somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেব্রুয়ারি নিয়ে

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য জীবন দিতে হয়েছে এমনটি আর কোথাও নেই। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার তোমাদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা আর বুক ভরা ভালবাসা। তোমাদের ঋণ কোনোদিনও শোধ হবেনা।

"২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঘোষণা আসে পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পূর্ব ঘোষিত হরতাল। হারতাল প্রতিহত করতেই এই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকেই হরতাল সফল করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ করে সরকারের এ ঘোষণার কারণে ছাত্র নেতারা হতাশ হয়ে পড়েন। সে সময় তারা হরতাল বাতিল ও ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। রাত ১০টার দিকে এ সিদ্ধান্তের সংবাদ মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয়। একই সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ‘কর্মপরিষদের’ সদস্য নন এমন কয়েকজন নেতাকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, রাতেই তৎকালীন ঢাকা হলের পুকুরের পূর্বপাড়ের সিঁড়িতে জরুরি গোপন বৈঠক হবে।

রাত ১২টায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন: গাজীউল হক (আইনজীবী), হাবীবুর রহমান (বিচারপতি), মোহাম্মদ সুলতানা, এম আর আখতার মুকুল, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এস এ বারী এটি, সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন ও আনোয়ার হোসেন।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরের দিন আমতলায় সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন গাজীউল হক। যদি তিনি গ্রেপ্তার হন তবে সভাপতি হবেন এম আর আখতার মুকুল এবং তাকেও যদি গ্রেপ্তার করা হয় তবে সভাপতিত্ব করবেন কামরুদ্দীন শহুদ।

এসময় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, সভাপতি হিসেবে গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙার পে বক্তব্য রাখবেন এবং ১৪৪ ধারা ভাঙার পে সিদ্ধান্ত জানিয়ে সভার কাজ শেষ করবেন

২১ ফেব্রুয়ারি
২১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ১৯৫২ সাল। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে হরতাল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরদিন সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। শুধু বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামের মাঠটিতে সকাল থেকে কয়েক হাজার পুলিশ জমায়েত হতে থাকে। সঙ্গে থাকে পুলিশের স্পেশাল টিয়ার গ্যাস স্কোয়াড।

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট মিছিল এসে জমা হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে। তখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি। চারপাশের বিভিন্ন হলের ছাত্ররা ধীরে ধীরে জমায়েত হতে থাকে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দশ হাজার। চারিদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান। পুলিশ তাদের নিজস্ব অবস্থানে থেকে নির্দেশের জন্য অপোয় ছিল।

এসবের মধ্যেই গাজীউল হককে সভাপতি করে সভা শুরু হয়। প্রথমে বক্তব্য রাখেন সর্বদলীয় কর্মপরিষদের শামসুল হক, তিনি ১৪৪ ধারা না ভাঙার পে বক্তব্য রাখেন। যদিও তিনি বক্তব্যের শেষে আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। এরই মাঝে সংবাদ আসে, লালবাগ এলাকায় স্কুল শিক্ষার্থীদের একটি মিছিলের উপর পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ করেছে। ফলে উত্তেজনা তখন চরমে ওঠে। এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আবদুল মতিন এবং সভাপতি গাজীউল হক উভয়েই ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীতও হয়। চারদিক কাঁপিয়ে স্লোগান ওঠে ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানবো না’।

এই স্লোগান চলার সময় আবদুস সামাদ আজাদ কীভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে তার একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাবকে বলা হয় বিখ্যাত ‘১০ জনী মিছিল’। তার মতে, হাজার হাজার শিক্ষার্থী একত্রে মিছিলে নামলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই প্রতি দফায় তারা ১০ জন করে রাস্তায় মিছিল বের করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী এ বক্তব্য সমর্থন করেন এবং কলাভবনের গেট খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

এরপর শুরু হয় ছাত্রদের দশজনী মিছিল। প্রথম দলের নেতৃত্বে ছিলেন হাবীবুর রহমান (পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা)। দ্বিতীয় দলে আবদুস সামাদ আজাদ এবং ইব্রাহীম তাহা। তৃতীয় দলে আনোয়ারুল হক খান এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান। এই দশজনী মিছিলে যারা গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন তাদের তালিকা তৈরির দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান এবং কাজী আজহার। চতুর্থ দফায় মেয়েদের একটি মিছিল স্বেচ্ছায় কারাবরণের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে আসার পরপরই ছাত্রদের আরও অনেকগুলো মিছিল একের পর এক বের হয়ে আসতে শুরু করে।

এমন সময় আকস্মিকভাবে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ ও অবিরাম কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করতে শুরু করে। কাঁদুনে গ্যসের ধোয়ায় ছেয়ে যায় চারিদিক। ছাত্ররা দৌঁড়ে কলাভবনের পুকুরে এসে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছে আবার মিছিলে যোগ দেন। এমনি সময়ে একটি টিয়ারশেল সরাসরি গাজীউল হকের বুকে এসে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সে সময় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলায় মেয়েদের কমন রুমে রেখে আসা হয়। বেলা প্রায় ২টা পর্যন্ত কলা ভবন এলাকায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলতে থাকে।

তখন পর্যন্ত ঢাকার অন্যান্য স্থানে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একদিকে চলতে থাকে পুলিশের লাঠিচার্জ আর অন্যদিকে ছাত্রদের ইট-পাটকেল নিপে। এ পরিস্থিতিতে ছাত্ররা যাতায়াতের সুবিধার জন্য কলা ভবন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যবর্তী দেয়াল ভেঙে দেয়। ফলে কিছুণের মধ্যেই পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষের দিক পরিবর্তিত হয়। ছড়িয়ে পরে সংঘর্ষ চারিদিকে। এ সময় পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জে আহত হন বহু ছাত্র।

এমনই অবস্থায় কোনো রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই একদল সশস্ত্র পুলিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশির নির্দেশে দৌঁড়ে এসে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে ‘ওয়ালী ফায়ার’ করে। চারিদিকে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার ভেতর কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিছু তাজাপ্রাণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, অনেকে আহত হয়, বাকিরা বিপ্তি হয়ে পড়ে। তখন সময় বিকেল ৩টা ১০ মিনিট। আর দিনটি ২১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার।

একটি লাশের মাথার অর্ধেকটাই গুলিতে উড়ে যায়। পরে জানা যায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত। সে সময় পর্যন্ত ঘটনাস্থলে নিহতের সংখ্যা ছিল ২ এবং আহত ৯৬
সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে মারা যান আরও দুজন। এরা হলেন শহীদ জব্বার ও রফিক উদ্দিন।

২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে শহীদ হওয়া ৪ জনের মধ্যে তিনজন ছাত্র। এরা হলেন আবুল বরকত, জব্বার ও রফিক উদ্দিন। অপরজন শহীদ সালাম যিনি বাদামতলীর একটি প্রেসের কর্মচারী ছিলেন। ওই দিন এছাড়া রাস্তায় পড়ে থাকা আরও কিছু লাশ পুলিশ দ্রুত ট্রাকে করে নিয়ে যায়। যাদের পরিচয় আর জানা যায়নি।

উল্লেখ্য, আবদুস সালাম ২১ শে ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক মাসের অধিক সময় চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৫২ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি মারা।"

(লেখাটি এম আর আখতার মুকুল রচিত ‘একুশের দলিল’ বই থেকে সংকলিত)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×