যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ক্ষমতাবানদের দূরদৃষ্টি
ফকির ইলিয়াস
=============================================
জনগণের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশীরের বিরুদ্ধে বর্বরতম গণহত্যার অভিযোগ করা হয়েছে। ১৫ জুলাই ’০৮ মঙ্গলবার এটা ছিল মার্কিনি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত অন্যতম শীর্ষ খবর। সুদানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে ডারফুরে আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর ওপর যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে এর প্রধান পরিকল্পনাকারী ওমর আল বাশীর। খুন, ধর্ষণসহ জঘন্যতম অমানবিক কর্মযজ্ঞের প্রধান হোতা তিনি। এ জন্য তার বিচার হওয়া প্রয়োজন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রসিকিউটর লুইস মরেনো -ওকামপো বলেছেন আমরা ডারফুরে আড়াই মিলিয়ন মানুষের নির্মম হত্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি না। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে দায়ের করা এই মামলার মাধ্যমে যথাশিগগির সম্ভব ওমর আল বাশীরকে গ্রেপ্তার করার সুপারিশ করা হয়েছে।এদিকে সুদানী রাষ্ট্রপক্ষ এর দায় অস্বীকার করে বলেছে অভিযোগটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে করা হয়েছে। সরকার গণহত্যার দায় এড়িয়ে গিয়ে বলেছে, তারা শান্তি রক্ষার চেষ্টা করছে।
আš-র্জাতিক আদালতে গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে দাবি তা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য স্বস্থির সংবাদ বয়ে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, যারা যুদ্ধাপরাধী তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবেই। এর প্রয়োজনে সুদানের ওপর অর্থনৈতিক এমবার্গো দেওয়ার কথা বিবেচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র।গণহত্যার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-খুনিরা আশি বছরের বৃদ্ধাকেও যেমন খুন করে, দশ বছরের নাবালিকাকেও ধর্ষণ করতে তেমনি পিছপা হয়নি। এর উদাহরণ আছে বাংলাদেশেও। একাত্তরের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে হিংস্রভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হায়েনারা বাঙালি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ওপর। সেই যে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর হোতারা এখনো রয়ে গেছে এই বাংলাদেশে।
তারা মাঝে মাঝে এটাও বলছে যে, তারা ভুল করেনি। একাত্তরে যারা ভুল না করার দাবি করছে, প্রকারান্তরে তারা সেসব ধর্ষণ, গণহত্যার পক্ষেই সাফাই গাইছে। আর সেই দাবি করার জন্যই তাদের বিচার শুরু হতে পারে ধর্ষণ-গণহত্যার অপরাধে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের মানুষ দীর্ঘদিন থেকেই।
দেশে ও বিদেশে যে সব সচেতন বাঙালি সমাজ রয়েছেন তাদের উচিত হবে এই কাজটি ত্বরান্বিত করতে এগিয়ে আসা।
আমরা জানি একটা সমাজ পরিচালিত হয় কিছু নীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখেই। সময় ও মানুষের পক্ষে সে নীতির সৃষ্টিশীল পরিবর্তন হতেই পারে। নিজ ভূমির নিরাপত্তা রক্ষায় আইনের প্রয়োগও করা হয় বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করেই। অতিসম্প্রতি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে তেমনি একটি আইন পাস করেছে ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে।
এখন থেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ফটোগ্রাফাররা নিউইয়র্কের যত্রতত্র শুটিং করতে কিংবা ছবি তুলতে পারবেন না। সাইডওয়াক, ফুটপাথ বন্ধ করে ছবি তুলতে কিংবা শুটিং করতে গেলে তাদেরকে স্টেট গভর্নমেন্টের অনুমতি নিতে হবে। এর সঙ্গে তাদের কমপক্ষে এক মিলিয়ন ডলারের ইন্সুরেন্স থাকতে হবে। শুটিং বা ছবি তুলতে যে সব গাড়ি, জনবল ব্যবহার করা হবে, তাও ইন্সুরেন্সের আওতায় থাকতে হবে।
এই আইন প্রণয়নের পেছনে অন্যতম একটি কারণও রয়েছে। খ্যাতিমান একজন ডকুমেন্টারিয়ান রাকেশ শার্মা ম্যানহাটানের একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে কিছু চিত্র গ্রহণ করছিলেন। সেটা ২০০০ সালের ঘটনা। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আটক রেখে। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি ফেডারেল কোর্টে ক্ষতিপূরণ ও মানহানি মামলা করেন। মামলায় তিনি জয়ী হন। সিটি কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে সেটেলম্যান্ট করতে বাধ্য হয়।
আলোচ্য আইনটি প্রণয়নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ফটোগ্রাফার, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং মানবাধিকার সংস্থার আইনজীবীরা। তারা বলেছেন এই আইনের আওতায় দুই বা ততোধিক ব্যক্তি ৩০ মিনিটের বেশি সিটির কোনো অংশে ছবি তুলতে গেলেই অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। যা স্বাধীন চিন্তা, মননের পথে অন্তরায়। অন্যদিকে নিউইয়র্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ বলেছেন, সুশৃঙ্খলতা, সৃজনশীলতা রক্ষা এবং আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের জন্যই এসব আইন করা হয়েছে। আগে ছিল না, তাই এখন যে করা যাবে না, তেমন তো কোনো কথা কোথাও লেখা নেই।
আমি মনে করি মেয়র ব্লুমবার্গ যথার্থই বলেছেন সময় বদলাচ্ছে। অপরাধের ধরন, অপরাধীর মানসিকতা বদলাচ্ছে। তাই আগে ছিল না, এমন অপরাধ দমনে নিরাপত্তা আইনও করতে পারে যে কোনো রাষ্ট্রপক্ষ। সমাজ বাঁচাবার জন্য সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রণীত হতেই থাকে জনপ্রিতিনিধিদের দ্বারা কালে কালে।
এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা এ বিষয়টিও লক্ষ করি, প্রণীত আইন কখনোই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য চাপিয়ে দেন না কিংবা বাক স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতার নামে জাতি-গোষ্ঠী বর্ণ-ধর্ম বৈষম্যমূলক ঘটনাবলীকেও প্রশ্রয় দেন না বিশ্বের বরেণ্য রাজনীতিকরা।
এখানে সে রকমই আরেকটি ঘটনার উদাহরণ দিতে পারি। গত সপ্তাহে বিখ্যাত ‘দ্যা নিউইয়র্কার’ ম্যাগাজিন বারাক ওবামা ও তার স্ত্রী মিশাল ওবামাকে নিয়ে একটি প্র"ছদ কার্টুন ছেপেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বারাক ওবামা একজন মুসলমান হিসেবে পোশাক ধারণ করেছেন। তার মুখোমুখি তার স্ত্রী মিশাল দাঁড়িয়েছেন পায়ে বুট, কাঁধে রাইফেল নিয়ে একজন সন্ত্রাসী হিসেবে।
ম্যাগাজিনটি বাজারে আসার পরপরই হৈ চৈ পড়ে যায় সর্বত্র। বারাক ওবামার নির্বাচনী সদর দপ্তর থেকে বলা হয়, নিছক টেস্টলেস প্রোপাগান্ডা। ডেমোক্রেট শীর্ষ নেতারা বলেন, দ্যা নিউইয়র্কার ম্যাগাজিন তাদের বৈষম্যমূলক হীন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে, মার্কিনিরা তা সাহসী চিত্তেই প্রত্যাখ্যান করছেন এবং করবেন। সিনেটর হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, এ সব হীনকর্ম ডেমোক্রেটদের বিজয় ঠেকানো যাবে না।
রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইন বলেছেন, এটা খুবই অসঙ্গত এবং অপ্রত্যাশিত। আমরা একটি সভ্য সমাজে বাস করি। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা সিনেটর ওবামা, তার স্ত্রী ও সমর্থককে অবশ্যই দার"ণভাবে মর্মাহত করবে।
একটি কথা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, কোনো যুদ্ধাপরাধীকে যেমন বিচার থেকে বাঁচানো যায় না, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক দুষ্ট অভিসন্ধি বা লক্ষ্য নিয়ে কারো ব্যঙ্গ কার্টুন এঁকেও তাকে সন্ত্রাসী বানানো যায় না।
জনগণ চতুরতা ঠিকই বুঝতে পারে। ধরতে পারে সব শঠতার সুপ্ত অভিপ্রায়। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশীর ডারফুরে ঘৃণ্যতম নরহত্যায় তার বাহিনী পাঠিয়ে যে ইন্ধন জুগিয়েছেন, সে জন্য তার বিচার এখন সময়ের দাবি। ঠিক তেমনি বারাক ওবামা কৃষ্ণাঙ্গ বিধায় তাকে থামিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা এটাও চরম ঘৃণার দাবি রাখে। শান্তি ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে ক্ষমতাবানদের ক্রিয়েটিভ আউটলুককে সম্প্রসারিত করতে হবে। ভেতরে ক্যানসারের রাহুগ্রাস রেখে উপরে প্রলেপ দেওয়ার মাধ্যমে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় কখনোই, কোনো দেশে।
১৬ জুলাই ২০০৮
---------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ । ১৯ জুলাই ২০০৮ শনিবার প্রকাশিত
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ক্ষমতাবানদের দূরদৃষ্টি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---
পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।
রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে
সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।
যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন
বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!
যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।
কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!
ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন
সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।
০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন