somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফকির ইলিয়াস
আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

শামসুর রাহমান : আমাদের অস্তিত্বের অহংকার

১৭ ই আগস্ট, ২০০৮ সকাল ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হ্যাঁ, কবিতার সঙ্গে গেরস্থালিই ছিল তাঁর| বলেছিলেন, যতোদিন বেঁচে থাকবো লিখবো| লিখেছেনও| শেষ সময় পর্যন্ত| এই দেশ, এই সময় তার মনদর্পনে বন্দী ছিল ভালোবাসায়| তিনি কাল, মহাকালকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত| তিনি স্বাধীনতার কবি, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান|

তাঁর শেষ দিকের একটি কবিতা আমার মনে পড়ছে এ মুহুর্তে| কবিতাটি ২৮ এপ্রিল ’০৬ ছাপা হয়েছিল দৈনিক যুগান্তর সাময়িকীতে|
কবিতাটির শেষ পঙ্ক্তিগূলো তুলে দিচ্ছি পাঠকের জন্য|
‘আখেরে পাড়ায় নেমে আসে অপরূপ মধুময়
চন্দিন্সমার| এই অপরূপ চন্দিন্সমাকে মুছে ফেলার কালিমা
জাগবে না কোনোখানে| কেবল চন্দ্রিমা
জাগবে হৃদয়ে— যার আভা চিরকাল রয়ে যাবে|
হে চন্দ্রিমা, রেখো মনে, এই যে লিখছি আমি, তার
সত্তা তার রইবে না, কিন্তু তুমি আসমানে জ্বলজ্বল করবে সর্বদা!’ (জ্বলজ্বল করবে সর্বদা/ শামসুর রাহমান)

‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ দিয়ে যার যাত্রা শূরু হয়েছিল, সেই কবি সহসন্স মৃত্যুকে ভেদ করে গেছেন| কলাম, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নিবন্ধ, অনুবাদ কি করেননি তিনি| কিন্তু প্রধান পরিচয় কবি হিসেবেই সর্বদা জðলজðল করবেন শামসুর রাহমান| বাংলার প্রয়োজনে| বাংলা ভাষার প্রয়োজনে| বাংলা কবিতার প্রয়োজনে|

মৃদুভাষী শামসুর রাহমানের চাওয়ার কিছুই ছিল না| চাহিদার কোনো দীর্ঘ তালিকা ছিল না তাঁর| কবিতার নেশা ছিল| ছিল পঙ্ক্তির সাথে খেলা করার স্বপ্ন| মনে পড়ছে, তিনি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রধান সম্পাদক| তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম ডিআইটি এভিন্যুতে| সহাস্যে আমাকে তার অফিসে স্বাগত জানিয়ে তিনি সদ্য বের হওয়া বিচিত্রা আমার হাতে তুলে দিলেন| তিনি আমাকে আপনি সম্বোধন করে বলতে থাকলে আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে বললাম ‘দয়া করে “তুমি” বলবেন আমাকে|’ না, তাতে কোনো কাজ হলো না| মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি সময় পেলে আসবেন|’
আট/দশ মিনিটের এই যে প্রথম দেখা, তা অনেকটা স্বর্ণোজ্জ্বল স্মৃতির চাদরেই মোড়া হয়ে গেল আমার জীবনে| এরপর সময় পেলেই ঢু মেরেছি ডিআইটি এভিন্যুতে| প্রিয় কবিকে দেখে এসেছি এক নজর|

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামরিক দু:শাসনের যাঁতাকল, অন্যায়-অবিচার আর রাজনৈতিক নিপীড়ন আমার মতো হাজার হাজার তরুণকে দেশ ত্যাগে অনেকটা বাধ্য করে| বিদেশেও বিচিত্র হয়ে ওঠে আমার নিত্য সঙ্গী সাপ্তাহিকী| এক সময় আমি বিচিত্রা’র প্রবাস থেকে কলামে নিয়মিত লেখা শূরু করি|

দুই.
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার আমন্ত্রণে কবি শামসুর রাহমান প্রধান অতিথি হয়ে একটি অনুষ্ঠানে আসেন ১৯৯০ সালে| তখন বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার সভাপতি ছিলেন সাঈদ-উর-রব| যিনি এখন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রেসিডেন্ট সিওও| আমি লীগ সভাপতি সাঈদ-উর-রব এর আমন্ত্রণেই সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই| কবি’র সাথে সে অনুষ্ঠানেই আবার দেখা হয় দীর্ঘদিন পর| দীর্ঘক্ষণ আড্ডা, সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা হয় মধ্যরাত পর্যন্ত|

মনে পড়ছে এরপর কবির সাথে সাহিত্য আড্ডায় অংশ নেবার সুযোগ হয় নিউইয়র্কের ইয়র্ক এভিন্যু’র, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের বাসভবনে| সে আড্ডার মুল আয়োজক ছিলেন গল্পকার পুরবী বসু| তার আমন্ত্রণেই নিউইয়র্ক-নিউজার্সিতে বসবাসরত বাঙালি লেখক-কবিরা সমবেত হয়েছিলেন আড্ডায়| শামসুর রাহমান ছিলেন সে আড্ডার মধ্যমনি| সে আড্ডায় অত্যন্ত প্রাণন্ত অংশ নিয়েছিলেন লেখক হাসান ফেরদৌস, ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পুরবী বসু, প্রয়াত কবি আল-মুকতাদির, ড. সলিমুল­াহ খান ,
ড মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ|

সলিমুল­াহ খান, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতা, ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’— এগুলোর তুলনামুলক আলোচনা করেছিলেন অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে| বিভিন্ন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছিলেন কবি শামসুর রাহমানকে| লক্ষ্য করেছিলাম, কবি খুব মৃদুভাষায় সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছিলেন| মৃদু হেসে তিনি বলছিলেন, আমি শুনবো, আপনারা বলুন| তাঁর অন্যতম প্রিয় কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ তিনি পড়েও শূনিয়েছিলেন সেদিন|
এর ক’বছর পর কবি যখন গ­্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন, তখন আবারো উদগ্রিব হয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তাঁর অনুরাগীরা| কবিকে যুক্তরাষ্টেন্স নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়| নিউইয়র্কের বিশিষ্ট চিকিৎসকবৃন্দ, বাংলা সাপ্তাহিকীগূলোর সম্পাদকবৃন্দ, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবি, পেশাজীবিসহ সর্বস্তরের প্রবাসীরা তাঁর চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেন| কবি দেশে থেকেও যাতে তাঁর চোখের ওষুধগূলো নিয়মিত পেতে পারেন, সে ব্যবস্থায়ও এগিয়ে আসেন বেশ ক’জন সুহৃদ প্রবাসী বাঙালি| এসময় কবির সম্মানে একটি সংবর্ধনার আয়োজনও করা হয়| খুব সংক্ষিপ্ত এবং আবেগ আপ্লুত বক্তব্যে কবি শূধুই ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা জানান প্রবাসী সমাজকে|

তিন.
কবি যখন হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হন, তখনো যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালীদের প্রতিবাদ ছিল তীব্র| নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় একটি মিলনায়তনে নাগরিক প্রতিবাদসভার আয়োজন করে হামলাকারীদের বিচার দাবী করা হয়| মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লেখক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনের কাছে কবির নিরাপত্তাদানে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করতে স্মারকলিপিও দেন প্রবাসীরা|

কবি অত্যন্ত আবেগ নিয়ে প্রায়ই বলতেন, প্রবাসী বাঙালিদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ| কিন্তু বাংলা সাহিত্য, বাংলা ভাষা, বাঙালির চেতনা, সভ্যতার আলো প্রতিষ্ঠার জন্য কবি শামসুর রাহমান যে কর্ম রেখে গেছেন, তার জন্য গোটা বাঙালি জাতিই তো তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ| কি করেননি তিনি? লেখালেখি থেকে শূরু করে মিছিল, সমাবেশ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ— কি করেননি তিনি| বাংলাদেশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মিছিলে, ঘাতক দালাল নির্মুলের আন্দোলনে এই অগ্রজ বয়সেও রাজপথের মিছিলে আমরা দেখেছি শূভ্রকেশধারী এই মহান কবিপুরুষকে| তাঁর সমসাময়িক হবার বাসনায় মগ্ন ছিলেন শামসুর রাহমান তখনই গণঅধিকার আদায়ের মিছিলে রাজপথে লড়েছেন| হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জাতির প্রতি|

অনেকগূলো কবিতার জন্যই অমর হয়ে থাকবেন শামসুর রাহমান| তাঁর ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘সফেদ পাঞ্জাবী’, ‘বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা’, ‘গেরিলা’, ‘এক ধরনের অহংকার’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, প্রভৃতি থেকে যাবে অনন্তকাল| পাঠক-পাঠিকা জীবনের স্পর্শ খুঁজে পাবেন তাঁর পঙ্ক্তিতে|

শামসুর রাহমানের মৃত্যু , আমাদের একটি পাঁজর ভাঙার শব্দের মতোই। ১৯৯৯ সালে কবি নিজে অটোগ্রাফ দিয়ে তাঁর কিছু বই আমার দু’ মেয়ে নাহিয়ান ও নাশরাত এবং আমার সহধর্মীনি কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি ও আমাকে দিয়েছিলেন| আমার কবিবন্ধু, আবু হাসান শাহরিয়ার অত্যন্ত যত্নের সাথে আমাদের কাছে সেগূলো নিউইয়র্কে পাঠিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছিলেন| আজ আমি কবির নিজ হাতের স্বাক্ষরে হাত বুলিয়ে তাঁর অস্তিত্ব খুঁজি বারবার| তিনি লিখেছিলেন ‘আমার পুরনো, সামান্য বই দিলাম ভালোবেসে|’

বই কি কখনো পুরনো হয়? কিংবা ভালোবাসা! হে প্রিয় কবি!
কবি চলে গেছেন| যেখান থেকে কেউ ফেরে না আর| তিনি তার যাত্রার প্রস্তুতি এভাবেই সেরেছেন ক্রমশ:| ‘যাত্রার আগে’— এই কবিতাটি ৯ এপ্রিল ১৯৯৯ তারিখে লেখা| স্থান পেয়েছে ‘নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে’ গ্রন্থে।
‘আমি তো শিগগিরই চলে যাব, বড় একা
যাব চুপচাপ, তোমাদের কাউকেই
সহযাত্রী করব না নিরুদ্দেশ যাত্রায় আমার| জেদ করে
লাভ নেই, আমাকে যেতেই হবে তোমাদের ফেলে|’
কবি, আপনার কবিতা ততোদিনই থাকবে, যতোদিন থাকবে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি| আপনি আমাদের অস্তিত্বের অহংকার।
==========================================








৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×