somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেয়াল

২৬ শে মে, ২০০৮ সকাল ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেয়াল
মূল : আর. কে. নারায়ণ;
অনুবাদ : লিজা শারমীন

কমিটির বিকালের মিটিং এ উপস্থিত হতে পারিনি, ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নয়। আহবায়ককে কথা দিয়েছিলাম, বেরও হয়েছিলাম ঠিকমত কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকতেই একজোড়া কাঠবিড়ালী আমার পথ আটকে দিল। ভাবছেন একজোড়া কাঠবিড়ালী কেমন করে একজন বয়স্ক লোকের পথ আটকে দেয়? ঘটনাটা কিন্তু মিথ্যে নয়।

জোড়াটিতে মায়ের সাথে ছিল ছোট দশদিন বয়সের বাচ্চা কাঠবিড়ালী। জীবনে দ্বিতীয়বারের মত সে বের হয়েছে মা’র সাথে। কি সুন্দর দেখতে! শরীরের তুলনায় কয়েকগুন লম্বা ফোলানো লেজ দুলিয়ে মার পিছু পিছু ছুটছে! রেজিস্ট্রার অফিসের ছাদের গর্তে তাদের বাস। বাসাতেই ফিরছিল তারা। কিন্তু ঝামেলা বাঁধাল উঁচু দেয়ালটা। বাচ্চাটি কিছুতেই দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে পারছিল না।

মা তার তরতর করে দেয়াল বেয়ে ইঁটের ফাঁক গলিয়ে পার হয়ে গেল। ছেলে কিছুতেই পারল না। মা ভেবেছিল বাচ্চা তার পিছু পিছু আসছে, কাজেই সে দেয়াল বেয়ে নেমেও পড়েছিল অন্য পাশে। এপাশে বেচারা বাচ্চা কিছুতেই দেয়াল টপকানোর বিদ্যা আয়ত্বে আনতে পারল না। সামনের পা’দুটো খাড়া দেয়ালে তুলে হাতরে হাতরে উপরে উঠার কায়দা বের করতে লাগল।

ক্লান্ত হয়ে ভাবল এমন যদি কিছু ঘটত, সে চোখ বন্ধ করল; চোখ খুলে দেখল সে ওপাশে! চিন্তাটি তার নেহায়েৎ অবাস্তব, চোখ খুলল কিন্তু পড়ে রইল দেয়ালের এপারেই। মা ফিরে এসে লেজ নাড়িয়ে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। বিড় বিড় করে বলল, এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছ? বাচ্চাটি বলল, আমি তোমার মত উঠতে পারছি না। তুমি কেমন তরতর করে উপরে উঠে গেলে! আমি কিছুতেই তোমার মত পারছি না।

মা কাঠবিড়ালী নীচে নেমে এল। ঠান্ডা মাথায় বলল, আমার মত করে চেষ্টা কর। দেখনা, দেয়ালটাতো তেমন বেশী উঁচু না। ভাল করে চেষ্টা কর। দেখো, আমরা বাড়ি পৌঁছে যাব। এই বলে আবার দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে মা’টি অদৃশ্য হয়ে গেল। বাচ্চাটি মাকে অনুসরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। গায়ে ধূলা মাটি লেগে একাকার হয়ে গেল; কিন্তু সে একফুটও উপরে উঠতে পারল না।

মা’টি যেন বাচ্চার এ কান্ড বিশ্বাসই করতে পারল না। আবারও ফিরে এসে বলল, বাড়ি যাবে না? সন্ধ্যে হয়ে আসছে। বাচ্চাটিকে মা তার দুশ্চিন্তা কিছুতেই বুঝতে দিতে চাইল না। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে; তার আগেই তাদের বাড়ি পৌঁছাতে হবে। আবারও নেমে এসে বাচ্চার কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে সাহস দিল। বলল, গভীরভাবে একটা শ্বাস নাও, এবার শুরু কর। দশ কদম পিছাও।

বাচ্চাটি গভীর মনযোগ দিয়ে মার কথা শুনল; মাকে অনুসরণ করল। এখন আমার মত করে দৌড় দাওঃ বলেই মা’টি আবারও দেয়াল পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাচ্চাটি পদে পদে সব কথা মেনেও এক ইট উপরে উঠতে পারল না।

মনে মনে ভাবল, মা নিশ্চয়ই আবার নেমে আসবে; আরও উপদেশ দেবে। ইতিমধ্যে সে বেশ কান্তও হয়ে পড়েছে। মা’র ফিরে আসার শব্দ পেয়েও তাই উপরের দিকে তাকল না। মা’টি চিৎকার করে বলল, রাতে কি এখানেই থাকবে? বাচ্চা না তাকিয়েই বলল, আমি পারছি না। আমাকে এখানেই থাকতে হবে।

মা’টি এবার প্রমাদ গুনল, সন্ধ্যা পড়ে এসেছে। পেঁচার ডাক ভেসে আসছে। অচেনা ভয়ংকর পাখি, বাঁদুর ঘোরাঘুরি করছে, কাকেরা বাসায় ফিরছে, সময়টা মোটেই নিরাপদ নয়। মা’টি দেয়ালের কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে রইল যেন কারো চোখে না পড়ে। বাচ্চা ও মায়ের গায়ে লেপ্টে রইল ।

মা কঠিন স্বরে বলল, এটাই কিন্তু সমাধান নয় বাছা; তোমাকে চেষ্টা করতে হবে। আমি জানি তুমি পারবেই। দেখনা, কত সহজ। পা কয়েক পিছিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে যাবে।বাচ্চাটি পিছিয়ে গেল। মা বলল, সোজা এগিয়ে আস, অবশ্যই পারবে তুমি। পারছ না শুধু আত্মবিশ্বাসের অভাবে। আসঃ দেখঃ এমন করেঃ লাফ দাওঃ।

বেচারা অনেকক্ষণ প্রাণপণে চেষ্টা করল, অন্তত: দশ-বার বার, কিন্তু একচুলও উপরে উঠতে পারল না। মা বিরক্ত হয়ে ছেলের কান মলে দিল। রেগে বলল, কি হল তোমার, এতক্ষণে মার মেজাজও বিগড়ে গেছে। বাচ্চাটি ছলছল চোখে বলল, আমাকে ফেলে যেও না মাঃ।

মা বলল আমি যেতে চাই না, কিন্তু আমাদের এখানে থাকা মোটেই উচিত নয়। তারা আরও কয়েক বার চেষ্টা করল। কান্তিকর ব্যর্থ চেষ্টা। মা বলল, আমি আর কিছুতেই তোমাকে নিয়ে গর্বিত হতে পারছি না। তোমার বয়সে আমরাঃ।

মাকে পাশে পেয়ে বাচ্চা যেন প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে এল। অকারণে সে লাফঝাঁপ দিতে লাগল। ডিগবাজি দিয়ে আছড়ে পড়ল মায়ের উপর । তার আনন্দ দেখে মনে হলো পরিস্থিতির ভয়াবহতা অবুঝ ছানাটি আঁচও করতে পারছে না। সে বুঝতেও পারছে না তাকে পাল্লা দিতে হবে সময়ের সাথে। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে।

মা চিন্তিত গলায় বলল, আমাদের এখানে থাকা মোটেই আর উচিত হবে না। দুষ্টু ছেলের দল মাঠ থেকে নেমে আসছেঃ এসেই ঢিল ছুড়তে শুরু করবে। কুকুরের আওয়াজ পাচ্ছ না? পৃথিবীটা মোটেই নিরাপদ নয়। আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। উঠ, চল, আবার চেষ্টা করো।

মা আবারও নির্দেশনা দিতে লাগল। তিন চার বার চেষ্টা করার পর সে বিরক্ত হয়ে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গেল। বাচ্চাটি কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে ঝিমিয়ে পড়ল। উপর থেকে মা বলল, তুমি তাহলে আসছ না? বাচ্চা দায়িত্বহীনের মত আদুরে গলায় বলল, যদি তুমি সে দিনের মত মুখে করে পার করে না দাও আমি কিছুতেই উপরে আসতে পারব না।

-সে দিন আর আজ এক নয়। তুমি সেদিনের মত ছোট থাকলে কামড় দিয়ে ধরে পার করে নিতাম- তোমার পরামর্শের অপেক্ষায় থাকতাম না।
-তাহলে আমি বোধ হয় পারবই না। আমি আসছি না।
-বোকার মত কথা বল না। তুমি জান না, তুমি কোথায় থাকতে চাচ্ছ। সারাটা পৃথিবী ঝিমিয়ে আসছে, শুধু আমরা জেগে আছি। শত্রুরা সব ধেয়ে আসছে; চলে এস।

-আমি পারছি না। দেখছ না?
মা পুরো বাক্য শুনলও না। ইঁটের ফাঁক গলিয়ে অন্ধকারে নেমে গেল।

যেতে যেতে বলল, উপরে একজন আছেন, তোমার ভাগ্যে যদি আগামীকাল দেখার কথা লিখা থাকে তবে তুমি নিশ্চয়ই দেখবে। আমি বা অন্য কেউই তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না।

দূরু দূরু বুকে সে মায়ের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ঘন কালো অন্ধকার। প্রচন্ড ভয় পেল, ভয়ে কুকড়ে গেল, গর্তে ফেরার প্রানপণ চেষ্টা করল। মা’র শেখানো কৌশল রপ্ত করতে চাইল। কিছুতেই কিছু হল না। হতাশ ছোট দেহটি মাটিতে নেতিয়ে পড়ল। আমি মনে মনে ভাবলাম এর পরের কোন এক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব যেন এসব দেয়ালে ফাঁকের সংখ্যা অবশ্যই বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

আমার খুবই মন খারাপ হল। কোনভাবে ছানাটিকে সাহায্য করতে ইচ্ছা করল। এগিয়ে আসতেই দেখলাম এই ভয়াবহ বিপদ তারও বুদ্ধি খুলে দিয়েছে। হঠাতই সে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মাঝারি একটা গাছে উঠে পড়েছে। উপরে উঠে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে! মা মা করে দু’বার চিৎকারও ভেসে এল কিন্তু নিরুপায় মায়ের দিক থেকে কোন আওয়াজই আর পাওয়া গেল না।

ঘড়িতে সময় দেখলাম। মা-বাচ্চার এই উপাখ্যান আমাকে ঠিক সোয়া একঘন্টা আটকে রেখেছে।
পরের দিন আহবায়ক সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, আপনি আবারও আমাদের হতাশ করলেন।

আসলে সম্ভব হয়ে উঠল না আমি প্রচলিত প্রথায় জবাব দিলাম আসলে অনাকাংখিত ভাবেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

সংগ্রহকৃতঃ


৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জেন্ডার ও সেক্স

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৪ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৫২

প্রথমে দুইটা সত্যি ঘটনা শেয়ার করি।

২০২২ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে জেলা পর্যায়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মৌখিক পরীক্ষার ঘটনা। দুজন নারী প্রার্থী। দুজনই দেশের নামকরা পাবলিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামীলীগে শুধুমাত্র একটি পদ আছে, উহা সভাপতি পদ!

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৪ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪১


বাঙ্গালীদের সবচেয়ে বড়, পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দলটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে। মানুষ এই দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে। ৭০ এর নির্বাচনে এই দলটিকে নিরঙ্কুশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমপি আনারের মৃত্যু এবং মানুষের উষ্মা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:২৯


সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পর আনোয়ারুল আজীম আনার নামে একজন বাংলাদেশি এমপি নিখোঁজ এবং পরবর্তীতে তাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহের হাড়-মাংস আলাদা করে হাপিত্যেশ করে দেওয়া হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

দোয়া ও ক্রিকেট

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৪


দোয়া যদি আমরাই করি
তোমরা তাইলে করবা কি?
বোর্ডের চেয়ারম্যান, নির্বাচকের
দুইপায়েতে মাখাও ঘি।

খেলা হচ্ছে খেলার জায়গা
দোয়ায় যদি হইত কাম।
সৌদিআরব সব খেলাতে
জিতে দেখাইত তাদের নাম।

শাহাবুদ্দিন শুভ ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বকুল ফুল

লিখেছেন নীল মনি, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৪

বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে আমার এই ঘর। আমি মাটির ঘরে থাকি। এই ঘরের পেছন দিকটায় মা'য়ের হাতে লাগানো বকুল ফুলের গাছ৷ কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এই ফুলকে ঘিরে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×