somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কৈলিক-সাংস্কৃতিক ভারসাম্য ও আমার লেখনপ্রয়াস (প্রথমার্ধ)

১২ ই জুন, ২০০৮ রাত ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জেতা মৎস্য গিলে বকে মনুষ্য খায় বাঘ-ভালুকে
রহস্য বোঝে না লোকে কেবল বলে জয়।

দীন দ্বিজদাস, জনপদাবলি, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত

জীবন মানে কেবল নিয়মিত আহার গ্রহণ, তদসাপেক্ষে বর্জ্যত্যাগ ও নিয়মিত প্রজনন ক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া নয়। এরকম স্থূল জীবনকে মহিমা দিতে রুচিতে বাধে। সূক্ষ্মতার ভিতর দিয়েই জীবন মহিমামণ্ডিত হয়ে ওঠে। যে জীবনে খাওয়া-পরা-ভোগের অধিক মগ্নতা নেই, সে জীবন আমাদের কাম্য নয়। সূক্ষ্মতার দিকে তাক করা এই যে প্রত্যাশিত জীবন, এরও অবশ্য গোপন এক নির্ভরতা আছে খাওয়া ক্রিয়াটার ওপর। একটা বয়সে, কৈশোরে, যখন প্রথম বুঝতে শিখেছিলাম যে, জীবজগৎ সচল থাকার মূলে রয়ে গেছে নিরবচ্ছিন্ন খাদ্যচক্রের ভিতর দিয়ে শক্তির স্থানান্তর প্রক্রিয়া, তখন হঠাৎই একটা পরিবর্তন টের পেয়েছিলাম দেহে-মনে। কেননা তখনই জানতে পেরেছিলাম যে সমস্ত সূক্ষ্মতাই স্থূলতা নির্ভর। কিন্তু বরাবরই খানাপিনারূপ স্থূলতা শিল্পের জগৎ থেকে কমবেশি নির্বাসিত থেকেছে। এই স্থূলতা নিয়ে একটিও সচেতন বাক্য রচনা করেন নি বা আঁচড় কাটেন নি অনেক লেখক-শিল্পী, যেমন রবীন্দ্রনাথ।

আমরা জানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানির মাধ্যমে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে গাছের সবুজ পাতার কোরোফিল গ্লুকোজ নামক চিনি উৎপাদন করে, যে চিনিশক্তি গাছের খাদ্য। গাছের পাতা খেয়ে সেখান থেকে শক্তি আহরণ করে ক্ষুদ্র পতঙ্গকুল। ওই পতঙ্গ যখন জলের উপরে ভাসে তখন কোনো ক্ষুদ্র মাছ তাকে টপ করে গিলে নেয়। ক্ষুদ্র মাছকে পরে খায় কোনো অপেক্ষাকৃত বড়ো মাছ। ওই বড়ো মাছ হয়ত পরে খাদ্য হয় কোনো বিশাল আকৃতির মাছের। কোনো মৎস্যশিকারির মধ্যস্থতায় বিশাল মাছটি ধৃত হয়ে চলে আসে মানুষের খাবার টেবিলে। এই মানুষই কখনোবা বাঘ-ভালুকের খাদ্য হয় কিংবা মাছের। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তার দেহটি মাটিতে মিশে যায়। বেঁচে থাকতে মানুষটি যত শক্তি সঞ্চয় করেছিল সব শুষে নেয় মাটি। শিকড়ের মাধ্যমে ওই শক্তি আবার শুষে নেয় বিভিন্ন গাছপালা। বাঁচার প্রয়োজনে গাছপালাও আবার যথারীতি গ্লুকোজ উৎপাদন করে।

এই চক্রটি পুরোপুরি উপলব্ধিতে আসার মাধ্যমে সহসাই আমার বোধবুদ্ধিটা একটা দার্শনিক পরিণতিতে চড়ে বসে যেন। প্রাকৃতিক সবকিছুর পরস্পর নির্ভরতা বিষয়ক এক গূঢ় সত্যের বিশাল দরজা যেন উন্মুক্ত হয়ে যায় আমার সামনে। ভাবনাচিন্তা বিশেষ একটা ব্যাপ্তি পায়। তাহলে ব্যাপার এই, যে, জীবমাত্রই অন্য কারো খাদ্যে পরিণত হবার জন্য নিজেও খাদ্যসন্ধানে ব্যাপৃত থাকে অহর্নিশি! সন্দেহ নেই যে, শুনতে অতিশয় স্থূল লাগে চক্রক্রমিক এই খাদ্যগীতি। এর পাশাপাশি সুকুমারবৃত্তি নামধেয় ব্যাপারস্যাপার, তথা শিল্পসাহিত্যসংগীতনৃত্যঅভিনয়-- এসব কি ওই খাদ্যকল্পেরই অন্য রূপারূপ তবে ? গুহাগাত্রে শিকারছবি এঁকে, বর্ণেশব্দে যাপনবিদ্যার তেলনুনছবি ধরে, কর্মের লাগোয়া সুরধুন তুলে, আহরণ মুদ্রায় শরীর বিক্ষেপণ করে, যাপনচর্যার বিবিধার্থক রূপায়ণ ছলে মানুষ আসলে কীসের প্রমাণ রক্ষা ও প্রলম্বিত করে এসেছে যুগ যুগ ধরে ? এসব কি এক অর্থে খাদ্য হয়ে ওঠা ও খাদ্য খুঁজে ফেরারই নন্দনতারিফ নয় ?

বিজ্ঞানীরা ইকোসিস্টেম বা প্রতিবেশ ব্যবস্থায় জড়-জড়, জীব-জীব এবং জড়-জীবের মধ্যকার অত্যাবশ্যক সম্পর্কের আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক সকল কিছুই পরস্পরের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয়। কিন্তু শিল্পসাহিত্যসংগীতনৃত্যঅভিনয় প্রাকৃতিক নয়, মনুষ্যসৃষ্ট। এসবে আশ্রিত যে কলার ধারণা তা জড়ও নয়, জীবও নয়। প্রতিবেশ ব্যবস্থায় এর স্থান তাহলে কোথায় ? এতদিন ধরে এর কোনো জবাবই আমার আয়ত্তে ছিল না। সম্প্রতি এর একটি সম্পর্কসূত্র বা বিহিত আমি খুঁজে পেয়েছি বলে মনে হয়, যখন বুঝতে শিখেছি যে, মানুষ তার বিস্তৃত পরিপার্শ্বে ক্রমশই তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর হয়ে উঠতে থাকে। মানুষের চারপাশের আপাত সীমিত যে পরিসর, যাকে মনে হয় যে এইই শেষ, এর সবটা জানা হলেই জানা হয়ে যাবে গোটাটা, তা আসলে ঠিক নয়। বস্তুত দিন দিনই পরিসরটি প্রসারিত হতে থাকে। যত দ্রুত জানাশোনার প্রসার ঘটে, তার চেয়ে দ্রুত প্রসারিত হয় নতুন নতুন পরিসর। তাতে কেবলই বোধ হতে থাকে যে, আমার জানাবোঝা অতিশয় তুচ্ছতর। তো, ওই তুচ্ছ আলোর প্রক্ষেপণে একান্ত যা ধরা পড়ে, তাতে মনে হয়, এই যত কলাকাণ্ড-- এরও নির্দিষ্ট ভোক্তাশ্রেণি থাকে, যারা এগুলো খায়। গলাধঃকরণ করে না বটে তবে খায়, উপভোগ করে। অন্যদের মতো কলাকার নিজেও একজন কলাভোক্তা। তাদের এগুলো আসকালসন্ধ্যার ভোগে লাগে। সেই আবার খাদ্য খুঁজে ফেরা, খাওয়া। খাওয়ার ভিতর দিয়ে জীবনীশক্তি, শৈলীপ্রণোদনা, জীবনসত্য ও আবিষ্কারোচ্ছ্বাস লাভ, অবলম্বন খুঁজে পেয়ে ঝুলে পড়া।

উলটোভাবে বিচিত্ররূপ কলারাও কলাকারকে খায়। অর্থাৎ কলাকারের নিজস্ব অনেককিছুর নিঃশর্ত সমর্পণের মাধ্যমেই কলা সৃজিত হয়, কলাবিদ্যা অর্জিত হয়। কলা একে একে কলাকারের সময় খায়, ঘুম খায়, স্বস্তি খায়, তৃপ্তি খায়, সম্পর্ক ও সামাজিকতা খায়, শান্তি খায় ; সবিশেষ দেহটা খায়, একেবারে খেয়ে ফেলে। যেমন কাব্যকলা খেয়েছে জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান, সাবদার সিদ্দিকী, ফাল্গুনী রায়, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, শামীম কবীর প্রমুখকে। কলা ও কলাকারের মধ্যকার এই সম্পর্ক জড়-জীব বা জীব-জড় বোধক। অনেকটা উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড চক্রের মতোই যেন। উদ্ভিদ অক্সিজেন দেবে প্রাণী নেবে, প্রাণী কার্বন-ডাই-অক্সাইড দেবে উদ্ভিদ নেবে। এই দেয়া-নেয়াই জীবনবায়ুর উদ্গাতা বোধকরি।

এটুকুই মাত্র আমার বিবেচনা, যে বিবেচনায় আমি বলতে চাই যে কলারও স্থান আছে খাদ্যচক্রে, অতএব ইকোসিস্টেমে। সকল কালের সকল কলার কাজেই অস্তিত্বশীল থাকতে হয়, নতুন নতুন কলাবস্তু ও কলাধারণা সৃজিত হতে হয়। তা না হলে তৈরি হয় ভারসাম্যহীনতার হাহাকার, যে ভারসাম্য কৈলিক ও সাংস্কৃতিক।

এহেন ভারসাম্য রক্ষার্থেই আমি কলাসৃজনে প্রবৃত্ত হই, লিখি-- আরো ভেঙে বললে জবাবটি অন্যরকম শোনাবে। সমস্ত বিস্তারণই কেননা আব্রুহীন, সমস্ত স্বচ্ছতাই কেননা রহস্যহীন। আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছি আমি, নানা ছুঁতোয়। দেখেছি যে, জবাব বারবার বদলে গেছে। একই সওয়ালের জবাবে একেক বয়সে দেখেছি একেক রকম উত্তরদান প্রয়াস। এখন মনে হয়-- আমার কিছু দৃশ্য, ঘটনা ও কার্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবার থাকে, যারা কারণসমূহের সাথে মিলিত হবার ইচ্ছেয় বহুকাল ধরে অপেক্ষায় আছে। আমার কিছু আনন্দ-বেদনা-ক্রোধ থাকে, যা সহস্রজনের আনন্দ-বেদনা-ক্রোধের থেকে আলাদা অথবা আলাদা নয়। যেসব বিষয়ে অনেকেই কোনোদিন কিছু ভেবে ওঠেন নি। আমার সবসময়ই কিছু কথা বানিয়ে বলবার থাকে, যা সত্যমিথ্যানিরপেক্ষ। লিখবার পরে প্রায়শ যেগুলোকে সত্যের পড়শির মতো মনে হয়। আমার কিছু তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করবার থাকে, যেদিকে মনোযোগদান প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্যে জরুরি বোধকরি। এছাড়াও যাপনযুদ্ধের বিভিন্ন পর্বে জড়-জড়, জীব-জীব এবং জড়-জীবের অনেক সম্পর্ক আমার কাছে নতুন করে প্রতিভাত হয়। ওই আবিষ্কারচিহ্নগুলো আমি ধরে রাখতে চাই, চিন্তার পরবর্তী পরম্পরার কথা ভেবে। আমার লেখনচেষ্টার নেপথ্যে সুপ্ত মূল কারণের বিভাজিত রূপ মূলত এই।

আমি না করলেও এই কাজগুলো অন্য কেউ হয়ত তার মতো করে করবেন। কিন্তু আমার মতো করে করা কেবল আমার পক্ষেই সম্ভব। দেখার ও লেখার প্রত্যেক লেখকেরই কমবেশি স্বতন্ত্র ভঙ্গি থাকে। থাকাটা জরুরিও। আমি দাবি করি যে, আমারও তা আছে। আর আছে বলেই ওই স্বাতন্ত্র্যটুকু বাংলা লেখন-বৈচিত্র্যের ভাণ্ডারে আমি যুক্ত করে যেতে চাই। তাতে বাংলাসাহিত্যের সমৃদ্ধি না এলেও বাংলা ভাষার সম্ভাবনাটি কিছু দৃষ্টান্ত লাভ করবে, নিঃসন্দেহে।

The Cross, by NorwegianAngel, from http://www.abstractdigitalartgallery.com/
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

EU বাংলাদেশ, আফ্রিকা ও আরবদের সাহায্য করার চেষ্টা করে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১০ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৩



EU বাংলাদেশকে বিবিধভাবে সাহায্য করে আসছে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে; বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে সচল করার জন্য সহযোগীতা করতে চায়। আমাদের দেশে ও আফ্রিকায় ভালো যা ঘটছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে কোকের আতারোট শিল্প অঞ্চলের কারখানা: ফিলিস্তিনি স্টেইটহুড, স্বনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে অসমম্মান করে।

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১০ ই জুন, ২০২৪ রাত ১১:১৭

কোকা-কোলার পূর্ব জেরুজালেমের আতারোট শিল্প অঞ্চলের কারখানাটিকে ঘিরে শুরু থেকেই তীব্র বিতর্ক আছে। এই এলাকাটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অধিকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিপক্ক প্রেম: মানসিক শান্তি

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১১ ই জুন, ২০২৪ রাত ২:৩০






জীবনের নির্দিষ্ট একটি সময়ে পৌঁছানোর পর, মানুষ যখন পরিপক্ক হয়ে ওঠে, তখন প্রেমের মাপকাঠি বদলে যায়। তখন আর কেউ প্রেমে পড়ার জন্য শুধু সৌন্দর্য, উচ্ছ্বলতা, কিংবা সুগঠিত দেহ খোঁজে না।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রবীন্দ্রনাথের শেষ কটা দিন কেমন কেটেছিল?

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১১ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১০:১১




১৯৪১ সালে জীবনের শেষ দিনগুলোয় অসুখে ভুগছিলেন কবি। সারা জীবন চিকিৎসকের কাঁচি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছেন, এবার বুঝি আর তা সম্ভব নয়। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

অশুদ্ধ বেনজীরের ‘শুদ্ধাচার’ পুরস্কারের কী হবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১১ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১১:১৭


যুক্তরাষ্ট্র যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেনজীর আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, এর সাড়ে ছয় মাস পর সরকার তাঁকে মহিমান্বিত করেছে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দিয়ে। সেই হিসেবে বেনজীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×