somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উৎসর্গ সবাক কে

১৮ ই জুন, ২০০৮ বিকাল ৪:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চীনের কুনমিং শহরের এক বাংলাদেশী গেষ্ট হাউজের "হাউজ বয়"। শরীর তার "শরীর" বিষয়টাকেই ধারণ করে না। এতো চিকন চাকন ছেলে আমি খুবই কম দেখেছি। জন্ম তার সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানায়। তাও তার শোনা কথা। জন্মের পর বেড়ে ওঠা নিয়ে তেমন কোন স্মৃতিচারণ করতে রাজি হয়নি। শুধু বলেছে, "অনেক লাত্থি ওষ্ঠা খাওয়া মানুষ আমি"।

২৬ নভেম্বর ২০০৬ জীবনের বুলডোজার কুনমিং বিমানবন্দরে। ইমেগ্রেশন ঝামেলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখি, একটি ছেলে মোটা একটি কাগজ হাতে দাড়িয়ে আছে, যাতে লেখা "বাংলাদেশীদের জন্য আমি আছি"। তাকে জিজ্ঞেস করলাম বিষয়টা কি? পরে জানলাম তাদের একটা গেষ্ট হাউজ আছে যেখানে আমি ইচ্ছে করলে থাকতে পারি। যেহেতু আমি নতুন তাই আর দেরি করিনি। তার সাথেই গেলাম। পথে জানলাম, প্রতিদিন তার মালিক স্বয়ং আসে। আজ তাকে পাঠিয়েছে। নাম জানলাম- সবাক। আমার চাইতে উন্নত পোশাকে দেখে ছেলেটাকে অধিক সুখী ভাবি।

ঢাকা শহরের শনির আখড়া এলাকার টোকাই ছিলো সবাক। তখন বয়স হবে, ১৪। এক ভদ্রলোক তাকে খুব আদর করতো। কখনওই খারাপ কিছু পায়নি ওই ভদ্রলোকের চাল চলনে। এই ভাবে কাটে প্রায় দেড় বছর। সবাকের পিছনে এই দেড় বছরে অন্তত ৩০ হাজার টাকা চালান দিলেন ওই ভদ্রলোক। তার পর একদিন লাভ বুঝে নেয়ার হিসেব কষলেন। সবাককে মালয়শিয়া নেবেন বলে কথা দিলেন। সবাকের মনে খুশির নাচন কে দেখে। দিন গুনতে থাকে সবাক, কবে মালয়শিয়া যাবে। অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষে একদিন আরও ১৫ টা নানান বয়েসী বালকের সাথে উড়াল দিলো। কিন্তু বিমান গিয়ে থামলো চীনে। সবাকসহ ১৬ জনকে একটি শহর থেকে বলবো বাসে করে দূরে কোথায় নিয়ে একটি পাহাড়ী অঞ্চলে এক লোকের জিম্মায় রেখে ভদ্রলোক ১দিনের কথা বলে কোথায় যেন গেলেন। তখনও সবাক বুঝতে পারেনি, আসলে কি হচ্ছে। কিন্তু প্রায় ১০ দিন চলে যায় ভদ্রলোকের কোন খোজ নেই। একদিন পুলিশ এস হানা দিল। কি যেন কি ভেবে পুলিশে ধরনা না দিয়ে সবাক গেল পালিয়ে। বরাবর ১৫ দিন শুধু কলা খেয়ে এক বিশাল কলা বাগানে লুকিয়ে ছিলো সবাক। অবশেষে ধরা পড়লো বাগান মালিকের হাতে। কিন্তু লোকটি খুব ভালো। যদিও তার কোন কথায়ই বুঝতে পারে না সবাক। বোবার মতো থাকতো। এভাবে ২ মাস। আবারও সমস্যা, আবারও পুলিশ। এবারও পালিয়ে গেল সবাক। ভাগ্যিস পকেটে ছিলো ২০০০ আরএমবি/ইয়েন (চায়না মুদ্রা)। এবার মোটামুটি সুখেই যাচ্ছে। শহরে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টিয়ে পুরা মাইকেল হয়ে গেল। এবার আর পুলিশও সন্দেহ করে না। চলে এলো কুনমিং। হয়ে গেল রাত। এবার থাকবে কোথায়? হোটেলে থাকলেতো মহা সমস্যা। টাকা শেষ হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। তবে কি পথেই থাকবে? তাও করা যাবে না। কারণ পুলিশী ঝামেলা। তবুও পথেই পড়ে রইলো। রাস্তার পাশে একটি সেঞ্চুরী গাছের সাথে হেলান দিয়ে ভাবনায় মশগুল ছিলো তখন। হঠাৎ কানে এলো কিছু কথা। যার মর্মার্থ হলো " এক বাংলাদেশী গেষ্ট হাউজের জন্য আকটি বাংলাদেশী ছেলের দরকার"। বুদ্ধি করে সবাক গিয়ে তার আগ্রহের কথা জানালো এবং তার চীনের কাহিনীও বললো। ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন। ঠাঁই হলো এখানে, আমি তাকে যেখানে পেলাম।

আমি সেখানে ৩দিন ছিলাম। প্রতিরাতেই সে আমাকে গান শুনাতো। অসম্ভব সুন্দর তার গানের গলা। জীবনে এতো অবহেলা পেয়েও নষ্ট হয়ে যায়নি সবাক। তার জীবনের কথা শুনে আমি জগৎ সম্পর্কে ভিন্ন একটা ধারণা পেলাম। একটা মানুষ জানে না তার বাবা-মা কে? এবং সত্যিকার অর্থে তার কোন আত্মীয় এ পৃথিবীতে আছে কিনা, তাও সে জানে না। জন্ম পরিচয়হীণ একটি ছেলে পৃথিবীর বুকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে কি আপ্রান চেষ্টায় দিনানিপাত করছে।

আমি চীন থেকে চলে আসার প্রায় ২ মাস পরে তার মালিকের কাছে ফোন করে জানতে পারলাম সে আবার পালিয়েছে, কারণ পুলিশ টের পেয়ে গেছে। আমি তাকে বলেছিলাম বিয়ে করে ফেলতে, তাহলে হয়তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সে কেন যে করে নি?

চীনে পা রাখার আগে আমার জীবনটা একটা ছোট্ট গন্ডির মধ্যে ছিলো। চীনের সে ক'দিনে অনুভূতি ছিলো অন্যরকম। একেবারেই অন্যরকম। প্রচুর বাংলাদেশীর সাথে দেখা হলেও সবাকের জীবনের দর্শন আমাকে আলোড়িত করেছিলো। জীবনকে অনেকভাবে তার কাছে শিখেছি। হি ইজ এ্যা গ্রেট ম্যান। তখনকার মারাত্মক আবেগী আমি তার মাঝেই নিজেকে খুঁজতে শুরু করি। শত হতাশার মাঝেও আজ আমি সুখে থাকি, সামনে থাকে সবাকের অতীত বর্তমান।

সবাককে নিজের মাঝে ধারণ করার প্রয়াসেই সবাক নিকে ব্লগিং করা। সবাক কেমন আছে জানি না। সে তার মতো থাকুক।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১২ রাত ২:০৭
৬৮টি মন্তব্য ৬৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাটির কাছে যেতেই..

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

মাটির কাছে
যেতেই..


ছবি কৃতজ্ঞতাঃ https://pixabay.com/

ঠিক যেন
খা খা রোদ্দুর চারদিকে
চৈত্রের দাবদাহ দাবানলে
জ্বলে জ্বলে অঙ্গার ছাই ভস্ম
গোটা প্রান্তর
বন্ধ স্তব্ধ
পাখিদের আনাগোনাও

স্বপ্নবোনা মন আজ
উদাস মরুভূমি
মরা নদীর মত
স্রোতহীন নিস্তেজ-
আজ আর স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাকা ভাংতি করার মেশিন দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

চলুন আজকে একটা সমস্যার কথা বলি৷ একটা সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল৷ চাইলেই টাকা ভাংতি পাওয়া যেতো৷ এখন কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায়না৷ কারো হাতে অনেক খুচরা টাকা দেখছেন৷ তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেলা ব‌য়ে যায়

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩০


সূর্যটা বল‌ছে সকাল
অথছ আমার সন্ধ্যা
টের পেলামনা ক‌বে কখন
ফু‌টে‌ছে রজনীগন্ধ্যা।

বাতা‌সে ক‌বে মি‌লি‌য়ে গে‌ছে
গোলাপ গোলাপ গন্ধ
ছু‌টে‌ছি কেবল ছু‌টে‌ছি কোথায়?
পথ হা‌রি‌য়ে অন্ধ।

সূর্যটা কাল উঠ‌বে আবার
আবা‌রো হ‌বে সকাল
পাকা চু‌ল ধবল সকলি
দেখ‌ছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পর্ণআসক্ত সেকুলার ঢাবি অধ্যাপকের কি আর হিজাব পছন্দ হবে!

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৩ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:২৭



ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় অনুষ্ঠিত একটা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের একটা রোবোটিক্স টিম। এই খবর শেয়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। সেখানে কমেন্ট করে বসেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:১৪


কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
আমার বাবা-কাকারা সর্বমোট সাত ভাই, আর ফুফু দুইজন। সবমিলিয়ে নয়জন। একজন নাকি জন্মের পর মারা গিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমার পিতামহ কামেল লোক ছিলেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×