আমার সালাম নিবেন।
তাজুল ভাইয়ের জন্য আমার ভীষন খারাপ লাগছে। আপনাকে কোন সান্তনা আমি দেবনা কেননা কোন কিছুতেই এই হারাবার বেদনা ভুলবার নয়।
আনেক দিন থেকেই আপনাকে কিছু কথা লেখার খুব ইচ্ছা আমার। কারন যখন আপনার সাথে কথা বলি তখন খুব ভালো লাগে আবার খারাপ ও লাগে। ভালো লাগে কারন আপনি এখনও দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, আর খারাপ লাগে আমার কথা ভেবে, কারন দেশকে নিয়ে যে আমি আর স্বপ্ন দেখতে পারিনা। দূর প্রবাসে দেশকে ভেবে চোখের জল ফেলার মাঝেই আমার দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ।
প্রায় ৫ বছর পর দেশে গেলাম।আশ্চর্য রকম কোন পরিবর্তন আমি কখনই আশা করিনি।জানতাম দেশের অবস্হা আরো খারাপ হয়েছে,এই ইন্টারনেটের যুগে দেশের সব খবরই প্রত্যেক দিন পাওযা যায়। তবু মনের গহীনে লুকিয়ে ছিল একটু আশা, যা আমি নিজের অজান্তেই বয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।
কিছু ব্যাপার ভলো লেগেছে, সি এন জি বাস অটোরিক্সা, পলিথিন বন্ধ, সুযোগ সুবিধা বেড়েছে, আমি আমার ইউ কে ব্যাংক কার্ড দিয়ে টাকা তুললাম, আমার সব বন্ধু ই ভালো কাজ করে ভালো বেতন পায়। খুব ভালো লেগেছে ওরা ভালো আছে দেখে।
অন্যদিকে সবকিছুর দাম বেড়েছে, যার টাকা আছে তার সবকিছু ই আছে, তাদের জীবনয়াপন পাশ্চাত্যকেও হার মানায়। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় ঐশ্বর্যের ছড়াচড়ি, সুউচ্চ শপিং মল আর বিলাস বহুল এপার্টমেন্ট, দামী দামী গাড়ী। দোকানে দোকানে ছেয়ে গেছে চারিদিক, তাতে দামও আকাশছোয়া। মনে পড়ে এক দোকানে একটা ট্রাউজারের দাম ছিল ২০০০ টাকা যা প্রায় এখানকার সমান। দেশে তবে পয়সাওয়ালা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে!
যেভাবে বেড়েছে দুনীতি। আমার এক বন্ধু তিনবারে এইচ এস সি পাশ করে হয়েছে কলেজের লেকচারার। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, আনেক আগেই আমাদের মেরুদন্ড ভেংগে গিয়েছিল ইউনিভারসিটি গুলোতে বাংলা চালুর মাধ্যমে আর এখন মেরুদন্ড অপসারন চলছে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের মাধম্যে। শিক্ষা এখন পণ্য,বড়লোকের ছেলেমেয়েদের একচ্ছএ অধিকার তাতে। কারন যেখানে ভালো মানের শিক্ষা পাওয়া যায় সেখানে পৌছুতে গাড়ি লাগে।
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাবার রাস্তার অবস্হা নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন!রাস্তা বড় হয়েছে সেই সাথে বেড়েছে দুধারের দোকান,আর জনসংখ্যা। কেউ কোন নিয়ম মানে না, যে যেখান দিয়ে পারছে রাস্তা পার হচ্ছে। বেড়েছে গাড়ি , দূর্ঘটনা। প্রত্যেকদিন খবরের কাগজে ছাপা হয় এমন কত দূর্ঘটনার খবর। জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই কোথাও। মানুষ ঘর থেকে বের হয় জীবনটাকে হাতে নিয়ে। গাড়ী চালাতে দেশেতো আর ড্রাইভিং জানার দরকার হয়না। যে দেশে অর্থের বিনিময়ে সব কেনা যায় সে দেশে জীবনের মূল্য থাকে কি করে?
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের আইন বিভাগের ২৩তম ব্য্যাচ থেকে প্রায় ৩০ জন ইংল্যান্ডে পড়ছি। প্রত্যেক ঈদে আমরা একত্রিত হই। গল্প করি, রান্না করি,একসাথে খাই, প্রবাসের সুখ-দুখ ভাগ করে নেই, একে অপরের ভালোমন্দ সমালোচনা করি, আর সবচেয়ে বেশী কথা বলি দেশকে নিয়ে। প্রত্যেকের চোখে কত স্বপ্ন, দেশে ফিরে যাব, ভালো কিছু করব! সবাই যেন আমরা এক ই পথের পথিক।
অথচ এই আমরাই যখন দেশে ফিরে যাই-কোথায় যেন সব অনুভূতি গুলো হারিয়ে যায়। কোথায় যেন কি গোলমাল! কেউ কিছু করতে পারেনা। সব আবেগ ঝরে পড়ে, আমরা অন্ধ হয়ে যাই, বধির হয়ে যাই, পংগু হয়ে যাই।শুধু নিজের জন্য কাজ করে যাই। শুধু চাই নিজের উন্নয়ন, আর বড়বড় কথা বলি। কাজ করি না।
কাজ করিনা বললে মিথ্যা বলা হয়। প্রতিদিন এখানে যা দেখছি তা অন্য কথা বলে, প্রতিটি ছেলেমেয়ে রাতদিন খেটে কড়ায়গন্ডায় কর দিয়ে নিজের টিউশন ফিস দেয়, থাকা খাবার খরচ মেটায়। কাজ আমরা করি এবং তা নিজের জন্য। নিজের উন্নতি ই তো দেশের উন্নতি। খারাপ লাগে তখনি যখন এতো পড়াশোনার পর ও আমাদের মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়না, আমরা ভালো কিছু গ্রহন করতে জানিনা বলেই পরের দেশে ট্যক্স দিয়ে নিজের দিশের ট্যাক্স ফাকি দেই।
দেশে থেকেছি প্রায় ৩৩ দিন, কেমন লেগেছে তা এখনো বুঝছিনা। তবে দেশে ফিরে যাবার ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে দিনদিন। এই ইচ্ছায় বাস্তবতার চেয়ে আবেগ বেশী। আমি আবেগ দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেবনা।আমার জীবনের লক্ষ্য বাবা আর মাকে সুখী করা।আমি তাদের শেষ বয়সে দুশ্চিন্তার কারন হতে চাইনা। আমার বাবাকে সারাজীবন সংগ্রাম করতে দেখেছি আর মাকে দেখেছি ত্যাগ করতে, সংসারের জন্য নিজের সুসংহত এবং সন্মানিত অবস্হান। আমি আমার বাবার মত যোদ্ধা নই, হতে পারবনা মায়ের মতোও।আমি বড় স্বার্থপর, কাপুরুষ তাই নিজের দেশ কে ভুলে নিজেকে সূখী করার এই বৃথা চেষ্টা।
কিন্তূ আমার শেকড়কে কিভাবে আমি ভুলি?যত কিছুই হোক এদেশতো আমার, এদেশের আলো,বাতাস,মাটি,জল আমার সারাদেহে। বিদেশে দেশের গান শুনে, দেশের ভালো একটা খবরে চোখের পানি বুঝিয়ে দেয় আমি কে!তাই ফিরে তো আসতেই হবে। দোয়া করবেন যাতে একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে দেশে ফিরে আসতে পারি।