সে অনেক আগের কথা। ১৯২০-২১ সাল। তখন থেকে কাজী নজরুল ইসলাম নানা উপায়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপাতে থাকেন। বাস্তবই সে সময় মুষ্টিমেয় লেখকের মাঝে নিজেকে ধরা কতটা কষ্টকর ছিল তা অনুমান করা যায়। তাঁর লেখা ক্রমেই সাহিত্য অঙ্গনে মোটামুটি ঝড় তোলে। তাঁর লেখা নিয়ে নামকরা পত্রিকাগুলো আলোচনা করতে থাকে। এবং তাঁকে ক্রমেই মানুষ চিন্তে থাকে।
এবার আসি আমাদের দেশে বর্তমান অবস্থায়। প্রতিদিন প্রথমআলোর সাহিত্য পত্রিকা খুলি। যদি একটা লেখা নজরুলের মত পাই! এরকম আকালের দেশে আমাদের মহান কবিরা যেসব অকবিতা লেখেন তা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। আমাদের নজরুল বলে একজন কবি ছিলেন আমরা ভুলেই গেছি। গদ্য কবিতা নামক অখাদ্যে সাহিত্য পত্রিকা সয়লাব। তার অর্থ খুজে বের করা অত্যন্ত দূরহ হয়ে পড়ে।
আমাদের আজকে প্ল্যাটফর্মের অভাব নাই। তবু একটা নজরুলের জন্ম এ দেশ আর দিতে পারছে না। মাঝে মাঝে অবাক হই।
নজরুল একজন কালজয়ী কবি। হাজার বছর পরেও তাঁর কবিতা পুরান হবার নয়।
আজকে তাঁর যে কবিতা আমার হৃদয়ে একটু পর পর ধ্বনিত হচ্ছে, আমি বার বার পড়ছি তা আপনাদেরকেও পড়তে দিলাম।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে -
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে -
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার - ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে -
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,
আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;
আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের 'বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না' বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুর্বাঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।
মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!