somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাতৃত্ব ও একটি কাকতালীয় ঘটনা...

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাতৃত্ব ও একটি কাকতালীয় ঘটনা...
রোকেয়া ইসলাম।

আজ প্রায় ৭ দিন । কাজের বুয়া নাই। কোন কিছু না বলে হুট করে কাজে না আসায় অনেক বড় সমস্যার মধ্যে পড়েছে নীলা। একদিকে ছোট বাচ্চা অন্য দিকে অসুস্থ শাশুড়ি । সব কাজ এক হাতে করায় খুব কষ্টের মধ্যে সময় কাটছে নীলার। বাজার করা, রান্না করা, ছেলে বাঁধনকে স্কুলে আনা নেয়া সব কাজ একাই করতে হয়। রাজিব ও এই সময় অফিসের একটা ট্রেনিং এ অংশ নিতে দেশের বাইরে। ও থাকলেও কিছুটা সাহায্য পাওয়া যেত। সারাদিন খাটাখাটোনির পর সব কাজ সেরে সবে মাত্র বিছানায় এসে শুয়েছে এমন সময় কলিং বেল। একটু বিরক্ত হয়েই দরজাটা খুলতে গেল নীলা। দেখে এক বৃদ্ধ মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। কোলে ২ বছরের একটা ছেলে।
- কি চাই?
- আম্মা আমারে একটা কাজ দিবেন?
- না না । আমার কাজের মানুষ লাগবেনা। তুমি যাও। বলেই দরজাটা বন্ধ করে দিতেই আবার বেলটা বেজে উঠলো। এবার আর থামছেই না। নীলা আবার দরজা খুলল।
- আম্মা আমি সব কাজ করবো। আমারে বেশি বেতন দিউন লাগবোনা। খালি একটু খাইতে দিয়েন।
- তোমাকে আমি চিনি না জানি না কেমন করে কাজ দেই বল তো?
- আম্মা আমারে বিশ্বাস করেন । আমি চোর না আম্মা। একটু থেমে আবারও বলতে লাগলো “অনেক বাসায় গেছি আম্মা। আমার এই বাচ্চাডার জন্য কেও আমারে কাজ দেয় না সবাই কয় কাজ দিতে পারি যদি বাচ্চা রাইখা আসতে পার”। কন তো আম্মা আমি হেরে কই থুইয়া আমু। এইহানে আমার কেও নাই।
কথাগুলি শুনে মিতার খুব মায়া লাগলো। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। অথচ একটা কাজের লোক তার খুব দরকার। আবার ভয়ও পাচ্ছে অজানা, অচেনা মানুস, কেমন করে বিশ্বাস করবে। চারিদিকে কত অঘটনই তো প্রতিনিয়ত ঘটছে।
বৃদ্ধ মহিলাটি আবার বললো “ কাল থেকে কিছুই খাই নাই । পোলাডারেও কিছু খাওয়াইতে পারি নাই। আম্মা আমারে কাজ টা দেন। আফনে দেহেন আম্মা হেয় কোন বিরক্ত করবো না।
নীলা তাকিয়ে আছে বাচ্চা টার দিকে। মায়াময় একটা চেহারা। চোখ দুটি পানিতে টলটল করছে। যেন চোখের ভাষায় কিছু বলতে চাইছে। নিজের ৩ বছরের ছেলে বাবুনের কথা মনে পড়লো।
-নীলা গেট টা খুলে দিয়ে বললো “ভিতরে আস”। দুপুরে খাবার পর ভাত তরকারি যা ছিল তাই দুজনকে খেতে দিল।
বুয়া কিছু না বলে বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে খেতে বসে গেল। পরম তৃপ্তিতে খাওয়া শেষ করল দুজন। বাচ্চাটা লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু নীলাকে দেখছে।
নীলা ভাবছে এত বৃদ্ধ মহিলার এত ছোট বাচ্চা কেন? কথাটা জিজ্ঞেস করতেই বুয়া বললো
- কি কমু আম্মা এইডা আমার ভাগ্যে লেখা ছিল।
- বাড়িতে আর কে কে আছে তোমার?
- বাড়িতে আমার একটা পোলা আছে হেয় পাগল। সারাদিন কই কই থাহে মুন চাইলে বাড়িত আয়ে মুন চাইলে আয়ে না। মাঝে মাঝে ভিক্ষা কইরা কিছু আনে। বাড়িত একটা ঘর আছে। খাইয়া না খাইয়া এতদিন মাডি কামড়াইয়া পইড়া আছিলাম। আমাগো পাশের বাড়ির মর্জিনা এইহানে কাম করে। হেয় কইল এইহানে আইলে অনেক কাজ পাওয়া যায়। পোলাডারে পেট ভইরা খাউন দিতে পারমু।
কথা বলতে বলতে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়লো। বুয়া ওকে ডাইনিং এর এক কোনায় কাঁথা বিছিয়ে শুইয়ে দিল।
- ওর নাম কি?
- সুমন।
- ভালই তো। অনেক সুন্দর নাম। কোথায় থাক তুমি?
- মর্জিনার লগে ওই সিঁড়িতে।
নীলা কিছু বলার আগেই বুয়া থালা বাসন নিয়ে ধুতে শুরু করলো। রুম ঝাড়ু দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে ফেললো।
- আম্মা আর কি করমু?
- আর কিছু করতে হবেনা। এখন যাও কাল সকালে চলে এসো।
বুয়া খুব যত্ন করে সুমন কে কোলে তুলে নিয়ে বের হয়ে গেল। পরদিন সকাল ঠিক ৬ টায় বুয়া কাজে এলো। সুমন এখনও বুয়ার কাধে গভীর ঘুমে অচেতন। ঠিক আগের মতই তাকে ডাইনিং এ শুয়ে রেখে কাজ শুরু করলো। একটু পরই সুমন ঘুম থেকে উঠে মা মা বলে কান্না শুরু করলো। বুয়া দৌড়ে এসে গালে, মাথায় আদর বুলিয়ে কোলে তুলে নিল এবং কোলে নিয়েই কাজ করতে লাগলো।
এভাবেই চলতে থাকলো দিন। নীলা বুয়াকে পেয়ে মহা খুশি। সব কাজই সে সুন্দর মত করতে পারে। সুমনও খুব শান্ত। চোখ দুটো তে কেন যেন সব সময় পানিতে ছলছল করে। প্রচণ্ড মায়া পরে গেছে নীলার সুমনের প্রতি। বাবুন ও অনেক খুশি । খুব সহজে আপন করে নিল সুমন কে। সারাক্ষন দুজন একসাথে থাকে একসাথে খেলা একসাথে খাওয়া দুজন বন্ধু হয়ে গেল। বাবুন যে খেলনা গুলো কাউকে ধরতে দিত না ছুঁতে দিত না তা খুব সহজেই সে সুমন কে দিয়ে দিল। এতে করে বুয়ার ও কাজ করতে সুবিধা হল। এভাবে কদিন কাজ করার পর নীলা তাদের কে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিল।
প্রায় পনের বিশ দিন কাজ করার পর হঠাৎ এক রাতে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল নীলার। করুন সুরে কাদছে বুয়া। নীলা বিছানা ছেড়ে উঠে এলো।
-কি হয়েছে? কাঁদছ কেন?
-আম্মা গো আমি খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেকছি। আমার পোলাডার খুব বিপদ। কারা যেন আমার পোলাডারে অনেক মারছে। ওর মাথা ফাইটা অনেক রক্ত পরতাছে আম্মা।
-আরে এটা একটা স্বপ্ন। তুমি ভেব না সব ঠিক যাবে।
- খুইলা দেন।
-তুমি কি পাগল হয়েছ নাকি? এখন রাত দুইটা বাজে। সকাল হোক দেখা যাবে।
-আম্মা গো হেরে দেহার আমি ছাড়া কেও নাই। অনেক শখ কইরা বিয়া দিছিলাম। অনেক দিন ভালাই আছিল। হেরে আর আমারে দেক ভাল করতো। পরে যে তার কি অইলো আম্মা আমার পোলাডারে দেকতে পারত না। খালি মারত। হের পর একদিন এই দুধের পোলাডারে দুই মাসের বয়সের সোময় আমার কাছে ফালায়া থুইয়া পাশের বাড়ির রমিজের লগে ভাইজ্ঞা গিয়া বিয়া বইছে। একদিনও এই পোলাডারে দেকতে আহে নাই।
-মানে এই তোমার নাতি? তুমি না বলেছ সে তোমার ছেলে। সে তো তোমাকে মা বলে ডাকে।
-হ আম্মা। হেয়ত মা কারে কয় চিনে না। জন্মের পর মায় ফালায়া গেছে তারপর থেক্কা আমারেই চিনে, আমারেই জানে, তাই আমারেই মা কইয়া ডাহে। মাইনসে হেরে কয়, হেয় তর মা না হেয় তর দাদি। তহন পোলাডা অনেক কান্দে কয় না হেয় আমার মা। হগল রে এই সব কতা কইতে ভাল্লাগে না আম্মা তাই কই আমি ওর মা।
বুয়া অনবরত বলে যাচ্ছে আর অঝরে কাঁদছে। ওর কান্না শুনে সুমন ও ঘুম থেকে উঠে মা মা বলে বুয়ার গলা জড়িয়ে ধরল। এরই সাথে বাবুন ও উঠে তাদের সাথে যোগ দিল। সুমনের সাথে ওদের বিছানায় গিয়ে বসলো। এভাবেই কেটে গেল বাকি রাত। ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে মসজিদে। এমন সময় কলিং বেলের শব্দ। নীলার বুকের ভিতরটা ধুক করে উঠলো। উঠে গিয়ে গেটটা খুলতেই দেখে পাশের বাড়ীর মর্জিনা। নীলাকে দখেই বলল “খালাম্মা আপনে গো বুয়ারে ডাকেন হের পোলার অনেক বিপদ। নীলা বুয়াকে ডাকার আগেই ও এসে সামনে দাঁড়ালো। মর্জিনা তাকে দেখেই বলে উঠলো—
-আপনে তাড়াতাড়ি বাড়িত রওনা দেন। আপনের পোলারে কারা যেন অনেক মারছে। হের অবস্থা খুব খারাপ।

-ও আমার কইলজারে, আমার মানিক রে কেডা তরে এমন কইরা মারলরে। আমি এইডাই দেকছি আমার পোলার মাথা ফাইটা রক্ত পরতাছে। আল্লায় আমারে দেহায়া দিছে। আমার পোলায় মা মা কইয়া অনেক কানতাছে। আমি আইতাছি বাপ। বলেই জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বুয়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।
নীলা তাকে আটকালো না। তাড়াতাড়ি কিছু টাকা বুয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো যাও। তুমি কেঁদোনা দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। বুয়া চলে গেল। নীলা দরজা বন্ধ করে ফিরে এল রুমে। নামায পড়লো আল্লার কাছে দোয়া করলো তিনি যেন বুয়ার ছেলেটাকে সুস্থ করে দেন। সারাজীবন নীলা কেবল শুনেই এসেছে স্বপ্নের সাথে বাস্তবের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে তার সেই ধারনা ভুল হয়ে গেল। ও ভাবছে এটা কি করে সম্ভব? সন্তানের বিপদ মা কি এমন করেই টের পান? সন্তানের রক্তাক্ত দৃশ্য স্বপ্নের মাধ্যমে চোখের সামনে দেখা এটা শুধুই কি কাকতালীয়? এক দিকে নারীছেড়া ধন এক মাত্র সন্তান অন্য দিকে অবুঝ নাতির মা হওয়া কোন দিকটা সামলাবে এই বৃদ্ধ মা। সেকি পারবে তার দুই সন্তানকে বাঁচাতে? নীলা অধীর হয়ে অপেক্ষা করে আছে বুয়ার ছেলেটি ভালো আছে এই খবরটি শোনার জন্য।


১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×