাবনায়।

এমন গ্রীষ্মের শুরুতেই খবর আসে, কোন এক গানওয়ালা এ শহরে আসবেন। চেনা সুরে অচেনা শহর মাতানোর বিজ্ঞাপনে ছয়লাব হয় বাঙ্গালী পাড়া। ভুল বানানের পোষ্টারে বাংলা শব্দ বড় অচেনা-আপন মনে হয়।

বৈশাখী মেলা, কিংবা কোন এক পুনর্মিলনীর দিনে- পাঞ্জাবী, আর সূতী-শাড়ীতে ইস্ত্রী ডলে- আমরা শেকড়ের খোঁজ করি মেডিসন স্কোয়ারে, ড্যানফোর্থ রোডে অথবা ব্রিক লেনে। আরেক বাংলাদেশ শিরনামে- পূবের পত্রিকায় খবর ছাপা হয়। আমরা স্বদেশ হারিয়ে, ছায়া-দেশ রোপন করি আরেক ভূবনে। গুল্মের অস্থায়ী-মূলকে মহীরূহের শেকড় ভাবতে ভাবতে আমাদের আরেক দফা বয়স বাড়ে। মাকে ছবি পাঠাই, বোঝাতে চাই- দেখ, কত আনন্দে আছি!


তিন

আমরা যারা আকবর বাদশা, আর হরিপদ কেরানী হয়ে এখানকার উত্তর-দক্ষিন আর পূর্ব-পশ্চিম বরাবর সোজা রাস্তায় ঘর-বাহির করি, তারা সময়-নেই-এর অনন্ত সময়ে ডুব সাঁতার দেই বৃষ্টিজলে। অপরিসর গৃহে আমাদের শিশুরা- আমাদের আরেক সংস্করণ হয়ে বেড়ে ওঠে। ওদের চৌকষ ইংরেজীতে বিমুগ্ধ হতে না-হতেই টের পাই- বেঙ্গলী টু ইংলিশ অভিধানের ক্ষমতা নেই আমাদের সন্তানকে পাঠ করার।

আমাদের সন্তানেরা দাদুভাইকে ফোন করে এখানের গ্রীষ্মের সংবাদ দেয়। টের পাই, সংবাদ-সমাচার বিশেষ জমছে না। আমাদের পাঁচ বছরের কন্যাটি ফোন রেখে দিতে দিতে যখন বলে, 'শি ডাজ'ন্ট স্পিক ইংলিশ', তখন ভারী উদোম মনে হয় আমাদের গ্রীষ্মযাপন। আমরা লজ্জা ঢাকার জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়াই; বরফের দিন খুঁজি ছলকে ওঠা গ্রীষ্মে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ দুপুর ১:০৯
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×