somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে
যতীন সরকার
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কি নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত? অন্তত বাংলাদেশে?

এ প্রশ্নের উত্তরে আমি পুরোপুরি নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে বলব- 'হ্যাঁ'। আবার পরক্ষণেই বলব- 'না'। এই 'না'টিও 'হ্যাঁ'-এর মতোই একই রকম দ্বিধাহীন চিত্তে নিঃসংকোচেই বলব। কেন এ রকম দুই বিপরীত কথা এক নিঃশ্বাসে বলি ও বলে ফেলতে পারি, তার ব্যাখ্যা প্রদানেও আমার কোনো দ্বিধা বা সংকোচ নেই।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তান নামক যে অপরাষ্ট্রটির অধীন হয়েছিলাম আমরা, তার হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্যই আমাদের অপরিমেয় প্রাণমান ও ধন উৎসর্গ করতে হয়েছিল। এ রকম সংগ্রাম করতে গিয়েই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র সম্পর্কে আমরা পরিপূর্ণ মোহমুক্ত হয়ে উঠেছিলাম। তাই আমাদের সংগ্রামটি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম মাত্র ছিল না, সেটি ছিল জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সেটি যেমন 'স্বাধীনতার সংগ্রাম' ছিল, তেমনই ছিল 'মুক্তির সংগ্রাম'। মুক্তির লক্ষ্যেই আমরা ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বকে ও রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করে নেওয়ার শয়তানিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমরা বুঝে নিয়েছিলাম, প্রকৃত মুক্তি পেতে হলে পাকিস্তানের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসাই যথেষ্ট নয়। সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন গণমানুষের পরিপূর্ণ মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার সুদৃঢ় ব্যবস্থাসম্পন্ন একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আর প্রকৃত গণতন্ত্র কখনো প্রতিষ্ঠিত হয় না সমাজকে শোষণমুক্ত করতে না পারলে। সেই শোষণমুক্তির জন্যই প্রয়োজন সমাজতন্ত্র।
এ রকম ভাবনাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা 'ধর্মনিরপেক্ষ' বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ধর্মনিরপেক্ষতাই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল মর্ম। ধর্মনিরপেক্ষতাই পাকিস্তানের থেকে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্টরূপে চিহ্নিত করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের 'বাংলাদেশ' নামের খোলসটি হয়তো বহাল রাখা যায়; কিন্তু উড়ে যায় এর শাঁসটি। তখন আর তার সঙ্গে পাকিস্তানের স্বরূপত কোনো প্রভেদ থাকে না। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী যারা, তারা বাংলাদেশের চির শত্রু। সেই শত্রুদের সঙ্গে কোনোরূপ আপস চলে না। যারা সেই শত্রুদের সঙ্গে আপস করবে অথবা আপসের পাঁয়তারা করবে, নিঃসন্দেহে তারাও হবে আমাদের শত্রু। সেই শত্রুদের বিরুদ্ধেও আমাদের হতে হবে আপসহীন। সে রকম আপসহীন প্রত্যয় নিয়েই তো আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম। খুব সংগত কাজই করেছিলাম। বাঙালি সন্তানদের মধ্য থেকেই তো একদল কুলাঙ্গার পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। সেই কুলাঙ্গারদের মুখে প্রতিনিয়ত ঘৃণার থুথু নিক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছু কি করা চলে?
পাকিস্তান ছিল আমাদের বহিঃশত্রু। আর এই কুলাঙ্গাররা শত্রুতা করেছে আমাদের দেশের ভেতরে থেকে। বহিঃশত্রুরা তো আমাদের ভেতরের খবর তেমন কিছুই জানত না। এই ঘরের শত্রু বিভীষণরাই তো আমাদের ঘরে ওদের ঢুকিয়েছে, ওদের লালসার আগুনে আমাদের মাতা-জায়া-কন্যাদের আহুতি দিয়েছে, আমাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছে, আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই ঘরের শত্রু কুলাঙ্গারদের সহযোগিতা ছাড়া বহিঃশত্রুরা আমাদের কোটি মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে পারত না, ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালাতে পারত না, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবর্ণনীয় অত্যাচারে জর্জরিত কিংবা বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করতে পারত না। পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা নির্বিচার বা অনির্বাচিত গণহত্যা যদিও বা চালাতে পারত, নির্বাচিত বুদ্ধিজীবী হত্যা তাদের পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব হতো না। এই জঘন্য কাজটি করেছে যারা, তারা আমাদের আশপাশেই অবস্থান করত। সে কারণেই ওরা আমাদের দেশের প্রগতিশীল ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সবাইকে চিনত, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ওই বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাচেতনা ও কর্মকাণ্ডের সব খবরাখবর ওরা রাখত, তাঁরা জীবিত থাকলে যে ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটিকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না- সে কথা ওরা ভালো করেই জানত। তাই পাকিস্তানের হানাদার সৈন্যরা যখন 'ইয়া নফ্সি' জপ করতে করতে পালানোর পথ খুঁজছিল, আমরা যখন বিজয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম, ঠিক সেই সময়টাকেই বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য বেছে নিয়েছিল ওরা। ওরা মানে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্, ইসলামী ছাত্রসংঘ, জামায়াতে ইসলামী ইত্যাকার নানা নামধারী অপসংগঠনের অন্তর্গত কতগুলো মনুষ্যরূপী সারমেয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানই আমাদের বিরুদ্ধে ওই সারমেয়দের লেলিয়ে দিয়েছিল। এখনো ওরা পাকিস্তানের বিশ্বস্ত সেবাদাসরূপে বাংলাদেশেই অবস্থান করছে, এত বছর পরও স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে ওরা মেনে নেয়নি। ইতিমধ্যে ওরা কিছু ছানাপোনাও তৈরি করেছে। ওই ছানাপোনাদের দিয়েই ওরা 'শিবির' বানিয়েছে, শিবিরে আত্মগোপন করে থেকে ওই ছানাপোনারাই গেরিলা কায়দায় চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে দেশটিকে পুনঃপাকিস্তানীকরণের লক্ষ্যে।
তবে প্রশ্ন না করে পারা যায় না, এমনটি যে ওরা করতে পারছে, তাতে আমাদের কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? আমরাই কি ওদের চলার পথটি মসৃণ করে দিইনি? 'আমরা' মানে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে বলে কিংবা আলবদর-রাজাকারদের ধুমসে গালাগাল দিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত মুখে ফেনা তুলে ফেলি; সেই আমরা কিন্তু পূর্ণ সুযোগ পেয়েও ওই ধর্মধ্বজীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেওয়ার গরজ বোধ করিনি। উল্টো বরং ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্মকে একই আধার ধারণ করার মতো চূড়ান্ত সুবিধাবাদ ও গোঁজামিলের প্রশ্রয় দিতে একটুও লজ্জিত হইনি। আমাদের অমর শিল্পী কামরুল হাসান যার নাম দিয়েছিলেন 'বিশ্ববেহায়া', তার প্রবর্তিত 'রাষ্ট্রধর্ম' যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মর্মকেই নস্যাৎ করে দেয়- এটুকু বিচারবুদ্ধিও কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? সবাই কি আমরা বেহায়া হয়ে গেছি?
অন্যদিকে 'স্বাধীনতার ঘোষক'-এর দলরূপে যারা আত্মবিজ্ঞাপন প্রচার করে, তারাই তো প্রথমে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উৎসাদন ঘটিয়ে 'রাষ্ট্রধর্ম' প্রবর্তনের পথ খোলাসা করে দেয়। কাজেই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ওই দলটির কাঁধে ভর করে বসতে পারে আমাদের পরাজিত শত্রুরা এবং অনায়াসে ধর্মীয় রাষ্ট্র তথা পাকিস্তানকে ফিরিয়ে আনার জিগির তুলতে পারে। শুধু জিগির তোলা নয়, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য সামান্য ভুল স্বীকার করেনি বা অনুতপ্ত হয়নি যারা, তারাই মুক্তিযুদ্ধের অমৃতফল স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায়ও দখল বিস্তার করে বসে।
আর আমরা যাঁরা 'বুদ্ধিজীবী' পরিচয় দিয়ে গর্বে টইটম্বুর হয়ে উঠি, সেই 'আমরা'ও অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার দুশমনদের বাংলাদেশের বুকে প্রতিষ্ঠিত করে রাখতে বুদ্ধির কসরৎ প্রদর্শনে কম পারঙ্গমতার পরিচয় দিচ্ছি না। ওই দুশমনদের পক্ষে অপরিমেয় কটূক্তি ও অপযুক্তি আমাদের বুদ্ধির ভাণ্ডারে জমা করে রেখেছি। কোন কোন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, কোন কোন দেশের রাষ্ট্রনেতারা ধর্ম তথা ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করেন, সেসব দেশের নাম আমরা গড় গড় করে বলে দিতে পারি।
কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া এমন দেশ কোথায় আছে, যে দেশকে পাকিস্তানের মতো একটি ধর্মভিত্তিক অপরাষ্ট্র ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে? না, বাংলাদেশের মতো এমন দেশ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে দেশের স্বাধীনতাকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠাদানের জন্য অবশ্য অবশ্যই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশ বা রাষ্ট্রেরই অনুকারী বা অনুসারী হবে না। বরং ধর্মনিরপেক্ষতাকামী সব রাষ্ট্রেরই আদর্শ হবে বাংলাদেশ। যেসব সেয়ানা বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশকে এমন একটি আদর্শ রাষ্ট্ররূপে দেখতে চান না, তাঁরা যে তাঁদেরই পূর্বসূরি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের সঙ্গেই বেইমানি করে দুর্বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়েছেন- এ বিষয়ে সামান্য সন্দেহেরও অবকাশ নেই।
ওই দুর্বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ যখন সূক্ষ্ম চাতুর্যের সঙ্গে বলে বসেন যে- 'জামায়াতসহ যেকোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে দিলে ওরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে, তাই...'- তখন এ রকম বুদ্ধিকে বলিহারি না দিয়ে পারা যায় না। তাঁরা তো এমনও বলতে পারেন, লুটেরা-ডাকাত-ধর্ষকসহ কারোর কোনো কর্মকাণ্ডকেই নিষিদ্ধ করা ঠিক নয়, তাহলে তারাও তো আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েই এসব করবে!
তবে হ্যাঁ, সরকারি ঘোষণা দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না- এ কথাও আমাদের অবশ্যই মানতে হবে। ব্যাপারটিকে নিশ্চিত করার- অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যাতে বিপর্যস্ত করে তুলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করার- একক দায়িত্ব কোনো দল, গোষ্ঠী বা সরকারের নয়। এটি দেশের সব মুক্তবুদ্ধি ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সামাজিক দায়িত্ব। সেই সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্যই প্রয়োজন দেশব্যাপী প্রবল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সে রকম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সফলতার মাধ্যমেই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে, 'গ্রাউন্ডে' বা 'আন্ডারগ্রাউন্ডে'- কোথাও পাকিস্তানমার্কা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চলতে পারবে না এবং স্বাধীনতার শত্রুরা চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এতক্ষণ ধরে যা বললাম, এখন বলতে চাই তার বিপক্ষে। না, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বলে এতকাল যা পরিচিত হয়ে এসেছে- বিশেষ করে পাকিস্তান যা করেছে তার পক্ষে নয়। বলতে চাই প্রকৃত ধর্মের পক্ষে। পুরো সমাজে সেই প্রকৃত ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যে রাজনীতি, সে রকম ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে। সমাজের সব মানুষের জন্য সে রকম রাজনীতির অবাধ বিস্তার ঘটাতে হলে অবশ্যই রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। অর্থাৎ রাষ্ট্র হবে নাগরিকদের ইহলৌকিক মঙ্গলের ধারক, কোনো মানুষের পারলৌকিক ভাবনা, ভাবনার দায় ও অধিকার কোনো রাষ্ট্রেরই নেই। কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মকে যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম বানানো হয় কিংবা ধর্মীয় রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয় যে রাষ্ট্রকে, সে রকম সব রাষ্ট্রই মানবধর্মের ঘাতক। রাষ্ট্রধর্ম বা ধর্মীয় রাষ্ট্র সংকীর্ণ মৌলবাদের পোষক, মানুষের বিবেকের স্বাধীনতার অপহারক। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের উচ্ছেদক, প্রতিটি মানুষের বিবেকের স্বাধীনতার সংরক্ষক। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ যেহেতু কখনো মানুষের বিবেকের স্বাধীনতা বা মুক্তবুদ্ধিচর্চার অধিকার স্বীকার করে না, সেহেতু স্বাধীন মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদকে দমন করে ধর্মচর্চায় মুক্তবুদ্ধির দরজা খুলে দিতে হবে। এর মানে কিন্তু কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মের বদলে সব ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কার্যে স্থান দেওয়াও নয়। এমন ব্যবস্থাকে মুক্তবুদ্ধি চর্চা বলে না, এমন রাষ্ট্রকেও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা চলে না। 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার'- এ রকম কথার মধ্যেই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত তাৎপর্যের প্রকাশ ঘটে। এ রকম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে লোকসাধারণ যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার ভোগ করবে, তা পাকিস্তানমার্কা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
লোকসাধারণের ধর্মের প্রসঙ্গেই মনে পড়ে ইতালির প্রখ্যাত মার্কসবাদী চিন্তক আন্তনিও গ্রামসির কথা। গ্রামসি দেখিয়েছেন যে পৃথিবীর সব দেশেই লোকসাধারণের ধর্মভাবনা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল শ্রেণীর ধর্মভাবনা থেকে প্রায় সর্বাংশেই পৃথক ও বিপরীত। বাংলাদেশের লোকসাধারণের ক্ষেত্রে গ্রামসির এ বক্তব্য পাশ্চাত্যের বহু দেশের চেয়েও অনেক বেশি সত্য। বাংলার মানুষের লৌকিক ধর্ম শুধু অসাম্প্রদায়িক নয়, পুরোপুরি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে এর অবস্থান। 'নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত'- এ রকম মৌলবাদী ধর্মবিরোধী অবস্থানে থেকেই বাংলার লোকসাধারণের সব জীবনাচার পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। তাদের রাজনীতিও তা-ই। লোকসাধারণকে অবশ্যই লৌকিক ধর্মভিত্তিক রাজনীতিচর্চার পূর্ণ অধিকার দিতে হবে। তা হলেই লোকসাধারণের হাতে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ প্রতিহত হবে, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক ধর্মের কলুষ ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হবে, সমাজতন্ত্রমুখী ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ নিষ্কণ্টক হবে।
সে কারণেই 'ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত কি না'- এ প্রশ্নের উত্তরে এক নিঃশ্বাসেই আমি 'হ্যাঁ'-ও বলি, 'না'-ও বলি।
লেখক : শিক্ষাবিদ
Click This Link
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×