somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টেলিভিশনের ভাষা //পারভেজ চৌধুরী

২৮ শে মে, ২০০৮ রাত ১২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বয়সের যে সময়ে অহর্নিশের কথা বলা শুরু করা উচিত সে বয়সে কথা বলে না। অজানা আশঙ্কায় মা-বাবা ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার পরীক্ষা করে কোনো কারণই খুঁজে পেলেন না শিশু অহর্নিশের বোল না ফোটার পক্ষে। বিষয়টা নিয়ে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেন ডাক্তার, চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিস্তর ঘাঁটাঘাটি করে কোনো কারণ খুঁজে পেলেনা । ডাক্তার মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন তাদের সন্তান খুব বেশি পরিমাণে টেলিভিশন দেখে কি-না? মা-বাবার উত্তর হ্যাঁ। ডাক্তারের প্রশ্ন তাদের বাসায় স্যাটেলাইট সংযোগ আছে কি-না? আবারও উত্তর হ্যাঁ। ডাক্তার কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে অহির্নিশের মা-বাবাকে জানালেন স্যাটেলাইট সংযোগ আপাতত বন্ধ করতে। মা-বাবার চোখ ছানাবড়া। ডাক্তার পাগল না কি? কথা না বলার সঙ্গে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সম্পর্ক কি? তবুও ডাক্তারের নির্দেশ মেনে নিয়ে বাসার স্যাটেলাইট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং বন্ধের মাস দেড়েকের মধ্যে অহর্নিশ কথা বলা শুরু করে। তারপর ডাক্তার যা বললেন তা চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুক্তির চেয়ে সমাজ বিজ্ঞানের যুক্তি অনেক জোড়ালো । তা’হলো স্যাটেলাইট টেলিভিশনের অনেক ভাষাভাষী চ্যানেলের কারণে শিশু অহর্নিশ দ্বিধান্বিত হয়ে যায় তার বলার ভাষা কোনোটি গ্রহণ করবে। সেজন্য সে কথা বলতে দেরি করছিল বাংলা ভাষায়। এতো গেল একজন শিশুর বেড়ে উঠায়, ভাষা বদলে দেয়ায় স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রভাব । স্যাটেলাইট টেলিভিশন কি বড়দের ভাষা বদলে দিচ্ছে না? আমুল পরিবর্তন আনছে না তরুণদের মননে-মেধায়? সমাজে? সংস্কৃতিতে? যাপিত জীবনে? প্রাত্যহিকতায়?
যে দিন থেকে টেলিভিশন আবিষ্কার হলো সে দিন থেকে সাধারণ মানুষের সামনে খুলে গেল অদেখা রূপ,রঙ,রসের পৃথিবী। বসার ঘরে ঢুকে পড়ল নিজস্ব ভাষাকে বদলে দেয়ার অন্য জানালা। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড ১৯২৩ সালে প্রথম টেলিভিশন-ছবি দূরে পাঠাতে সক্ষম হয় । আর-সেই থেকে বিজ্ঞজনরা বুঝতে পারছিলেন এখন থেকে শুরু হবে মানুষের ভাষা বদল।
১৯৪০ সালে বাণিজ্যিকভাবে টেলিভিশন চালু হয়। চালু হওয়ার দশ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫০ সালে টেলিভিশন স¤প্রচার ব্যবস্থা ছিল মাত্র ৫টি দেশে। ১৯৫৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭তে। ১৯৬০ সালে ৭০টির মতো দেশে। ১৯৭০ সালে ১০০টি ১৯৮০ সালে ১৫২টি দেশে। আর এখন? দ্য ইউনিভার্সেল আই-এর টিমোথি গ্রীনের বিখ্যাত উক্তি পৃথিবীতে এটোমিক বোমার পর সবচেয়ে বিপজ্জনক বস্তু হচ্ছে টেলিভিশন। বর্তমান পৃথিবীর এমন কোনো দেশ বাকি নেই যাদের বসার ঘরে, শোবার ঘরে কিংবা ক্লাবে, হোটেলে এই বিপজ্জনক বস্তুটি নেই । নেশা বান্ধব হিসেবে তাকে দেখতে হবে এবং দেখতেই হয়। কি কি দেখায় এই টেলিভিশন? দেখায় গোয়েবলস-এর সেই বিখ্যাত তত্ত্ব বারবার প্রচার করতে পারলে মিথ্যাও সত্য হয়ে ওঠে। দর্শকরা এর সত্যতা খুঁজে পান বিজ্ঞাপন প্রচারে। এখানেও কিন্তু নিরবে নিভৃতে ভাষা বদলে যাচ্ছে ভোগবাদী সমাজের। শুধু কি পণ্যবাদিতা কিংবা ভোগবাদীতার ভাষা? মনোভূমি দখলের ভাষা নেই? পণ্যভোগী সমাজের মন মানসিকতাকেও অন্য ভাষায় রূপান্তর করতে হবে। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর যখন কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের উদ্বোধন করছিলো তখন অদূরেই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হচ্ছিল। কিন্তু টিভির প্রথম সংবাদ বুলেটিনে তার ছিটেফোটারও উল্লেখ ছিল না সেন্সরশিপের সেই ভাষা বিটিভিতে এখনও অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশে ৯০ দশকের শুরুতে স্যাটেলাইট চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয় ধনবানদের ড্রইং রুমে নিছক বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। মিডিয়া গবেষক ডেভিড পেজ এবং উইলিয়াম ক্রলির স্যাটেলাইট ওভার সাউথ এশিয়া : ব্রডকাস্টিং, কালচার এ্যান্ড দ্য পাবলিক ইন্টারেস্ট গবেষনায় দেখিয়েছেন তৎকালীন সময়ে যে সব স্যাটেলাইট চ্যানেল ডিশ এ রিসিভ করা হত তার কোনো আইনগত বৈধতা ছিল না এবং রিশেপশন এর জন্য যেই সব ডিশ ব্যবহার করা হত তা আসত চোরাই পথে । প্রযুক্তির প্রতি অজ্ঞতা এবং অবজ্ঞা আমাদের দেশের শাসকবর্গের এই চরিত্র বিশ্ববিদিত। তারপর অবশ্য এর আইনগত বৈধতা পায়। বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের শুরুর দিকটা খুবই জননিন্দিত ছিল, কারণ স্যাটেলাইটকে মনেই করা হত আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন হিসেবে। ভিন্ন সংস্কৃতি গিলে খাবে স্ব-সংস্কৃতিকে ফলে নষ্ট হবে মূল্যবোধ, তারুণ্য হবে বিপথগামী। এসব প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ১৯৯২ সালে খুবই ছোট নেটওয়ার্ক নিয়ে যাত্রা শুরু ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রির। বিংশ শতকের শেষ দশকের শেষে শুরু হয় একুশে টেলিভিশন। বলা যায় বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্বর্ণ সময়। সোজা কথায় বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটা ফেনোমেনা বা যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে আলোড়ন ঘটে সমাজে, দেশে। নিরপেক্ষ সংবাদ, ভালো অনুষ্ঠানের জন্য মানুষ কত যে ক্ষুধার্ত ছিল তা প্রমাণিত হয়। সেই সময়ই শুধু ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রি নয় মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি বিকশিত হতে থাকে। একুশে বন্ধের পর আরো বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন। এখানে লক্ষণীয় একুশে টেলিভিশন কিন্তু পরবর্তী স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলোর ভাষা নির্ধারণ করে কিংবা নির্মান করে দিয়ে যায়। যদি এসব স্যাটেলাইট চ্যানেলের সামনে একুশের মডেল না থাকত তাহলে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলের ভাষা গিয়ে কোথায় দাঁড়াত এটা অনেক ভাবিয়ে তোলার বিষয়। বাংলাদেশের অনেক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বলে থাকেন, স্যাটেলাইট চ্যানেলের যুগে পৌঁছে টেলিভিশন আজ এক অন্ধকার রাজ্যে পা রেখেছে। একথা ঠিক নয়। স্যাটেলাইট হচ্ছে প্রযুক্তি, মাধ্যম। এটিকে গ্রহণ করে ব্যবহার করতে জানতে হবে কিংবা ব্যবহার করার ইচ্ছা থাকতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি, প্রয়োজন দূরে তাকানো। আমাদের দেশের শাসকবর্গের পশ্চাদপদ অনগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গি স্যাটেলাইট টেলিভিশনকে একমুখী করে ফেলেছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, তথ্য আজ অর্থের মতো বিনিময় ও বিপণনযোগ্য একটি মূল্যবান সম্পদ। যে কোনো তথ্যই মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। খবরের কাগজ দাম দিয়ে কিনতে হয়। টেলিভিশনে তুলনায় কম দাম দিতে হয় কিন্তু বেশি তথ্য পাওয়া যায়। আর টেলিভিশনের দর্শকের পত্রিকার পাঠকের মত স্বাক্ষর হতে হয় না। নোবেল জয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন মনে করেন তথ্য ব্যর্থতার সমস্যার কথা দুর্ভিক্ষের অন্যতম প্রধান কারণ ফলে ১৯৫৯-১৯৬১ এই তিন বছর চীনে তিন কোটি এবং ১৯৪৩-এর মে-জুন মাস থেকে ৬ মাসে বাংলার মন্নন্তরের ৩০লাখ মানুষ প্রাণ হারাল। স্যাটেলাইট টেলিভিশনকে নাগরিক বৃত্তে বন্দি করে রাখলে এই প্রযুক্তির যুগে প্রযুক্তির অপচয় ছাড়া আর কিছু নয় কিংবা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে একে ডিজিটাল ডিভাইড বলে চিহ্নিত করা উচিত।
জনসমাজে ব্যর্থ গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনকে হিজ মাস্টিার ভয়েজ ইডিয়ট বক্স মাউথ পিস কিংবা সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স বলেন। সময় বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, টেলিভিশন ব্যবহারের দিক ও বিষয় বদলাচ্ছে তা’ টেরেস্ট্রেরিয়াল হোক কিংবা স্যাটেলাইট হোক। টেলিভিশনের দিকবদল হচ্ছে, বদলাচ্ছে ভাষার। টেলিভিশন ক্রমশই সাদা দেয়াল হয়ে উঠছে । যে যা লিখবে তা ভাসবে টেলিভিশনের পর্দায়। টিমোথি গ্রীনের সেই বিপজ্জনক বস্তু আরো অন্যরকম বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। বেখট এর সেই কবিতার মত যার মর্মকথা হলো এক বন্দির দেয়ালে কপিং পেন্সিলে আঁচড়-কাটা লেনিন দীর্ঘজীবী হোন হঠাবার জন্য চুনকাম করা হলো। আবার ফুটে বেরোল লেখাগুলো । খোদাইকাররা ছুরি দিয়ে তুলে ফেলতে চাইল লেখাগুলো। কিন্তু কুঁদে উঠা লেখাটি তখনও গেল না। এখন তবে উড়িয়ে দাও গোটা দেয়ালটা।
প্রথম প্রকাশ: সাপ্তাহিক / ২২ মে ২০০৮ / বর্ষ ১ /সংখ্যা ১ / আত্মপ্রকাশ সংখ্যা / বিশেষ ক্রোড়পত্র
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০০৮ দুপুর ১:৫৯
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×