somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ভ্রমন ২০০৮ (৪র্থ পর্ব)

২২ শে আগস্ট, ২০০৮ ভোর ৬:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১ম পর্ব - Click This Link
২য় পর্ব - Click This Link
৩য় পর্ব - Click This Link
৫ম পর্ব - Click This Link

আমার অবস্থা ক্লান্ত এবং বিদ্ধস্ত কিন্তু একই সাথে পুলকিত এবং রোমাঞ্চিত। ভোর থেকে শুরু হয়েছে আজকের দিনের কার্যকক্রম। কখনও ট্যুরিস্ট আবার কখনও ট্যুরিস্ট গাইড, কখনও পাহাড়ের মাঝে হেটে চলা ভবঘুরে আবার কখনওবা মুগ্ধ ফটোগ্রাফার। একদিনে অনেকগুলো পরিচয়ে পরিচিত হয়ে গিয়েছি! এখন সমস্যা হচ্ছে কোথা থেকে শুরু করবো সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু শহরের বর্ননা দিতে গেলেই অনেক বড় একটা পোস্ট হয়ে যাবে। আর শহরের বাহিরে কেমন কাটলো সেটা আদৌ বর্ননা করতে পারবো কি না চিন্তা করছি; এতটা বাকরুদ্ধ।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে মিগির মূল ভবনের ক্যাফেতে চলে গেলাম ব্রেকফাস্টের জন্য। গিয়ে দেখি তখনও ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা শুরু হয়নি। আসলে উত্তেজনায় আমার সারা রাত ঘুম হয়নি। তাই বোধয় একটু বেশি আগে আগেই উঠে পড়েছিলাম। খানিকটা সময় ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করে, ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা শুরু হবার আগেই ওদের বিরক্ত করে করে ব্রেকফাস্ট প্রায় চুলা থেকে সরাসরি প্লেটে নামিয়ে এনে এবং অতঃপর সেটা সাবাড় করে আমি যখন মূল কার পার্কিং-এ গিয়ে দাড়ালাম তখনও কেউ আসেনি। একটু বিরক্ত লাগছিল। করার কিছু ছিল না তাই এলোমেলো ছবি নিচ্ছিলাম কার পার্কিং-এর। এমন সময় এক তরুনী মেয়ে (আল্লাহ জানেন লাইসেন্স আছে কি না!) প্রায় গায়ের উপর গাড়ী পার্ক করে ফেলছিল। দুকথা শোনাতে যাচ্ছিলাম যখন, তখন দেখলাম আমাদের দলের একজন কার পার্কিং-এ ঢুকলো। উল্লেখ্য যে আগেই সিদ্দিকী স্যার ভ্রমনে আগ্রহীদের নাম সংগ্রহ করে পচিশ পাউন্ড করে সবার থেকে তুলে একটা দল তৈরী করে দিয়েছিলেন। আজ সবাইকে এক হতে বলেছিলেন কারপার্কিং-এ যেখান থেকে আমাদের বাস ছাড়বে।

যাইহোক, ছেলেটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো সবাই কোথায়। আমি হাসলাম। জানালাম সবাই বলতে আপাতত আমরা দুজনই আছি। বেচারা দুঃখ করে বললো সে নাকি সকালে ঠান্ডা পানি দিয়ে শাওয়ার নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছে, ভেবেছিল দেরী হয়ে যাবে। ঠান্ডা পানির কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। বললাম একই ঘটনার ভুক্তভোগী আমিও! আসলে আমাদের বিল্ডিং-এ কি যেন হয়েছিল ফলে সকালে গিজার অন করা ছিলনা। এমনিতেই ভোরে বৃষ্টি হয়েছে। সে অবস্থায় ঠান্ডা পানি দিয়ে শাওয়ার নেয়ায় মনে হচ্ছিল বরফের মুর্তি হয়ে হয়তো বাকি জীবন বাথরুমে দাড়িয়ে থাকতে হবে।

এরপর একেএকে সবাই এসে জড়ো হতে লাগলো। সিদ্দিকী স্যার আমাদের লাইনে দাড় করিয়ে মাথাগুনে বাস ড্রাইভারের হাতে সপে দিলেন। সবাইকে ঘুরিয়ে সন্ধায় আবার এখানে নামিয়ে দিয়ে যাবে, এই হলো মূল পরিকল্পনা। আমাদের দলের প্রসঙ্গে একটু বলে নেয়া দরকার। দলে ছিলাম আমরা আটজন। সাতজন ছাত্র এবং একজন প্রফেসার। আমি বাদে অন্য ছাত্ররা ছিল ইসরাইল, টার্কি, জাপান, চীন এবং অন্য একটা দেশ থেকে (যথা সময়ে পরিচয় খোলাসা করা হবে!)। প্রফেসার ছিলেন পর্তুগিজ। যাত্রার শুরুতেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো টুরিস্ট বোর্ডের সিটি অফিসে। ওখান থেকে অন্য একটা বাসে শুরু হবে আমাদের সিটি ট্যুর। ঘন্টাখানেকের সিটি ট্যুর শেষে আমরা বের হয়ে পড়বো অপরুপা নর্দার্নের রুপ সূরভী পান করতে - এই ছিল প্রাক পরিকল্পনা।

টুরিস্ট বোর্ডের অফিসে ঢুকে দেখি বিভিন্ন ধরনের বই আর ম্যাগাজিনে ঠাসা পুরো এলাকাটা। দুই সারিতে অনেকগুলো বুকসেলফ রাখা। একটা সারির উপরে লেখা "টুরিস্ট ইনফরমেশন ফর নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড" আরেকটায় "টুরিস্ট ইনফরমেশন ফর রিপাবলিক অব অয়ারল্যান্ড"। ঠিক বুঝলাম না নর্দার্নে রিপাবলিককে কেন প্রোমোট করা হচ্ছে। হয়তো ওদের মধ্যে এমনই চুক্তি আছে, একে অপরকে প্রোমোট করবে। যাইহোক, আমরা যখন দুই আয়ারল্যান্ড নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম তখন ধীরে ধীরে তাদের স্বাধীনতা, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের অপট-আউট, দ্যা ট্রাবল ইত্যাদি আলোচনায় আসতে লাগলো। ফলে আমি টুরিস্ট থেকে টুরিস্ট গাইডে পরিনত হলাম। দ্যা ট্রাবলের ফলে এখানে কি অবস্থা হয়েছিল, বেলফাস্ট এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে সেটাকে কি করে দমানো হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আবার দাঙ্গা দেখা দেয়ার সম্ভাব্যতা - সবকিছু নিয়ে আমি লেকচার দেয়া শুরু করলাম। হঠাৎ দেখি দলের সবাই আমার চারপাশে গোল হয়ে তন্ময় হয়ে গল্প শুনছে। আমিও মজা পেয়ে গেলাম। জানালাম সারাদিনে আজ অনেক গল্প শুনিয়ে দেব। অন্তত আর কোন দিন কোথাও গিয়ে আয়ারল্যান্ড নিয়ে কথা বললে আটকাবে না!

গল্পে যখন সবাই তন্ময়, তখন আমাদের ডাক আসলো; সিটি ট্যুরের বাস এসেছে। বাসে উঠে দেখি দুই তরুনী টুরিস্ট গাইড তাদের সাজানো হাসি দিয়ে সবাইকে স্বাগতম জানাচ্ছে। সোজা বাসের আপার সেলুনে উঠে খোলা সিটের অংশে গিয়ে বসলাম। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলাম অক্লান্ত ফটোসেশনের জন্য।

মূল বর্ননায় যাবার আগে ডেরী শহরের কথা একটু বলে নেয়া প্রয়োজন। এই শহরটা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন শহর। যদিও নাম ডেরী, তবে ব্রিটিশরা ডাকে লন্ডনরেডী। নামের মধ্যেও ব্রিটিশ-আইরিশ দ্বন্দ্ব। ফলে শহরের অনেক জায়গায় "ডেরী/লন্ডনডেরী" - এভাবে শহরের নামকে লেখা হয়। এমন কি গুগল ম্যাপে সার্চ দিলেও একই বিষয় দেখা যাবে। সিটি কাউন্সিলের নাম ছিল আগে "লন্ডনডেরী সিটি কাউন্সিল" যেটা আইরিশদের চাপের মুখে পড়ে কয়েকবছর আগে "ডেরী সিটি কাউন্সিল" করা হয়েছে। এই ডেরী শহরের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এটা ইউনিয়নিস্টদের দেশের শহর হওয়া স্বত্ত্বেও প্রধানত ন্যাশনালিস্টদের বসবাস এখানে। ফলে আইরিশ স্বাধীনতার সংগ্রাম, দ্যা ট্রাবল - সব কিছুতে এখানে দাঙ্গা হয়েছে সর্বাধিক। এ বিষয়ে একটু পরেই বিস্তারিত জানানো হবে।

আমাদের যাত্রা শুরুর সাথে সাথে নীচ থেকে মাইকে তরুনী কন্ঠ ভেসে এলো। বর্ননা করে চলেছে মেয়েটা সিটি ওয়াল এবং তার ইতিহাস। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। যদিও আমি আগেই সিটি ওয়ালের কথা জানতাম, তবুও শুনতে লাগলাম, যদি নুতন কোন তথ্য পাই সেই আসায়। পাঠকবৃন্দ হয়তো এতক্ষনে আমার উপর বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। আমি ইউনিয়নিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, অপট-আউট, দ্যা ট্রাবল ইত্যাদি অনেক জার্গন ইতিমধ্যে ব্যবহার করে ফেলেছি যেগুলোর কোন ব্যাখ্যাই দেইনি। এখন আবার শুরু করেছি সিটি ওয়াল! আসলে সবগুলোর ব্যখ্যাই আমি দেব। তবে সেটা যথাসময়ে। তাছাড়া হয়তো মনে আছে, একজনের পরিচয় আমি গোপন করে রেখেছি। সেটারও একটা তাৎপর্য আছে!

আর ভণিতা না করে সরাসরি সিটি ওয়ালের কথায় চলে আসি। ডেরী হলো ইউরোপের একমাত্র শহর যেটার চারপাশে পূর্নাঙ্গ দেয়াল রয়েছে। ইউরোপে এরকম দেয়ালে ঘেরা শহর আরো দেখা যায় বটে, তবে সেটা এরকম পূর্নাঙ্গ নয়। ডেরীরর দেয়ালে কোথায় ছেদ নেই, এটাই এর প্রধান বৈশিষ্ট। সতের শতকের গোড়ার দিকে এই দেয়াল তৈরী করেছিল ট্রেড গিল্ড অব দ্যা সিটি অব লন্ডন। ১৬১৩ সনে দেয়ালের কাজ শুরু হয় যা ১৬১৮ সনে শেষ হয়। সেবছরই লন্ডন শব্দটা যোগ করা হয় ডেরীর শুরুতে এবং লন্ডনডেরী নামের সূচনা হয়।

শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে ঘুরতে আমরা এমন একটা এলাকায় চলে আসলাম যেখানে ঢোকার পর থেকেই অদ্ভুত একটা অনুভুতি কাজ করতে শুরু করেছিল। সেখানে লেখা ছিল - ইউ আর এন্টারিং ফ্রি ডেরী! চার দিক রিপাবলিকের পতাকায় ছেয়ে ছিল। একটাও ইউনিয়ন জ্যাক (যুক্তরাজ্যের পতাকা) অথবা অলস্টার ব্যানার (নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের পতাকা) নজরে আসেনি। বড়বড় পেইন্টিং দিয়ে এলাকাটা সাজানো ছিল। পেইন্টিং-এর বিষয় বস্তু ছিল আইরিশ স্বাধীনতার যুদ্ধ থেকে শুরু করে দ্যা ট্রাবল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ। গাইড নীচ থেকে মাইকে জানালো গত প্রায় ত্রিশ বছর এই শহর ইউরোপের সবচেয়ে বিপদজনক শহর হিসেবে চিহ্নিত ছিল। দিনে-দুপুরে হত্যা আর বোমাবাজী এখানে ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। শতশত সিভিলিয়ান মারা গিয়েছে এই শহরে, কেউ দোষী ছিল - কেউ বা নির্দোষ।

প্রিয় পাঠক, এবার ফিরে যাচ্ছি ইতিহাসের দিকে। কিছু ব্যাখ্যা দেয়া নিতান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, না হলে পরবর্তি বর্ননার অনেক কিছুই হয়তো বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।

অনেকেই হয়তো জানেন যে যুক্তরাজ্য চারটা রাজ্যের (বর্তমানে সাংবিধানিক রাষ্ট্র) সমন্বয়ে গড়া একটা ইউনিয়ন। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েলস মিলে গড়ে তুলেছিল এক কালের প্রবল প্রতাপশালী ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন এন্ড আয়ারল্যান্ড রাজ্যকে। এ ইউনিয়নের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ আইলস তথা গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ড দ্বীপকে এক করে একটা শক্তিশালী রাজ্য গঠন করা। ব্রিটিশরা তাদের লক্ষ্যে সফলও ছিল কারন আমেরিকা, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া এবং আফ্রিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা এ রাজ্যের পতাকা তলে এসেছিল। ব্রিটিশ রাজ্য যখন বড় হচ্ছিল, তখন তাদের ইউনিয়ানের মধ্যেই দানা বাধতে শুরু করে ক্ষোভ আর বিদ্রোহ। ইউনিয়নের অন্যতম শক্তি আয়ারল্যন্ডে তখন দুটো দলের সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে একটা দল ইউনিয়নিস্ট এবং অন্য দলটি ন্যাশনালিস্ট নামে পরিচিত। ইউনিয়নিস্টরা ছিল ব্রিটিশ রাজের প্রতি অনুগত এবং তারা মনেপ্রানে চাইতো আয়ারল্যান্ড যাতে ইউনিয়নে অবস্থান করে। তাদের মতে ইউনিয়নে থাকাই আয়রল্যান্ডের জন্য মঙ্গলজনক। অন্যদিকে ন্যাশনালিস্টরা ছিল ব্রিটিশ রাজের প্রতি দুর্বিনীত এবং স্বাধীনতাকামী। তারা চাইতো আয়ারল্যান্ডকে মুক্ত করে একটা স্বাধীন এবং সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে।

ন্যাশনালিস্টদের পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপ এবং স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ স্বরুপ গঠন করা হয়েছিল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি যারা আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছিল। এরই জবাবস্বরুপ ইউনিয়নিস্টদের পক্ষ থেকে রিপাবলিকানদের স্বাধীনতার পরিকল্পনাকে শেষ করার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল অলস্টার ভলেন্টিয়ার। শেষ পর্যন্ত আয়ারল্যান্ড আংশিক ভাবে স্বাধীন হয় এবং নর্দার্ন আয়রল্যান্ড নামে অলস্টারের ছয়টা কাউন্টি আইরিশ ফ্রি স্টেট থেকে অপট-আউট করে আবার ইউনিয়নে প্রবেশ করে।

ষাটের দশকের শুরুর দিকে ন্যাশলালিস্টদের পক্ষ থেকে আবার জোর প্রচেষ্টা শুরু হয় নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীন করে অল-আয়ারল্যান্ড গঠন করার। এরই ফল স্বরুপ প্রভেশনাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি গঠন করা হয় যারা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ আর্মির বিপক্ষে যুদ্ধ করতে শুরু করে। অন্য দিকে তখন আবার ব্রিটিশ রাজের প্রতি অনুগতরা অলস্টার ভলেন্টিয়ার ফোর্স গঠন করে যারা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাখার জন্য এবং প্রভেশনাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সদস্যদের হত্যা বা ধরিয়ে দেয়ার জন্য কাজ করতে শুরু করে। সোজা কথায় এদের কর্মকান্ড এবং প্রকৃতিতে বাংলাদেশের রাজাকার-আলবদরদের সাথে কোন পার্থক্য ছিল না। ফলে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে ১৯৬৮ থেকে ১৯৯৮ সন পর্যন্ত ত্রিশ বছর গৃহযুদ্ধ লেগে থাকে। এই গৃহযুদ্ধ ইতিহাসে দ্যা ট্রাবল নামে পরিচিত। বর্তমানে একটা চুক্তির মাধ্যমে (বেলফাস্ট এগ্রিমেন্ট) দুই পক্ষকে শান্ত রাখা হয়েছে তবে এ শান্তি কতদিন বিরাজ করে সেটাই দেখার বিষয়।

এবার আমাদের আজকের ট্যুরে ফিরে আসা যাক। দ্যা ট্রাবল চলাকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফ্রি-ডেরীতে সুবিশাল পেইন্টিংস-এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা বাসে করে ঘুরছিলাম আর একেকটা পেইন্টিং দেখছিলাম। সা. ইনের পাঠকের কথা ভেবে আমি বেশ কিছু পেইন্টিংস এর ছবি তুলে এনেছি যা নীচে বর্ননা করা হলো:

ফ্রি-ডেরীতে ঢোকার মূহুর্ত:




ট্রাবল চলাকালীন সময় কারাগারে বন্দি স্বাধীনতাকামী (ব্রিটিশদের ভাষায় সন্ত্রাসী) প্রবেশনাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সদস্যরা একটা হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছিল। যদিও কম্বলের কথা বলে এই স্ট্রাইক শুরু হয়েছিল তবে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের কাছে তাদের স্বাধীনতার দাবী পৌছে দেয়া। এর নেত্রীত্বে ছিলেন ববি সেন্ডস যিনি স্ট্রাইক করার সময় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় পার্লামেন্টের এম.পি. নির্বাচিত হন। ৬৬ দিন একটানা না খেয়ে থেকে ১৯৮১ সনের ৫ মে তিনি মৃত্ত্ববরণ করেন। পরবর্তিতে তার সাথে হাঙ্গার স্ট্রাইকে অংশ নেয়া আরো নয়জন সঙ্গী মারা যায়। তাদের স্মৃতিতে নিচের পেইন্টিংটা আঁকা।



মাত্র চোদ্দ বছরের এই মেয়েটি দ্যা ট্রাবলের একশতম শিকারে পরিনত হয়েছিল:



দ্যা ট্রাবল চলাকালীন আরো কিছু বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ছবি:



ফ্রি-ডেরী থেকে বের হওয়ার একটু পরই ইউনিয়ান জ্যাক দেখা যেতে লাগলো। বুঝতে পারলাম আবার ইউনিয়নিস্টদের জগতে চলে এসেছি। এসময় বিভিন্ন নাম করা ব্রিটিশ ব্রিগেডের পরিত্যাক্ত ব্যারাক, জেনারেলদের বাড়িঘর দেখা যাচ্ছিল। হঠৎ একটা জায়গায় এসে আমাদের বাস থামলো। তাকিয়ে দেখি ফ্রি-ডেরীর মত করে এখানে অলস্টার ভলেন্টিয়ার ফোর্সের সমর্থকরা পেইন্টিং একেছে। পেইন্টিংটা দেখার সাথে সাথে মনে হলো এর থেকে হীন দৃশ্য আর হতে পারে না। স্বদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে গিয়ে ব্রিটিশরাজকে কুর্নিশ করার যে ভঙ্গিতে ছবিটা আঁকা হয়েছে তা আসলে মানবতারই অপমান। এই সেই ছবি:



আমরা যখন ঐতিহাসিক এলাকাগুলো ঘুরে আবার শহরে প্রবেশ করি তখন রোদ উঠে গিয়েছে। বেশ গরমও লাগছিল। ফয়েল নদীর পাশ ঘেসে আমাদের বাস এগিয়ে যাচ্ছিল সাই সাই করে। ফয়েলকে বলা হয় ইউরোপের দ্বিতীয় দ্রুততম স্রোতের নদী। এই ফয়েলের পাড়েই ডেরী নগরী গড়ে উঠেছে।

যাইহোক, অল্প কিছু সময়ের মধ্যে আমরা টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টারে এসে পৌছালাম এবং সিটি ট্যুর বাস থেকে নেমে আমাদের জন্য বরাদ্দ মিনি বাসে এসে আবার চেপে বসলাম। বাস ছাড়ার আগে আমি সবাইকে এতক্ষন দেখে আসা বিভিন্ন ঘটনা আবার খুলে বললাম। প্রতিটা ঘটনায় কে কেন এবং কিভাবে দায়ী সেটা ব্যখ্যা করলাম। বলাইবাহুল্য, আমার প্রত্যেকটা মন্তব্যে আমি প্রধানত ব্রিটিশরাজকে দায়ী করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম আমাদের সাথের একটা ছেলে (যার পরিচয় আমি তখনও জানতাম না) আমার কথা শুনে একটু একটু করে রেগে যাচ্ছে। বিষয়টা তখনও বুঝতে পারিনি। সন্দেহ হলো, একি তবে ব্রিটিশ? জিজ্ঞেস করতেই বের হলো শুধু ব্রিটিশই না, ইংলিশ ব্রিটিশ! সথে সাথে সবাই এমন ভাবে ওর দিকে তাকাতে শুরু করলো যেন এ হচ্ছে সবচেয়ে বড় কালপ্রিট আমাদের মাঝে!

খানিক পরেই আমরা ডেরী শহরের সীমানা ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে সবুজ আর সবুজে ঘেরা আয়ারল্যান্ডের প্রাকৃতিক লীলাভূমির মাঝে চলে আসলাম। পেছনে ফেলে এসেছি দ্যা ট্রাবল, যুদ্ধ, হিংসা আর হানাহানি। দুচোখ ভরে তখন দেখছি অপরুপা এ দ্বীপকে। যতই দেখছিলাম, ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। অসহ্য সুন্দরের মাঝে যেন একটু একটু করে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। সুবিশাল পাহাড় আর মৃত্ত্বুখাঁদে ঘেরা সমুদ্র যেন এক হয়ে মিশে গিয়েছে - একেই সম্ভবত বলে ভয়ঙ্কর সুন্দর। (আগামী পর্বে বিস্তারিত বর্ননা ও ছবি থাকবে)

২১ অগাস্ট ২০০৮
ডেরী, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৩৪
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×