somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্পর্শের সীমানায়

১০ ই জুলাই, ২০০৮ বিকাল ৩:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রোদের নাকি রঙ আছে। সেদিন বলেছিলো নবনীতা। আমি বলেছিলাম 'নেই'। রোদের আবার রঙ হয় নাকিÑ যত্তোসব আজগুবি কথা। অনিন্দ অবশ্য কাউকে কোনোদিন প্রশ্ন করেনি। বলা যায় প্রশ্ন করার সাহস পায় নি। রোদ সেতো রোদ-ই। মহাবিশ্বের মহারাজ সূর্য-নিসৃত অদ্ভূত এক উষ্ণ রশ্মি। যে রশ্মি নিমিষেই হত্যা করতে পারে পৃথিবীময় অন্ধকারকে। মরা চাঁদকে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়ে বানাতে পারে রাতের রানী, কোনো প্রেমময় প্রেমিকের কল্পিত প্রেয়সির প্রতিচ্ছবি।
মে মাস। রাজশাহী জুড়ে আমপাকা গরম। প্রচন্ড গরমের শরমে নরম হয়ে যায় মানুষের নাগরিক জীবনের পরম প্রশান্তি। আজ নবনীতা ডেকেছে অনিন্দকে। ভর দুপুরে যেতে হবে পদ্মার চরে পায়চারি করতে। সেখানে রোদের রঙ দেখাবে তাকে। মাস খানেক হলো অনিন্দ’র সাথে দেখা হয়নি নবনীতার। আসলে তেমনএকটা সুযোগ হয়ে ওঠে নি। মনটা তাই ভালো নেই মোটেই। মনের রঙ যেখানে ফ্যাকাশে, রোদের রঙ দেখা না-দেখায় কিছু যায়-আসে না।
খাঁ খাঁ রোদ হাডুডু খেলছে পদ্মার চরে। জনমানবহীন ধুধু বালিপ্রান্তর। নবনীতা খুব একটা শাড়ি পড়ে না। ওর শাড়ীর আঁচলে রোদ লেগে ঝিকমিক করছে জরির দানা। আজ ওদের ডিপার্টমেন্টের নবীন বরণ। ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান চলছে জমকালো। এমন দিনে প্রিয় মানুষটির সাথে সাাতের সুযোগ নষ্ট করাটা নবনীতার কাছে নেহায়েত বোকামী ছাড়া কিছু নয়। এমন একটি দিনের প্রতীা করছিলো অনিন্দও। বেশিদিন দূরে থাকলে মরে যেতে ইচ্ছে করে ওদের। আর দশজনের মতো নয় ওদের প্রেমের গতিপ্রকৃতি।
চরের তপ্ত বালিতে পা পুড়ছে ওদের। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই কারোর। খেয়ালের খেই হারিয়ে ফেলেছে ভালোবাসার সম্মোহনী বিচরণে। আত্মার ঝির ঝির করে আকাশে বয়ে যাওয়া প্রশান্তির একরাশ সুশীতল হাওয়ায় যেনো ওরা বরফ হয়ে গেছে অনন্তকালের তরে। বালিতে বসে ভাবের সায়রে ডুব দেয় দুজন। কোনো কথা না বলেও হাজারো কথার কাব্য বোনে ওরা মনে মনে। না নড়ে, না চড়ে। চারটি নেশাভরা চোখের নিস্তব্ধতা, ভ্যাকুয়াম করে দেয় শঙ্খচিলের আর্তনাদের কম্পাংক। নীরব কোলাহলকে যেনো সযতনে কোলে করে ধ্যানমগ্ন রয়েছে পৃথিবীর আধুনিকতম দুই মানব-মানবী।
যে চরে ওরা নিশ্চল মনোচলাচলে প্রবৃত্ত, সেখান থেকে দেখা যায় ভারত সীমান্ত সংলগ্ন একটি পুরনো চর, নাম তার চর খিদিরপুর। নিস্তব্ধতাকে খুন করে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেলো একটা শ্যালো নৌকা। অনিন্দ চোখ তুলে তাকালো চারিদিকে। কোথাও কেউ নেই। সোনালী রোদের স্রোতে ভিজে গেছে ওদের সম্পূর্ণ শরীর। ঘোর কাটেনি তখনো নবনীতার। ওর নেশাভরা চোখ দেখে মনে হয় ও চলে গেছে অনিন্দের হৃদয়েল গোপন কোনো এক প্রকোষ্ঠে। যেখানে নবনীতার জন্য লুকানো আছে সহস্র সাগর ভালোবাসা। সেই জলেই বুঝি শীতল হয়েছে ওর দেহ-মন, অন্তর-বাহির-প্রান্তর।
আর তো মাত্র কয়েক মাস বাঁকি। নবনীতার মাস্টার্স ফাইনালটা হলেই ওকে বিয়ে করবে অনিন্দ। অবশ্য নবনীতার পরিবারের একেবারেই অমতে। ওর বাবার পছন্দ বড়লোকের বখে যাওয়া এক ধনকুবের ছেলেকে। মাঝে মাঝে ছেলেটা ইটে-টিয়ে খেয়ে শহরে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এতেই ছেলেটির মজা। রাস্তায় নবনীতার রিকশা দাঁড় করিয়ে অশালীন বাক্যব্যয় তার অভ্যাস। কথায় কথায় জনসম্মুখে মোবাইল ফোনে ব্যাংক ব্যালেন্স শোনানোতেই ওর আত্মতৃপ্তি। নবনীতার মায়ের মোটেও পছন্দ নয় পিটার নামের ছেলেটিকে। আদালতে ওর নামে দুটি খুনের মামলা বিচারাধীন। নবনীর বাবা ওসব গায়ে মাখেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার নামেও নাকি একটি মিথ্যা খুনের মামলা হয়েছিলো। টাকা পয়সা না থাকলে নাকি মানুষ হিসেবে জগতে বেঁচে থাকা অপমানজনক। পিটারের বাবাও মাঝে মাঝে আসেন ওদের বাসায়। বেহায়ার মতো অঙ্গভঙ্গি করে খোশগল্প করেন নবনীর বাবা ফায়েজ চৌধুরীর সাথে। উনিও নবনীতার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার প্রহর গুনছেন।

পিটারের অযাচিত নজরদারীর কারণে খুবএকটা দেখা করতে পারে না অনিন্দর সাথে। বাইরে বের হলেই পিছু নেয়। আজ নবীন বরণের কথা শুনে হয়তো ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খুঁজে খুঁজে অস্থির। অনিন্দর সাথে সম্পর্কের কথা ও জানে। দুজনকে একসাথে দেখলে সে ঘটিয়ে দিতে পারে লঙ্কাকান্ড।
বালির উপরে পড়া সূর্যের রশ্মি ঝিলিক দিচ্ছে ওদের চোখে। টিস্যু পেপার দিয়ে ঘাম মুছে নেয় অনিন্দ। যত্ন করে মুছে দেয় নবনীতার মুখ-বুক আর পায়ের তালু। ওর মাথার চুলে লেগে থাকা বালি ঝেড়ে ফেলে দেয়। এরপর ওর কানের দুলে হাত বুলিয়ে কি যেনো ভাবে অনিন্দ।
হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে নবনীতা। ওর চিৎকারে কেঁপে ওঠে বালুপ্রান্তর, কেঁপে ওঠে অনিন্দর অন্তর। কয়েক বিন্দু ঘামের ফোঁটা ছিঁটকে পড়ে তপ্ত বালুর উপর। নিষ্ঠুর বালু নিঃসঙ্কোচে শোষণ করে প্রেমের আরাধনা-উচ্ছিষ্ট লবণ।
মিনিট পাঁচেক অতিক্রান্ত হলো। তবু কান্নার ফোঁসফোঁসানি থামলো না নবনীতার। পারিবারিক শৃঙ্খলার শিকলে আবদ্ধ তার স্বত্তা। এই প্রেমের পরিণতির কথা ভেবেই ভেঙ্গে পড়ছে সে। বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে না হয় বিয়ে করা যাবে অনিন্দকে। বাবা-মাকে ছেড়ে যাওয়ার, তাদেরকে কষ্ট দেয়ার যন্ত্রণাকে তো আর অতিক্রম করা যাবে না কখনো। মানুষের বিবেক বোধ একটি বন্য হরিণ। সামান্য বিষয়েই ছুটোছুটি করে রক্তাক্ত করে মনোপ্রান্তর। নবনীতা ভূগছে উভয় সংকটের সমূহ সংকীর্ণতায়। প্রেমাবেগ প্রজ্বলনের কষ্টে যেমন তার মন পোড়ে, ঠিক তেমনি নিবারণের কষ্টে মন-দেহ উভয়ই পোড়ে।
নবনীতার কান্নার শব্দে থমকে যাওয়া অনিন্দ কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেয় ওর কপাল, কম্পমান ঠোঁট জোড়া আর নীলাভ চোখের ঝলমলে জল। লবণাক্ত জলের ধারা যখন অনিন্দর আঙুল ছুঁয়ে চুঁইয়ে পড়লো নবনীতার বুকে, তখন ভালোবাসা-বিচ্ছুরিত চোখে নবনীতা তাকালো অনিন্দ’র দিকে। অনিন্দ’র হাতের একটু ছোঁয়ায় যেনো আত্মার পরম প্রশান্তি অনুধাবন করলো সে। মুখে কষ্ট-মিশ্রিত মৃদু হাসি। ওর গালের টোলে ও চোখের পাতায় তখনো মুক্তার দানার মতো ঝলমল করছে প্রেমাশ্র“। ততণে রোদের দল চলে গেছে কোন সূদুরে। ওদের মাথার উপর এখন এক আকাশ মেঘ ছাতা হয়ে ভাসছে।
অনিন্দ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো নবনীতাকে, গরম লাগছে?
- উঁহু। না সূচক মাথা নাড়ালো সে।
- চলো উঠি।
- তোমার খুব গরম লাগছে বুঝি?
- উঁহু। অনিন্দও নবনীতার মতো করে মাথা নাড়ালো।
- রোদের রঙ দেখতে পেয়েছো?
- হুঁমম..
- কী রঙ বলো না গো।
- মনে অফুরন্ত প্রেম থাকলে রোদের রঙ মাঘের শীতের ঘন কুয়াসার মতো। প্রেমাশক্ত অবস্থায় সবকিছুরই রঙ চেনা যায়।
- তুমিই তো বলেছিলে রোদের কোনো রঙ হয় না।
- বুকে তখন বিরহের আগুণ জ্বলছিলো নীতা।
- হুঁমম...মনে যখন প্রেম থাকে, আর প্রিয় মানুষটি যখন থাকে স্পর্শের সীমানায় তখন শুধু রোদের রঙ কেনো, কামার্ত বাতাসের রঙেরও ছাপ পড়ে অন্তরে।
বিকেল হয়ে আসে- একেবারে পড়ন্ত বিকেল। দুজনে হেঁটে ফিরে আসে দুজনার বাসায়। কিন্তু বাসায় ফেরার পর দুজনার বুকের ভেতরে সৃষ্টি হয় শূন্যতার। ওদের মনদুটো সেদিন বিকেলে তো আর ফিরে আসে নি বাসায়। মনদুটো এখানো পদ্মার চরে ঘুরে ফিরে রাতের চাঁদ দেখছে, দুপুরের রোদ গায়ে মাখছে আর বালি দিয়ে গড়ছে ভালোবাসার আরেকটি তাজমহল।

চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০০৮ রাত ৮:৫৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩১




সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×