somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাপানী সাহিত্যের শ্রেষ্ট গল্প সমূহের বাংলা অনুবাদঃ হায়াৎ মামুদ

১১ ই মে, ২০০৮ রাত ১০:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলার সঙ্গে জাপানের সেতুবন্ধন হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ-ওকাকুরার হাত ধরে। যে মৈত্রীর পরিচয় বহন করছে রবীন্দ্রনাথের জাপান যাত্রী গ্রন্থ্ স্বদেশী যুগে, বাঙারির আত্মানুসন্ধণের কালে। তার পর-পরাধীন, আত্মবিস্মৃত, হীনম্মন্য জাতির ভাগ্যে যা ঘটে আমাদের েেত্রও তাই ঘটেছে। এশিয়ার খোজ কমই রেখেছি, পিছু পিছু দৌড়েছি পশ্চিমের। এর ফলে প্রতিবেশীকে চেনা হয়ে উঠল না, আবার দূরের বন্ধুকে ও কাছে টানা গেল না। এশিয়া ও আফ্রিকার দিকে যে আমাদের চোখ ক্রমশ পড়ছে, এ মানসিক সুস্থিরতা ও আত্মপ্রত্যয়েরই লণ। সাহিত্যের ভিতর দিয়েই কোনো জাতি ও তার সংস্কৃতিকে চেনা যায়। জাপানি সাহিত্যের প্রতি আমাদের সা¤প্রতিক মনোযোগ বিস্মৃত প্রাচীন আত্মীয়তাকে শ্রদ্ধা ও মান্য করাই বহিঃপ্রকাশ। বর্তমান অনুবাদগল্পটি স্বল্পায়তনে আধুনিক জাপানি ছোটগল্পের প্রতিনিধিপ্রতিম, বলা চলে। গল্পটি জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত জলের ভিতরে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানী গল্প সংকলনে প্রকাশিত।

ডালিম গাছ
কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি

রাত্রে খুব ঝড়ো হাওয়া দিয়েছিল। তাতে ডালিম গাছটার সমস্ত পাতা খসে পড়ে একেবারে ন্যাড়া হয়ে গেল।
গাছের গুঁড়ির কাছে গোল হয়ে ঝরা পাতাগুলো জমে ছিল।
সকালবেলায় ন্যাড়া গাছটা দেখে কিমিকো ভারি অবাক হয়ে যায়। আরো তাজ্জব হল সে এই ভেবে যে গাছটার গোড়ায় এমন গোলাকার বৃত্তে পাতাগুলো ঠিকঠাকভাবে আছে কি করে! মেয়েটির স্বাভাবিকভাবে মনে হয়েছিল, বাতাসে তো সব এলোমেলো হয়ে যাবার কথা।
নিষ্পত্র বৃে একটি মাত্র ডালিম ঝুলে ছিল। ভারি সুন্দর দেখতে।
মেয়েটি তার মাকে ডাকতে থাকে, “মা, জলদি এস, দেখে যাও কি কান্ড হয়েছে।”
“আমি ভুলে গিয়েছিলাম।” কিমিকোর মা একবার তাকিয়ে দেখে গাছটাকে, তারপর ফের হেঁশেলে গিয়ে ঢোকে।
এই ঘটনাটা কিমিকোকে তাদের একাকীত্ব সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করল। বারান্দার ওপরে এসে-পড়া ডাল থেকে ঝুলন্ত ডালিমকেও তার মনে হল নিঃসঙ্গ, বিসর্জিত।
সপ্তহ দুয়েক হবে তার সাত বছরের ভাইপো বেড়াতে এসে সঙ্গে সঙ্গে ডালিমগুলো দেখতে পেয়েছিল। বুক ঘষটে ঘষটে গাছটায় সে চড়ে বসেছিল। কিমিকোর তখন মনে হয়েছিল যে নিজে যেন জীবনরসে পরিবৃত হয়ে আছে।
বারান্দা থেকেই সে চেচিঁয়ে উঠছিল, “দ্যাখ, দ্যাখ, ঐ যে আরেকটু ওপরে, বেশ বড়োসড়ো একটা ---।”
“কিন্তু ওটা ছিড়লে আমি নিচে নামবো কি করে?”
সত্যিই তো! দুটো হাতেই যদি ডালিম ধরা থাকে তাহলে গাছ থেকে নামা সহজ ব্যাপার নয়। হেসেছিল কিমিকো। ছেলেটা ভারি মিষ্টি।
ভাইপোটি যদ্দিন আসেনি তদ্দিন ওরা সবাই ডালিমের কথা ভুলেই গিয়েছিল। সে চলে যাবার পরেও এই কিছুন আগে পর্যন্ত তারা তা ভুলেই ছিল।
এ ছাড়া, ফলটা পাতার আড়ালে ঢাকা পড়ের্ছিল বটে। এখন ওটাকে আকাশের পটভুমিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ঐ ফলের ভিতরে, এবং গুড়ির কাছে বৃত্তাকারে সঞ্চিত পাতাগুলোর ভিতরে, শক্তি জমে আছে। কিমিকো কাছে গিয়ে বাঁশের লগি দিয়ে ডালিমটা পাড়ল।
পেকে এমন টৈটম্বুর হয়ে আছে যে এুণি যেন খোসা ফেটে দানাগুলো বেরিয়ে পড়বে। বারান্দার উপরে কিমিকো ওটারে রেখে দিল রোদ পড়ে কেমন চক চক করতে লাগলো, মনে হল সূর্য যেন ঢুকে পড়েছে ওর মধ্যে।
কিমিকোর মনে হল - না, পেড়ে সে ভালো করে নি। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।
বেলা দশটার দিকে দোতলায় সে সেলাইকল নিয়ে ব্যস্ত, এমন সময় কেইকিচি গলা শুনতে পেল সে। সদর দরজায় যদিও খিল লাগানো ছিল না, তবু মনে হল-কেইকিচি বাগানের দিকে এসে ডাকছে। তার গলায় উৎকন্ঠা।
“কিমিকো, কিমিকো! “মা ডেকে উঠে, কেইকিচি এসেছে, দ্যাখ।”
কিমিকো তার হাতের সুচটায় আর সুতো পরালো না, পিন-কুশনে গেঁথে রেখে উঁঠে পড়ল।
“কিমিকো বলছিল তোমার যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চায় সে।” কিইকিচি যুদ্ধে যাচ্ছে। “কিন্তু না - বললে আমরাই-বা কি করে যাই তোমার ওখানে! অথচ তুমি সেই যে গেলেতো গেলেই, আসার আর নামটি নেই। যাক আজ যে এসেছ-খুব ভালো হয়েছে।”
কিমিকোর মা তাকে দুপরে খেয়ে যেতে বলল। কিন্তু তাড়া ছিল কেইকিচির, তাই সে থাকতে পারলো না।
“কি আর করা! ঠিক আছে, এই ডালিমটা অন্তত নিয়ে যাও। আমাদের গাছে ধরে ছিল।” কিমিকোকে তার মা ফের ডাকতে থাকে।
মেয়েটিকে দৃষ্টি দিয়ে অভিবাদন জানালাম কেইকিচি, যেন ওর নিচে নেমে আসার অপোয় দাঁড়িয়ে থাকতে পেয়ে ধন্য হয়ে গেছে সে। কিমিকো সিড়িঁর ওপরে থমকে দঁড়ালো।
এমনি সময় হঠাৎ গরম কিছু একটা যেন কেইকিচির চোখে এসে পড়ল। ডালিমটা খসে পড়ে তার হাত থেকে।
ওরা দু’জনে একে অন্যের পানে তাকিয়ে হাসল।
সে নিজে হাসছে বুঝতে পারা মাত্রই কিমিকো লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল।
কেইকিচি বারান্দা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
“কিমিকো, শরীরের যতœ নিও।”
“তুমিও নিও।”
ততনে কেইকিচি চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কিমিকোর মা’র কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে।
ও চলে গেল বাগানের গেটের দিকে অনেন ধরে তাকিয়ে রইল কিমিকো।
“খুব তাড়া ছিল বেচারির”, তার মা বলে ওঠে। “ আর, ডালিমটা কি সুন্দর, দ্যাখ!”

কেইকিচি ডালিম বারান্দায় ফেলে রেখে চলে গেছে।
বাহ্যত, ডালিমটা তার হাত থেকে খসে পড়েছিল; কারণ, গরম কী যেন একটা তার চোখে গিয়ে পড়েছিল ঠিক তখনই যখন সে ঐ ডালিমটা ভাঙতে যাচ্ছিল। ভেঙ্গে অবশ্য দু’টুকরো সে করে নি। ফলটা তার ভিতরে দানা বের করে পড়ে ছিল মাটিতে।
মা সেটাকে তুলে নিয়ে হেঁশেলে ঢুকে প্রথম পানি দিয়ে ধুল, তারপর কিমিকোর হাতে তুলে দিল।
মেয়ের ভুরু কুঁচকে উঠল তাতে, একটু যেন পিছন হটল সে, তারপর আরেক বার রাঙা হয়ে দ্বিধান্নিত মনে মা’র হাত থেকে ডালিমটা নিল।
মনে হচ্ছে, কিইকিচি ধারের কয়েকটি দানা নিয়ে গেছে।
সে দেখল, মা তার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। এখন ডালিমের দানাগুলো যদি সে মুখে না দেয় তো ভারি অদ্ভুত দেখাবে। উদাসীন ভাবে কিমিকো কয়েকটা দানা মুখে পুরল। অম্লস্বাদে মুখ ভরে গেল তার। বিষন্নতার ছোঁয়া-লাগা এক ধরনের সুখ অনুভব করল সে, যেন সেটা বুক চুঁইয়ে ধীরে ধীরে তার ভিতর দিয়ে নেমে যাচ্ছে।
নিরুৎসাহ ভঙ্গিতে কিমিকোর মা তখনো দাঁড়িয়ে আছে।
কিমিকো ঘরের ভিতরে গিয়ে আয়নার সামনে বসে পড়ে। “ঈশ, চুলের অবস্থা হয়েছে কি! এই উস্কখুস্ক চুল নিয়ে কিনা আমি কেইকিচিকে বিদায় দিলাম!”
কিমিকো যেন চিরুনির কথা শুনতে পেল।
“তোর বাবা যেদিন মারা গেল”, নরম গলায় মা তাকে বলেছিল, চুল আঁচড়াতে ভয় পেয়েছিলাম আমি। যখন চুলে চিরুনি চালিয়েছি তখন খেয়াল হয় নি আমি কি করছি। সম্বিত ফিরতে মনে হয়েছিল যে তোর বাবা অপো করে আছে কখন আঁচড়ান শেষ করি।”
কিমিকোর মনে পড়ে যায়, বাবার পাতের এঁটো খাওয়া মা পছন্দ করত। তার বোধ হল ভিতর থেকে কেউ যেন কিসে টান দিচ্ছে, এ এমন এক সুখের অনুভুতি যে কান্না পাচ্ছে তার।
কিমিকোর মা কিমিকো কে ডালিমটা দিয়েছিল সম্ভবত এজন্যেই যে, ছুঁড়ে ফেলে দিতে তার মন চায় নি। হ্যাঁ, এটাই কারণ। কোন কিছু ফেলে দেওয়া তার ধাতে ছিল না।
নিজের একান্ত গোপন সুখ নিয়ে মা’র সামনে দাড়াঁতে কেমন লজ্জা লাগছিল কিমিকোর।
তার মনে হল, কেইকিচি যেমনটি চেয়েছিল তার চাইতে এরকমের বিদায় দেওয়াটাই বরং অনেক ভালো হল, আর এখন সে যে-কোন দীর্ঘ সময়ের জন্যেই কেইকিচির ফিরে না-আসা পর্যন্ত অপো করে যেতে পারে।
মা’র দিকে চোখ তুলে তাকায় কিমিকো। আয়নার সামনে বসে আছে কিমিকো, পিছন পানের দরজায় রোদ এসে পড়ছিল।
কোলের ওপরে ফেলে-রাখা ডালিমটায় দাঁত বসাতে তার ভয়-ভয় করতে লাগল।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×