somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবন্ধ

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



**** জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লোকজীবনের চিত্র....................


বাংলা কাব্যের প্রকৃতি যখন পল্লীর ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল তখন দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির ন্যায় জসীমউদ্দীনের (১৯০৩ -১৯৭৬)কাব্যআমাদেরকে পল্লীর মাধুর্যময় রূপের দিকে মুখ ফিরিয়ে দিয়েছেন। শিল্পী তাঁর যুগ জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত,সকল জটিলতা পরিহার করে বাংলা কাব্যের শেকড়ের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করলেন।
পুরাতন পল্লীগীতি ও গাথার রাজ্য থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে ,পল্লীর অপোকৃত নিস্তরঙ্গ সাধারণ মানুষের জীবনের অপূর্ব মাধুর্য থেকেই তিনি কাব্য মহিমা দান করে বিষ্ময়ের সৃষ্টি করলেন। গেঁয়ো বাতাসের মতই তাঁর কাব্যের আবেদন। তাঁর লেখনীর জাদুস্পর্শে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুখ,হাসি-কান্না,আনন্দ বেদনা,সামাজিক সংঘর্ষ,সা¤প্রদায়িকতা ওঅসা¤প্রদায়িকতা,শাসন ও শোষণের জীবন্ত হয়ে উঠেছে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে।
তাঁর সাহিত্যকর্ম কবিতাগুলোকে আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি।
যথা:
ক. খণ্ড কাব্য
খ.কাহিনী কাব্য
খণ্ডকাব্যগুলো হল: রাখালী (১৯২৭),বালুচর (১৯৩০),ধানতে (১৯৩২) রূপবতী (১৯৪৬),মাটির কান্না (১৯৫১) হলুদ বরণী (১৯৫৬), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৭২),মাগো জালিয়ে রাখিস আলো (১৯৭৬), হাসু (১৯৩৮), এক পয়সার বাঁশী (১৯৪৯) প্রভৃতি।
কাহিনীকাব্যগুলো হল: নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩),সকিনা (১৯৫৯), মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)প্রভৃতি।
সোজন বাদিয়ার ঘাট তাঁর একটি শ্রেষ্ঠ কাহিনী কাব্য। এই কাব্যের মাধ্যমেই কবি বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন। উপন্যাসোচিত শিল্প নৈপুন্য এবং সমাজ বাস্তবতার নিখঁত দলিলে কাব্যখানি শ্রীমণ্ডিত ও সার্থক।
শিমুলতলী গ্রামে হিন্দু ও মুসলমানের দীর্ঘ দিনের বসবাস। সৌজন্য ও স¤প্রীতিতে তাদের জীবন বহমান। গ্রামের গদাই নমুর মেয়ে দুলী ও ছমির শেখের ছেলে সোজন আবাল্য খেলার সাথী। সারা পাড়াময় তাদের কৈশোরের লীলাস্থল। কবে কখন যে তাদের শরীর মনে যৌবনের গেরস্থালী শুরু হয় তা তারা জানে না। মহরমের উৎসবকে কেন্দ্র কের শুরু হয় হিন্দু মুসলিম সংঘাত। ধীরে ধীরে শিমুলতলী মুসলিম শূন্য হয়। দুলির বিয়ে ঠিক করে তার বাবা অন্য ছেলের সাথে। কিন্তু দুলী বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে সোজনের সাথে ঘর বাঁধে গড়াই নদীর তীরে। অপহরণের মামলা হয় সোজনর নামে। মামলার রায়ে সোজনের সাত বছরের জেল হয়। দুলীকে এনে বিয়ে দেয় ধনাঢ্য কালাচাঁদের সাথে। জেলমুক্ত সোজন ঘরে না ফেরে দুলীর খোঁজে বেদের নৌকায় দেশে দেশে ফেরে। হঠাৎ সোজন দুলীকে খঁজে পায়। দুলী তার সাথে রূঢ় আচরণ করে। ফলে সে জ্বালা মিটাতে বিষলরে বড়ি খেয়ে গভীর রাতে নদীর ঘাটে বাঁশীর সুর তোলে। দুলী বাঁশীর সুর শুনে পাগল হয়ে ছুটে আসে। সেও সোজনের মত আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তাদেও মিলন হয় মৃত্যুর পরপারে।

সামান্য এ কাহিনী কবির উপমা রূপক উৎপ্রো,সমাজ বাস্তবতা,কাহিনী বিন্যাস,যথাযথ চরিত্রায়ণ তথা সর্বৈব শিল্পসফলতা পেয়েছে।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে কাবি নায়িকা দুলীর রূপ বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত সুনিপুনভাবে।

ধানের আগায় ধানের ছড়া তাহার পরে টিয়া
নমুর মেয়ের গায়ের ঝলক সেই না রঙ দিয়া।
অন্যত্র তিনি আরও বলেন Ñ
যে পথ দিয়ে যায় চলে সে যে পথ দিয়ে আসে।
সে পথ দিয়ে মেঘ চলে যায় বিজলী বরণ হাসে।
কবি জসীমউদ্দীন যেভাবে দুলীর রূপ বর্ণনা করেছেন তেমনিভাবে সোজনের রূপ বর্ণনা করতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই। যেমন Ñ
‘ছমির শেখের ভাজন বেটা বাবরী মাথায় ঘেরা।’
তিনি অন্যত্র আরও বলেনÑ
বাঁশের পাতায় নথ গড়ায়ে গাবের গাথি হার।
অনেক কালই জয় করেছে শিশু মনটি তার।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে মদন লাঠিয়ালের হাত হতে কেউ লাঠি ছিনিয়ে নিতে না পারলেও মহরমের লাঠিখেলায় সোজন তা পেরেছে। মদন খুশি হয়ে তাকে বলেছেÑ
সেই লাঠি যে কাড়লে তুমি, আজকে আমার ইচ্ছে করে
আকাশ জমিন বেড়িয়ে নাচি,তোমায় আমি মাথায় করে।
সোজন ও দুলীর বাল্যকালের খেলার চিত্র নির্র্মাণে কবি সহজ সরল গ্রাম্য উপকরণ ব্যবহার করেছেন। সারা গ্রাম তার ঘুরে বেরিয়েছে চপলমতি হরিণ হরিণীর ন্যায় খেলা করে।
“ বলেছি তো সকল কাজেই সোজন তাহার জুড়ি
হাজার খেলার ফন্দি আঁটে সারাটি গাঁও ঘুরি।”
তাদের সম্পর্কে কবি চমৎকার আবেগী ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
সোজনের সাথে তার ভারী ভাব,পথে যদি দেখা হয়
যেন রাঙা ঘুড়ি আকাশে উড়াল, হেন তার মনে লয়।
জসীমউদ্দীনের কাব্যের আদ্যন্ত গ্রামীণ উপকরণে সমৃদ্ধ। মনের মাধুরি মিশিয়ে তিনি যেন সে ছবি এঁকেছেন।
পাখি: টিয়া, কবুতর, ডাহুক, বুলবুলি, শালিক, মোরগ-মুরগী ইত্যাদি।
পশু: বিড়াল,কুকুর, বাঘ, সাপ, সিংহ, গরু, মহিষ, ছাগল, শেয়াল ইত্যাদি।
মারামারির উপকরণ: লাঠি, সড়কি, ঢাল, রাম দা, ধনুক, বর্ষা, তীর, বল্লম ইত্যাদি।
ফল: আম, জাম, খেজুর, ছোলম, বেতফল, তেঁতুল, গাব উত্যাদি।
ফুল:শাপলা, পদ্ম, কলমী ,বেথুন ফুল,কদম ফুল,গাবের ফুল ইত্যাদি।
অলংকার: বেলোয়ারি চুড়ি,ঝিনুকের মালা পুতির মালা,গজমতির হার,কাচের চুড়ি ইত্যাদি।
খাবার:ভাত, হুড়–ম, ীর,তক্তি,লাড়– ইত্যাদি ।
যুগ সচেতন আধুনিক কবির কলমে নানাভাবে অসা¤প্রদায়িকতা চিত্রিত হয়েছে। কবি শিমুলতলী গ্রামের হিন্দু মুসলমানের সহাবস্থার দেখাতে গিয়ে বলেনÑ
কীর্তনেতে তুলিয়া বাহু জাগায় কলরোল
মসজিদে তার বাজনা গেলে হয় না কোন গোল।

তিনি আরও বলেনÑ

মুসলমানের মরলে ছেলে যে দুখ সহে মায়
নমুর মেয়ের তুলসী তলায় প্রদীপ দুলে তায়।
যে নায়েব মশাইয়ের কারণে হিন্দু মুসলমান সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে তার সম্পর্কেও কবির চমৎকার উক্তিÑ
যার আদেশে আজ আমাদের এমন দশা ভাই
তাহার গায়ে খড়কুটারও আঁচড় লাগে নাই।
তারা উভয়ে নায়েবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বলেন-
রামনগরের নায়েব মশায়, শয়তানেরে আজ
ভবপারে পাঠিয়ে তব, পরব মরণ সাজ।

সোজন বাদিয়ার ঘাট পল্লীর দৈনন্দিন জীবনের সমাজ বাস্তবতার এক এক জীবন্ত দলিল। হিন্দু মুসলমানের একত্রে বসবাস,তাদের নামাজ,রোজা,ধর্মীয় উৎসব,বিয়ে-শাদী,পল্লী জীবনের সংস্কার ,সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, নায়েবের শাসন ও শোষণ,প্রেমের মানবিক মূল্যবোধ প্রভৃতি সজাগ দৃষ্টি সুতীক্ষ্ম মতাবলে চিত্রিত করেছেন।
কাব্যেও ভাব ভাষা উপযোগী স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কাব্যটি রচিত।
যেমনÑ
গায়ে তাহার । গয়না নাহি, । হাতে কাচের । চুড়ি
দুই পায়েতে । কাসার খাড়– । বাজছে ঘুরি । ঘুরি
মাত্রাবিন্যাস = ৪+৪+৪+৪+২
৪+৪+৪+৪+২
স্বরবৃত্ত ছন্দ।
আবার,
মনেই করনা । যদি কেই মোরে । জোর কওে নিয়ে । যায়
তুমি কিবা কর । জানিতে আমার । আজিকে যে মন । চায়

মাত্রাবিন্যাস = ৬+৬+৬+২
৬+৬+৬+২
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।
কাব্যটি সুখের পরশা দিয়ে শুরু হলেও দুলী ও সোজনের আত্মহনন ট্রাজেডিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ কাব্যটি শেষপর্যন্ত করুণ রসেই পরিণত হয়েছে
পরদিন ভোরে গায়ের লোকেরা দেখিল বালুর চরে.
একটি যুবক একটি যুবতী আছে গলাগলি ধরে।
বিষপান করে সে নদীর যে ঘাটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল পরতীতে তার নাম অনুসারে সে ঘাটের নাম হয়ে গেল সোজন বেদের ঘাট। অবশ্য এ ঘাট নিয়ে নানা কিংবদন্তি আছে। এ ঘাটে জল ভরতে গিয়ে গাঁয়ের বধূরা সোজন-দুলীর নামে এক ফোঁটা জল ফেলে যায়। ঘাটটি প্রেমের তীর্থ হিসেবে পরিচিত। সুতরাং নামকরণ শিল্পও উৎকর্ষতা পেয়েছে।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যের বিষয়বস্তু ,কাহিনীর নিটোলতা,শব্দ,ভাষা,ভাব,উপমা,উৎপ্রো, রস, নামকরণÑ সব মিলিয়ে কাব্যটি জসীমউদ্দীনের সিসৃার শ্রেষ্ঠ ফসল।

৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাইনারি চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি: পূর্ণাঙ্গ তুলনার ধারণা এবং এর গুরুত্ব

লিখেছেন মি. বিকেল, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩০



সাধারণত নির্দিষ্ট কোন বস্তু যা শুধুমাত্র পৃথিবীতে একটি বিদ্যমান তার তুলনা কারো সাথে করা যায় না। সেটিকে তুলনা করে বলা যায় না যে, এটা খারাপ বা ভালো। তুলনা তখন আসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×